উত্তম বিদ্যালাভের যোগ আছে। কাজকর্মে উন্নতি ও কাজে আনন্দলাভ। অর্থাগমের উত্তম যোগ। ... বিশদ
উত্তরবঙ্গের আশপাশে নদী, উপত্যকা, অরণ্য, সবুজ চা-বাগান, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ, ছোট ছোট ঝোরা আর জলপ্রপাত সবকিছুর মধ্যেই একটা গল্প লুকিয়ে আছে। বৌদ্ধ গুম্ফা হোক বা কাঞ্চনজঙ্ঘার গায়ে দিনের প্রথম আলোর স্পর্শ। দিনের শেষে বিদায়ী সূর্যের রক্তিম আভা কিংবা পাহাড়িয়া সহজ-সরল মানুষগুলোর আতিথেয়তার টান— এসব আমি আমি রন্ধ্রে রন্ধ্রে উপভোগ করি।
দিনভর মেঘ-বৃষ্টি-কুয়াশা-রোদের আলস্য গায়ে মেখে উত্তরবঙ্গের ছোট্ট এক পাহাড়ি হ্যামলেট বা গ্রাম তিনচুলে। পাইন, বার্চ, ওক গাছরা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে খোলা আকাশের নীচে। তাদের ফাঁকফোকর গলে কাঞ্চনজঙ্ঘা মাঝে মাঝে উঁকি দেয়। পাহাড়ের খাঁজে ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘ থমকে থাকে। তিনচুলে নামটি নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে দু’একটি গল্প প্রচলিত আছে। কারও মতে ভুটানের রাজা-রানি একসময় এখানে এসেছিলেন একটি বৌদ্ধ মঠ পরিদর্শন করতে। পাইন, ধুপি গাছে ঘেরা এই নির্জন প্রান্তরে দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অনুচ্চ তিনটি টিলাকে দেখে তাঁদের মনে হয়েছিল যেন তিনটি চুল্লি এই জায়গাটিকে ঘিরে রেখেছে পরম উষ্ণতায়। আবার কারও মতে, মহাভারতের যুগ থেকেই ওই তিনটি পাহাড় দ্রৌপদীর রান্নার উনুনের কোনা ছিল আর এখানকার জংলি বনপথটি ছিল উনুনের ভিতরের অংশ। সেই থেকেই এই গ্রামের নাম হয় ‘তিনচুলা’ যা পরিবর্তিত হয়ে ‘তিনচুলে’ হয়েছে।
নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছে মহানন্দা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারির ভেতর দিয়ে চিরচেনা সেবক রোড ধরে উত্তরের বন্ধু পেস্তা রঙের তিস্তাকে পাশে নিয়ে রাম্বিবাজার, তিস্তাবাজার পেরিয়ে পৌঁছলাম তিনচুলে। মাথার ওপর নীল আকাশ আর তার মাঝে মেঘ-রোদের আলোছায়ার খেলা দেখতে দেখতে পেশক চা-বাগানকে পাশে নিয়ে সর্পিল পাকদণ্ডি পথ উঠে গিয়েছে গ্রামে।
কাঠের তৈরি অতিথি নিবাসটির অন্দরসজ্জা এবং ঘরের কারুকার্যময় আসবাবপত্র দেখে বেশ ভালো লাগল। বাইরের বাগানে নানা রংবাহারি পাহাড়ি ফুলের জলসা দেখতে পেলাম। দুপুরে খাওয়াদাওয়া করার সময়ই হোমস্টে-র কর্ত্রীরা গল্প করতে করতে আমাদের সঙ্গে মিশে গেলেন। ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়ে আনমনে বেলা গড়ানো দেখতে থাকি। দুপুরের অলস পথ বেয়ে বিকেল আসে। নীচের পাহাড় থেকে চুপিসারে হাত ধরাধরি করে উঠে আসে মেঘ আর কুয়াশার দল। বিকেলবেলা আশপাশের জায়গা দেখতে বেরিয়ে পড়ি হাঁটাপথে। পাইন, ধুপির জঙ্গলঘেরা পথে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাই তিনচুলে বৌদ্ধ মনাস্ট্রিতে। ছায়াচ্ছন্ন বিজনপথে হাঁটতে বেশ ভালো লাগে। সারা রাস্তা জুড়ে রংবেরঙের বৌদ্ধ পতাকা ‘লুংদার’ হাওয়ায় উড়তে থাকে। গোলাপি রঙের মনাস্ট্রির ভিতরে শান্ত, সৌম্য পিতলের বৌদ্ধ মূর্তি। বাইরের দেওয়ালের চারদিকে ধর্মচক্র। জনশ্রুতি, এখানে এক বৌদ্ধ শ্রমণ দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছর ধরে ধ্যানরত ছিলেন। পাহাড়ে সন্ধ্যা নেমে আসে নিঃশব্দে বাজপাখির মতো।
ঠান্ডা থেকে সাময়িক মুক্তিলাভের উপায় হিসেবে দু’একটি দোকানে আর হোমস্টে-তে আগুন জ্বেলেছেন পাহাড়বাসীরা।
হাড়কাঁপানো হিমেল হাওয়া উপেক্ষা করে বাইরে থাকা আর সম্ভব হল না। ফিরে আসি ঘরে। নেট কানেকশন না পেয়ে সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। নির্জনতার একটা আলাদা ভাষা আছে। কফি-পকোড়ার স্বাদ নিতে নিতে সেই ভাষা উপভোগ করি। পাহাড়ের নিস্তব্ধতা মন্দাক্রান্তা লয়ে বয়ে যাওয়া ঝিঁঝিপোকাদের সমবেত কলতানে মুখর হয়ে ওঠে। রাতের অন্ধকারে আকাশের তারাদের সঙ্গেই দূর পাহাড়ের গায়ে ফুটে ওঠে জোনাক জ্বলা আলো। কালিম্পং শহরের উপস্থিতি জানান দেয়। পাইন অরণ্যর মাথায় একফালি চাঁদের জ্যোৎস্নায় ভেসে যায় তিনচুলে সবুজ অরণ্যে ঢাকা পাহাড়।
ভোরবেলায় আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে তিনচুলের সানরাইজ ভিউপয়েন্টে চলে আসি কাঞ্চনজঙ্ঘার ভুবনমোহিনী রূপ দেখব বলে। এখান থেকেই দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘার গায়ে দিনের প্রথম আলোর ছোঁয়া। তবে আজ সে কিছুটা অভিমানী। মেঘেদের অন্তরালেই লুকিয়ে রইল। ওপারে পাহাড়ের কোলে কালিম্পং শহরের ঝিকমিক আলো জ্বলে রয়েছে তখনও। পথ দেখিয়ে নিয়ে আসা ছোট্ট ছেলেটি আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয় টাইগার হিল আর তিস্তা উপত্যকার উপস্থিতি। বেলা বাড়তেই বেরিয়ে পড়ি আশপাশে কিছু জায়গা দেখার জন্য। প্রথমেই গাড়ি এসে থামে লাভার্স পয়েন্টে। তিস্তার সঙ্গে রঙ্গিতের মিলন ঘটেছে অপূর্ব এই জায়গাটিতে। দু’ধারে ঘন সবুজ জঙ্গল। পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছি সবুজের আর নীল জলের সঙ্গম। এই জায়গা নিয়ে একটি লোকগাথা প্রচলিত আছে। পাহাড়ি গাঁয়ে রংনিয়া নামে এক কিশোরী থাকত। তার ভালোবাসার কিশোরটি ছিল রঙ্গিত। কিশোর-কিশোরীর সরল ভালোবাসার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াল পরিবারের লোকজন এবং গ্রামবাসীরা। অগত্যা দুটো আলাদা রাস্তা ধরে বেরিয়ে পড়ল তারা অন্য এক গ্রাম, পেশকে ঘর বাঁধার জন্য। রংনিয়া সর্পরাজ আর রঙ্গিত একটা পাখিকে পথপ্রদর্শক রূপে নিয়েছিল তাদের সঙ্গে। কিশোরী রংনিয়া পেশকে পৌঁছল রঙ্গিতের আগে। মনের মানুষের দেখা না পেয়ে তার চোখের জল বাঁধ মানতে চাইল না। তার বুক ছাপিয়ে বয়ে যেতে লাগল চোখের জল। এর বেশ কিছুদিন পর রঙ্গিতও জলভরা চোখে পেশকে পৌঁছে দেখে সেখানে রংনিয়া আগেই হাজির। প্রেমিকাকে দেখে রঙ্গিতের মুখ থেকে বেরিয়ে এলো ‘থিস্তা’? (নেপালি ভাষায় এই শব্দের অর্থ ‘আগেই পৌঁছে যাওয়া’) অভিমানে রংনিয়া প্রথমে কথাই বলল না। অনেক অনুনয় বিনয়ের পর রংনিয়ার মান ভাঙল। সে বলল, ‘কথা দাও তুমি আমায় আঁকড়ে রাখবে চিরকাল।’ পেশকে তাদের মিলন হওয়ার পর রঙ্গিত তিস্তার বুকের উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকল। স্থানীয়রা তাই ভালোবেসে এই মিলনক্ষেত্রের নাম দিয়েছেন ‘লাভার্স পয়েন্ট’। চারদিকের প্রাকৃতিক পরিবেশ অসাধারণ।
এরপর নামরিং, রংলি-রংলিয়টের মতো বেশ কিছু মখমল সবুজ চা-বাগান দেখে চলে আসি হোমস্টেতে। মেঘের চাদর সরিয়ে পাহাড় শ্রেণির খানিকটা অংশে তখন রোদের ঝিলিক দেখা দিয়েছে। তিনচুলের অফুরান সৌন্দর্যের দৃশ্যাবলি মনের মণিকোঠায় স্থায়ীরূপে বসত গড়তে থাকে।
কীভাবে যাবেন: এনজেপি স্টেশনে নেমে সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে পৌঁছে যেতে পারেন তিনচুলে। বিমানে বাগডোগরা পৌঁছে সেখান থেকেও গাড়ি করে যাওয়া যায়।