নতুন কোনও কর্ম পরিকল্পনায় সাফল্যের ইঙ্গিত। লটারি বা ফাটকায় প্রাপ্তি যোগ। খেলাধূলায় কৃতিত্ব। বাক্যে ও ... বিশদ
মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জের বন্ধুপ্রকাশ পালকে আমরা আগে কেউ চিনতাম না। না চেনারই কথা। হাজার হাজার শিক্ষকের মতো বন্ধুপ্রকাশবাবুও একজন শিক্ষক। কোটি কোটি মানুষের ভিড়ে সাধারণ মানুষ যেমন মিশে থাকে, বন্ধুপ্রকাশও তেমনই ছিলেন। কিন্তু, দশমীর দুপুরে পুত্র ও স্ত্রী সহ তাঁর নৃশংস হত্যাকাণ্ড রাজ্যে ঝড় তুলে দিল। যতটা না মর্মান্তিকতার নিরিখে, তার চেয়ে অনেক বেশি করে রাজ্য তোলপাড় হয়ে গেল রাজনীতির কারবারিদের সৌজন্যে। আকস্মিক এই ঘটনায় তাঁদের আত্মীয়রা শোকে পাথর। ভেবে পাচ্ছিলেন না, কেন এমন দুধের শিশু সহ তিনজনকে নৃশংসভাবে খুন করা হল। প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণায় আত্মীয়রা যখন দিশাহারা, ঠিক তখনই দাবি উঠে গেল, আরএসএস করার জন্যই পুরো পরিবারটাকে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। এই দাবি শুনে চমকে উঠলেন মৃতদের আত্মীয়রা। তাঁরা বারংবার বলার চেষ্টা করলেন, রাজনীতির সঙ্গে বন্ধুপ্রকাশের তেমন কোনও সংস্রব ছিল না। কিন্তু কে শোনে কার কথা! রাজনীতির কারবারিরা তখন জাল হাতে কোমর জলে। ঘোলা জলে মাছ ধরার লোভ সামলে পাড়ে উঠে আসা বড়ই কঠিন। তাই পরিবারের লোকজনকে পাশে না পেলেও রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা চালিয়ে গেলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘রক্তকরবী’তে দেখিয়েছিলেন, লোভ কীভাবে জীবনের সব সৌন্দর্য ও স্বাভাবিক অধিকারকে অস্বীকার করে মানুষকে যন্ত্র ও উপাদানে পরিণত করে। যক্ষপুরীতে রাজার লোভের আগুনে পুড়ে মরত সোনাখনির কুলিরা। রাজার চোখে সোনাখনির কুলিরা কেউ মানুষ ছিলেন না, হয়ে উঠেছিলেন সংখ্যামাত্র। কেউ ছিলেন ৪৭ক, কেউ ছিলেন ৬৯ফ।
যুগ বদলেছে, বদলেছে সময়ও। রাজনীতির কারবারিদের কাছে মৃতদেহটাও একটা সংখ্যামাত্র। এই সংখ্যার কলেবর যত বাড়ে রাজনীতিতে বিরোধিতার জোশ ততই টগবগ করে ফোটে। ১০দিনে ন’জনের মৃত্যু। সংখ্যাটা নেহাত মন্দ নয়। সুতরাং ‘দিল্লি চলো’। জিয়াগঞ্জ ইস্যু রাষ্ট্রপতির কানে তুলতে বিজেপির একঝাঁক নেতা ছুটলেন দিল্লি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরীর নেতৃত্বে দেখা করলেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের সঙ্গে। তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা হল, পশ্চিমবঙ্গে জঙ্গলের রাজত্ব চলছে। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণেই জিয়াগঞ্জে নারকীয় হত্যাকাণ্ড। ১০দিনে তাঁদের ন’জন বিজেপি কর্মী খুন হয়েছেন। রাজ্যপাল এই ইস্যুতে মন্তব্য করায় জিয়াগঞ্জ হত্যাকাণ্ড এক নতুন মাত্রা পেল। উঠল অতিসক্রিয়তার অভিযোগ।
যে কোনও মৃত্যুই অত্যন্ত মর্মান্তিক। আর বন্ধুপ্রকাশবাবুর পরিবারে যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে তার নিন্দার কোনও ভাষা নেই। যে কোনও সুস্থ মানুষ এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের তীব্র ধিক্কার জানাতে বাধ্য। এমনকী, এই খুনের ব্যাপারে পুলিস যাকে মূল অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেপ্তার করেছে, সেই উৎপল বেহেরাও পুলিসি জেরায় জানিয়েছে, বন্ধুপ্রকাশ পালের স্ত্রী এবং তাঁর শিশুসন্তানকে খুন করে তার অনুতাপ হচ্ছিল। তার নাকি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আত্মহত্যা করার ইচ্ছাও হয়েছিল।
পুলিস এখনও পর্যন্ত তদন্ত করে যা জানতে পেরেছে তাতে খুনের পিছনে রয়েছে আর্থিক কারণ। বন্ধুপ্রকাশবাবু জীবনবিমার টাকা নিয়ে তা জমা দেননি। আর সেই কারণেই নাকি তাঁকে সপরিবারে খুন করেছে উৎপল। অর্থাৎ এর সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু, বিজেপি নেতৃত্ব এই খুনের সঙ্গে রাজনীতিকে জড়িয়ে দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা চালাল।
এরাজ্যে বিজেপি একটা বিশেষ শক্তি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা ও কর্মীদের দাম্ভিকতা, দুর্নীতি, জনবিচ্ছিন্নতা সহ নানা কারণেই বিজেপি পায়ের তলায় মাটি পেয়েছে। যথেষ্ট শক্তপোক্ত সেই মাটি। স্রেফ তৃণমূল সম্পর্কে মানুষের হতাশা ও বিরক্তিই তাদের অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু, সেই বিজেপিও যদি মৃত্যু নিয়ে সস্তার রাজনীতিতে জড়িয়ে যায় তাহলে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতায় চিড় খাবে না, এমনটা বলা যায় না। মনে রাখতে হবে, রাজনীতিতে বিশ্বাসযোগ্যতা একটা বড় সম্পদ। মানুষ বিশ্বাস করেছিল, নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বই দেশকে মজবুত করতে পারবে। সেই বিশ্বাসে ভর করেই তিনি আজ ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
শুধু বিজেপি নয়, মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করে ফায়দা লোটার চেষ্টা এর আগেও প্রায় সব রাজনৈতিক দলই করেছে। কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল সকলেই একই পথের পথিক। মৃত্যু নিয়ে সস্তার রাজনীতি করতে গিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের অনেকবার প্রবল সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে। তবুও ছাড়েনি এই রাস্তা। তবে, মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করতে গিয়ে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি নাকানি চোবানি খেয়েছিল কংগ্রেস।
উত্তরদিনাজপুরের গোয়ালপুকুরের ফরওয়ার্ড ব্লক বিধায়ক রমজান আলির কথা মনে আছে? কলকাতায় এমএলএ হস্টেলে রহস্যজনকভাবে খুন হয়েছিলেন রমজান সাহেব। তখন প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি সোমেন মিত্র। রমজান আলি খুনের ঘটনায় রাজ্যে আইনশৃঙ্খলার অবনতির অভিযোগ তুলে আচমকা বাংলা বন্ধের ডাক দিয়েছিলেন সোমেনবাবু। কিন্তু, তদন্ত এগতে কী দেখা গেল? দেখা গেল, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত কারণে খুন হয়েছিলেন ফরওয়ার্ড ব্লক বিধায়ক। গ্রেপ্তার হয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী। খুন নিয়ে সস্তার রাজনীতি করতে গিয়ে মুখ পুড়েছিল কংগ্রেসের।
তবে, মৃতদেহ সামনে রেখে রাজনীতি করার ক্ষেত্রে তৃণমূল কংগ্রেসও কম যায়নি। সিপিএমের সঙ্গে সংঘর্ষে খুন হওয়া একের পর এক তৃণমূল কর্মীর মৃতদেহ কলকাতায় নিয়ে গিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, রাজ্যজুড়ে প্রচার পাওয়া। গ্রামের মৃতদেহ কলকাতায় নিয়ে গিয়ে আলোড়ন সৃষ্টির সমালোচনা করেছিল সিপিএম। কিন্তু, তৃণমূলের সেই উদ্দেশ্য কিছুটা সফল হতেই সিপিএমও কয়েকবার সেই রাস্তায় হাঁটার চেষ্টাও করেছিল।
তবে, কৌশলী সিপিএমের মুন্সিয়ানা ছিল মৃতদেহ সামনে আনার চেয়ে তা গায়েব করায়। ছোট আঙারিয়া, বেনাচাপড়া প্রভৃতি এলাকায় একের পর এক গণহত্যা কাণ্ড ঘটিয়েও মৃতদেহ লোপাট করে দিয়েছিল। যে সিবিআইয়ের নামে গোটা ভারত থরহরিকম্প, সেই সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের তাবড় তাবড় অফিসারকে ঘোল খাইয়ে ছেড়েছিল সিপিএম। তদন্তভার হাতে নিয়েও ছোট আঙারিয়া গণহত্যার কিনারা করতে পারেনি তারা। উদ্ধার করতে পারেনি একটি মৃতদেহও। রাজ্যের ক্ষমতা বদল না হলে মানুষ জানতেও পারত না কী করে পাঁচজন মানুষকে খুন করেও হাত ধুয়ে ফেলা যায়।
পৃথিবী যতই হিংসায় উন্মত্ত হোক না কেন, আজও রক্ত দেখে, মৃতদেহ দেখে মানুষ বিচলিত হয়। মৃতদেহ এখনও মানুষের মনে সহানুভূতি জাগায়। মৃত্যুর ভয়াবহতা যে শাসক দলের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। অনেকেই বিশ্বাস করেন, বর্ধমানের সাঁইবাড়ি হত্যাকাণ্ড দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকারের কফিনে পেরেক ঠুকে দিয়েছিল। ঠিক একইভাবে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের কফিনে শেষ পেরেকটি ঢুকে দিয়েছিল নেতাই গণহত্যা কাণ্ড। মৃত্যু, বর্বরতা যে কোনও শাসন ক্ষমতা বদলের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে কাজ করে। আর সেটা সব চেয়ে ভালো জানে রাজনীতির কারবারিরা।
সেই কারণেই খুন হলেই রাজনীতির কারবারিরাই তার দখল নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু, একবারও ভেবে দেখে না, মৃতদেহকে রাজনীতির পণ্য হিসেবে কাজে লাগানোর চেষ্টা শোকার্ত পরিবারের প্রতি কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখে দাঁড় করায়। মৃতকে নিজের দলের কর্মী বা সমর্থক প্রমাণের জন্য শুরু হয় তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে টানাটানি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মৃতদেহ রাস্তায় ফেলে বিক্ষোভের নামে চলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা। প্রাকৃতিক নিয়মে মৃতদেহে পচন ধরে। ফুলতে শুরু করে। বিকৃত হয় মুখমণ্ডল। চেনা মানুষটা আপনজনের কাছেও কেমন যেন অচেনা হয়ে যায়। শেষবারের মতো প্রিয় মানুষটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদার সুযোগটাও কেড়ে নেওয়া হয়। স্রেফ রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য।
মৃতদেহ কাড়াকাড়ির লড়াই কখনও কখনও শোকস্তব্ধ পরিবারে ভাঙন ধরায়। স্ত্রীকে যে দল কব্জা করে, তার বিরোধী দল তখন হামলে পড়ে মৃতের বাবা, মায়ের দখল নিতে। কাউকে না পেলেও নিদেনপক্ষে ভাই। চাপ ও প্রলোভনে ব্যতিব্যস্ত মৃতের পরিবার তখন হয়তো শোক ভুলে অঙ্ক কষে। লাভ ক্ষতির অঙ্ক। কার সঙ্গে গেলে লাভ বেশি। সেই অঙ্কে বদলায় বিবৃতি, বদলায় এফআইআরের বয়ান। সকালে মৃত স্বামীকে যে দলের সমর্থক হিসেবে দাবি করে, বিকালে ঠিক তার বিরোধী দলের নেতার পাশে বসে সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলেন। রাজনীতির কারবারিদের ফাঁদে পড়ে মৃতের পরিবার সহনুভূতি পাওয়ার বদলে আমজনতার কাছে অনেকসময় হয়ে ওঠে হাসির খোরাক।
মৃতদেহকে পণ্য করে রাজনীতির কারবারিরা ফায়দা লোটার চেষ্টা করেন ঠিকই। কিন্তু, সেই লাভ বড়ই ক্ষণস্থায়ী। এই তাপসী মালিকের পরিবারের কথাই ভাবুন না। সিঙ্গুর জমিরক্ষা আন্দোলনের প্রথম শহিদ হিসেবে এখনও জ্বলজ্বল করে তাপসীর নাম। তাপসীর বাবা মনোরঞ্জনবাবুকে বহু সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঠিক পাশের চেয়ারে বসতে দেখা গিয়েছে। তৃণমূল সব রকমভাবে ওই পরিবারটির পাশে দাঁড়িয়েছে। তাপসীদের মাটির দেওয়ালের টালির চালার বাড়িটা এখন আর নেই। সেখানে মাথা তুলেছে মার্বেলের বাড়ি। সেই মনোরঞ্জনবাবু গত পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের বিরুদ্ধে জেলা পরিষদে নির্দল হয়ে লড়েছেন। অনেকে বলে, তাঁর নাকি গেরুয়া শিবিরের সঙ্গে সখ্য তৈরি হচ্ছে।
হৃদয় ঘোষ, পিতা ঈশ্বর সাগরচন্দ্র ঘোষ। সাকিন, বাঁধনবগ্রাম, থানা-পাড়ুই, জেলা-বীরভূম। ২০১৩ সালের ২১জুলাই বাড়িতে দুষ্কৃতীদের ছোঁড়া বোমা ও গুলিতে মারা গিয়েছিলেন হৃদয় ঘোষের বাবা সাগরবাবু। সেই মৃত্যুর জন্য তৃণমূলের দাপুটে নেতা অনুব্রত মণ্ডলকে দায়ী করে শুরু হয়েছিল লড়াই। হৃদয় ঘোষকে সামনে রেখেই বীরভূমের মাটিতে পা রেখেছিল বিজেপি। প্রতিবাদের মুখ হয়ে উঠেছিলেন হৃদয়বাবু। সেই হৃদয় ঘোষ এখন তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত বোলপুর-শ্রীনিকেতন পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ। শুধু তাই নয়, তিনি এখন অনুব্রতবাবুর অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
এসব দেখে কারও বলতে ইচ্ছা করতেই পারে, সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই রাজনীতি! হ্যাঁ, রাজনীতি বড়ই বিচিত্র। রাজনীতির কারবারিদের হাতের হ্যাঁচকা টানে আমরা তাঁতের মাকুর মতো আমরা একবার এদিক ছুটি, আর একবার ওদিক। মাকুর টানে কপড়ের মেঝের মতোই জমাট বাঁধে নেতাদের রাজনৈতিক জমি। আর আমরা? আমরা পুতুলনাচের পুতুলের চেয়েও অসহায়। রাজনীতির কারবারিদের অদৃশ্য রশির টানে আমরা নেচে মরি, আমরা পণ্য হই। কিন্তু, আর কতদিন? রাজনীতির কারবারিদের খাতায় মৃত্যু কি কেবলই একটা সংখ্যাই থেকে যাবে? রক্তকরবীর নন্দিনী সংখ্যার পরিচয় মুছে দিয়ে মানুষের স্বীকৃতি আদায় করতে পেরেছিলেন। কিন্তু, আমরা কি পারব? নাকি রাজনীতির কারবারিদের সৌজন্যে মৃত্যু পণ্যই থেকে যাবে?