নতুন কোনও কর্ম পরিকল্পনায় সাফল্যের ইঙ্গিত। লটারি বা ফাটকায় প্রাপ্তি যোগ। খেলাধূলায় কৃতিত্ব। বাক্যে ও ... বিশদ
৯ মাস সময় লাগে একটি পার্সি গারা শাড়ি তৈরি করতে। ইরানে জন্ম হয়েছিল। তার পর এসে পৌঁছয় ভারতে। পার্সি এমব্রয়ডারি বিশ্বের অন্যতম সূক্ষ্ম এক শিল্পমাধ্যম। পার্সি এমব্রয়ডারিকে কেউ বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি। মোটামুটি সমাপ্তই বলা যায়।
ওয়ালেট থেকে মোবাইল পাউচ। বেডশিট থেকে চাদর। একটি বিশেষ টাইপের ডিজাইন সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায়। যার জন্মদাতা আদতে নীলগিরি পাহাড়ের পাদদেশে থাকা টোডা উপজাতি। এই মুহূর্তে মাত্র দেড় হাজার টোডা উপজাতি এই আর্ট ফর্মকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কিন্তু তাদের সরকার থেকে কোনও সহায়তা করা হয় না। বরং তারা জানতে পারছে সর্বত্র তাদের এই পেন্টিং-এর উপকরণ পাওয়া যায়। অথচ তাদের তো তেমন বিক্রি নেই? তাহলে রহস্যটা কী?
গোটা দেশে মাত্র ৬ জন এখনও রোগান পেন্টিং করে চলেছে। রাজস্থানের কচ্ছ এলাকার ক্ষেত্রি গ্রামের। ৬ ইঞ্জি মেটাল রড আর ক্যাস্টর অয়েল দিয়ে এই রোগান পেন্টিং শাড়ির উপর আঁকা হয়। আর একজনও নেই এই পেন্টিং নিয়ে কাজ করার। অথবা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। কারণ, কিছু ফরেনার ট্যুরিস্টদের লোকাল ট্যুরিস্টরা নিয়ে আসে আর তাদের কাছেই যা বিক্রি হয়। সরকার থেকে কখনও আগ্রহ দেখানো হয়নি। তাই ওই ৬ জনই রোগান পেন্টিংয়ের শেষ শিল্পী।
রাজস্থানের কাঠপুতলি অথবা ওড়িশার কান্দেরা। কিংবা কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণির মাটির পুতুল। কেন্দ্রীয় সরকারের ১০০ কোটি টাকার লোকাল ক্লাস্টার প্রকল্পগুলিতে স্থান পায়নি। তাই পুতুল আর খেলনা শিল্প মৃতপ্রায়। এই প্রায় ৩ হাজার বছরের পুরনো হস্তশিল্পটি সম্পূর্ণ চলছে সরকারি প্ল্যানের সহায়তা ছাড়াই।
এই প্রতিটি শিল্পের প্রসঙ্গ উত্থাপনের কারণ কী? কারণ হল, এই প্রতিটি শিল্পের নকলে বাজার ছেয়ে যাচ্ছে। কৃতিত্ব চীনের। অবিকল এই প্রাচীন ভারতীয় শিল্পগুলিকেই চীন প্রমোট করে নিজেদের প্রোডাক্ট বিক্রি করতে সচেষ্টা হয়েছে। এগ্রিকালচারাল প্রোডাক্টস, কটন টেক্সটাইলস, হ্যান্ডিক্র্যাফট—এই উপকরণ একটা সময় পর্যন্ত ভারত থেকেই আমদানি করত চীন। ক্রমেই সকলের অজান্তে সেই অনুপাত বদলে যাচ্ছে। খেলনা, ইলেকট্রিকাল প্রোডাক্ট, কম্পিউটার যন্ত্রাংশ, গাড়ি, মিল্ক প্রোডাক্ট, সার, অ্যান্টিবায়োটিকস, মোবাইল ইত্যাদি প্রোডাক্ট দিয়ে ভারতের বাজার ভাসিয়ে দিয়েছে চীন, সেটা সবাই জানে। কিন্তু নতুন প্রবণতা হল, ভারত যে উপকরণ চীনকে রপ্তানি করত, এখন সেখানেও হাত বাড়িয়েছে চীন। আর ভারতেরই প্রাচীন শিল্প কিংবা হস্তশিল্পগুলির নকল করে বিপুল পরিমাণে ভারতকেই সাপ্লাই করছে চীন। আর তার ফলে চরম অসাম্যের এক বাণিজ্যিক অনুপাত তৈরি হচ্ছে দিন দিন। কতটা আগ্রাসী হয়েছে চীন? খোঁজ নিলে জানা যাবে ভারতীয় টায়ার কোম্পানিকে পিছনে ফেলে সস্তার টায়ার ভারতে সাপ্লাই করে চীন ক্রমেই বাজার দখল করে নিচ্ছে। এমনকী মাছ ধরার জাল এখন সব থেকে বেশি বিক্রি হয় চাইনিজ নেট। বিগত তিন বছরে ফার্মাসিউটিক্যালস শিল্পে ভারত যে সব দেশ থেকে আমদানি করেছে ওষুধ নির্মাণের উপকরণ, তার মধ্যে এক নম্বর দেশের নাম চীন। শুধু খেলনা শিল্পের দিকে তাকালে রীতিমতো আতঙ্ক তৈরি হবে। ভারতের ৮০ শতাংশ খেলনা বাণিজ্যই নিয়ন্ত্রণ করে চীন। মাত্র ২০ শতাংশ আসে অন্য দেশ থেকে। বণিকসভা অ্যাসোচেমের রিপোর্ট অনুযায়ী বিগত ৫ বছরে ৪০ শতাংশ ভারতীয় খেলনা কোম্পানি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ভারতের আমদানি করা মোবাইলের মধ্যে ৫২.৬ শতাংশ স্মার্টফোন আসে চীন থেকে। যে ক্রিকেট নিয়ে আমরা অত্যন্ত গর্বিত থাকি বিশ্বের সেরা র্যাঙ্কিং নিয়ে সেই ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিমের স্পনসরশিপ রাইট ২০২২ সাল পর্যন্ত নিয়ে রেখেছে চীনের মোবাইল সংস্থা ওপ্পো। প্রশ্ন হল, চীনের এই আগ্রাসন ঠেকানো কি সম্ভব নয়? ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের বিধি অনুযায়ী কোনও দেশকে রপ্তানি করা থেকে অন্য কোনও চুক্তিবদ্ধ দেশ নিষিদ্ধ করতে পারে না। একমাত্র সম্ভব যদি কোনও সিকিউরিটি অথবা হেলথ সংক্রান্ত সমস্যা থাকে। ভারত ২০১৭ সালে ঘোষণা করেছিল যে সব মোবাইলের আইএমইআই নম্বর থাকবে না সেই সব চাইনিজ কোম্পানির মোবাইল ভারতে রপ্তানি করা যাবে না। চীন মেনে নিয়েছিল। এবং শান্ত ভাবে পাল্টা প্রত্যাঘাত করে ভারতের কিছু দুগ্ধজাত পণ্য নিষিদ্ধ করেছিল চীনে। কারণ স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। যা ভারতের রপ্তানি বাণিজ্যে বড় আঘাত।
সম্প্রতি ভারতবাসী মিডিয়ায় একটি সংবাদ পাঠ করে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে উৎফুল্ল হয়েছে। সেটি হল, স্যামসাং এবং অ্যাপল তাদের চীনের প্রোডাকশন ইউনিটগুলি বন্ধ করে দিয়ে ভারতে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা ভেবে নিলাম এটা বোধহয় চীনকে জোর ধাক্কা দেওয়া গেল। আদতে উল্টো। চীনের ডোমেস্টিক মার্কেটে চীনের প্রথম সারির পাঁচটি মোবাইল সংস্থাই এত জনপ্রিয় যে অ্যাপল কিংবা স্যামসাং-এর প্রোডাক্ট বিক্রি হচ্ছে না। তাই তারা বাধ্য হয়ে ভারতে চলে আসছে। কারণ ভারত নিজেদের সম্পর্কে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করে, অথচ আজ পর্যন্ত এটা বিশ্বব্র্যান্ডের স্মার্টফোন পর্যন্ত তৈরি করতে পারল না। চীনের পাঁচটি মোবাইল কোম্পানির ব্র্যান্ড বিশ্বজয় করে চলেছে। ভারত মনপ্রাণ ঢেলে ফেক নিউজের গবেষণা করে, অথচ এখনও নিজস্ব একটা সার্চ ইঞ্জিন তৈরি করতে পারল না। এখনও আমাদের জনপ্রিয়তম সার্চ ইঞ্জিন আমেরিকার গুগল, আমাদের জনপ্রিয়তম সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম আমেরিকার ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, ট্যুইটার। চীন এ সবের তোয়াক্কা করে না। তাদের নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়া আছে।
এ সব বলার অর্থ হল, সারা বছর পাকিস্তানকে ভিলেন, হিন্দু বনাম মুসলিম, ঘটি বানাম বাঙাল, ৩৭০ আর রামমন্দির নিয়ে বিপুল এনার্জি ক্ষয় করে করে আমাদের আর নিজের দর তথা বিশ্ববাজারে বাণিজ্যিক ওজন ও স্ট্যাটাস বাড়ানোর কোনও ইচ্ছাই অবশিষ্ট থাকে না। ভারতে যখন বিভিন্ন বড় বড় দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা আসেন, আমরা ভাবি আমাদের বিরাট গুরুত্ব। আসলে একটু তলিয়ে দেখলে বুঝতে পারব, আমরা নেহাৎ একটা সার্বিক ক্রেতা। তাই আমাদের নানা ভাবে প্রশংসা করে হরেক রকম বিক্রেতার দল প্রোডাক্ট বিক্রি করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার নিয়ে চলে যায়। সেই প্রোডাক্ট কখনও অ্যাপাচে হেলিকপ্টার। কখনও রাফাল। কখনও সারফেস টু এয়ার ক্রুজ মিসাইল, কখনও স্যামসাং, কখনও অ্যাপল। আমাদের এ রকম মেক ইন ইন্ডিয়া প্রোডাক্ট কটা বিদেশি রাষ্ট্র ক্রয় করে?
চীন সম্পূর্ণ নিজেকে ফোকাস রেখে এগচ্ছে বিশ্বের এক নম্বর ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্র হওয়ার জন্য। কীভাবে? এশিয়া, আফ্রিকায় বৃহত্তম রপ্তানিকারী বাণিজ্যিক দেশ হওয়ার লক্ষ্যে চায়না পাকিস্তান ইকনমিক করিডর চীনের সর্বাপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণ প্রকল্প। ভারত যখন কাশ্মীর, নিয়ন্ত্রণরেখা, তিন তালাক, ইংরেজি বনাম হিন্দির আলোচনায় মত্ত, তখন চীন ক্রমেই জট ছাড়াচ্ছে ইকনমিক করিডরের। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, চীন এই করিডরে পাকিস্তানের সাড়ে ৬ হাজার একর কৃষিজমি লিজে নিয়ে নিয়েছে। সেখানে হবে ১৭টি প্রকল্প। সাড়ে ৮ লক্ষ টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন সার কারখানার আস্ত প্ল্যান্ট হবে। ১০ লক্ষ টন শস্য ও সব্জি প্রক্রিয়াকরণ প্ল্যান্ট তৈরি হচ্ছে। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের সাহিওয়ালে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র হবে। ১৯৫০ সালে মাও সে তুং জিংজিয়াং প্রদেশকে গড়ে তুলেছিলেন রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র মডেলে। ঠিক সেই মডেলে পাকিস্তানের মধ্যেই একটি পৃথক চীনা বাণিজ্যিক রাষ্ট্র গড়ে তুলছে চীন। আর সেটা পাকিস্তানের পক্ষে সহায়ক। কারণ, প্রতিটি ক্ষেত্রে পাকিস্তান বিপুল ভাবে আর্থিক সহায়তা পাচ্ছে। এর ফলে ক্রমেই পাকিস্তানের আমেরিকা নির্ভরতা কমছে। বালুচিস্তান আর খাইবার পাখতুনওয়ালায় খনিজ সম্পদের অধিকার চীন নিয়ে নিচ্ছে পাকিস্তানের থেকে। এমনকী ওই এলাকার স্বর্ণখনির দিকে তাকিয়ে চীন এখানে গড়ে তুলছে মার্বেল ও গ্রানাইট প্রসেসিং সাইট। পাকিস্তানের গদরে চীন ইতিমধ্যেই একটি বন্দর বানিয়ে ফেলেছে। পশ্চিম এশিয়া আর আফ্রিকার দেশগুলিতে পণ্য রপ্তানির লঞ্চপ্যাড এই গদর বন্দর। আর গদর বন্দরের সঙ্গে যোগস্থান করা হয়েছে কারাকোরাম হাইওয়ের। গদর বন্দরেই চীন গড়ে ন্যাভাল বেস। অর্থাৎ নৌবাহিনীর কেন্দ্র। গালফ অব আদেনের জিবুতির পর এটাই হবে চীনের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নৌবাহিনী কেন্দ্র। যা ভারতের কাছে বিপজ্জনক।
এই তথ্যাবলি সকলের জানা। এই তথ্য থেকে যে গোপন বার্তাটি বেরিয়ে আসছে তা হল আমরা কথায় কথায় পাকিস্তানকে নিয়ে হাসাহাসি করি, কটাক্ষ করি, ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করি, একবারও তো ভাবি না যে এত আন্তর্জাতিক নিন্দা সমালোচনা সত্ত্বেও পাকিস্তান কেন বহাল তবিয়তে একই ভাবে জঙ্গি সাপ্লাই করে যাচ্ছে? কীসের জোর পাকিস্তানের? জোর হল, চীনের এবং আমেরিকারও। আমেরিকা ভারতকে খুশি করতে হোয়াইট হাউস থেকে পাকিস্তানকে নরম গরম বকুনি দেয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত বিপুল আর্থিক কিংবা কূটনৈতিক ধাক্কা পাকিস্তান খায়নি। নাম কা ওয়াস্তে কিছু প্রতীকী নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়। কিন্তু দেখা যায় পাকিস্তান যথারীতি আমেরিকা থেকে সব রকম অস্ত্র ও বাণিজ্যিক লেনদেন করে চলেছে। আর পাকিস্তানের একটা বিরাট অংশ কার্যত চীনের কলোনিতেই পরিণত হয়েছে। সুতরাং চীন নিজের স্বার্থেই পাকিস্তানের সঙ্গে চিরকাল থাকবে। চায়না পাকিস্তান ইকনমিক করিডর হয়ে গেলে আগামী দিনে চীন আরও বিপুল পরিমাণ পণ্য সাপ্লাই করবে ভারতে। আমাদের অভ্যন্তরীণ মার্কেট ক্রমেই ধ্বংস হবে। চীনের আগ্রাসনের প্রতিরোধ করতে আমাদের পাল্টা প্ল্যান কী?
প্রতিরক্ষা এবং বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক পাওয়ার স্ট্রাগলে ক্ষমতার এই দুই প্রধান ভরকেন্দ্রের ক্ষেত্রেই চীন নিজেদের শক্তিতে বলীয়ান। আর আমরা সামরিক শক্তিতে বিদেশের থেকে ক্রয় করা অস্ত্রের উপর নির্ভরশীল আবার বাণিজ্য তথা অর্থনীতিতেও চরম মন্দায় আক্রান্ত। এই তথ্যটা কিন্তু তাবৎ বিশ্ব বুঝতে পারছে। অতএব, নন-সিরিয়াস বিষয় নিয়ে দিনভর মাতামাতি করার তুলনায় এখনই সরকারের উচিত ভারতের প্রকৃত শক্তিবৃদ্ধি করার কোনও সঠিক প্ল্যান করা! না হলে আগামীদিনে হয়তো ভাইফোঁটায় চীনের রসগোল্লাই বেশি করে বাজার দখল করবে! আবার আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতেও চীনই হবে বৃহত্তম শক্তি! সমস্যা হল, অর্থনীতি, বিদেশনীতি, কূটনীতি নিয়ে ভারত যে কী ভাবছে, সেটাই স্পষ্ট নয়! রাজনৈতিক ঘোষণা, বিজ্ঞাপনে, সরকারি বিবৃতি অনেক হল। এবার আমরা সত্যিকারের শক্তিশালী হতে চাই ঘরে বিশ্বের দরবারে! সরকার কি পারবে? তারা নিজেরা কী ভাবছে নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কে? এটা জানা দরকার!