নতুন কোনও কর্ম পরিকল্পনায় সাফল্যের ইঙ্গিত। লটারি বা ফাটকায় প্রাপ্তি যোগ। খেলাধূলায় কৃতিত্ব। বাক্যে ও ... বিশদ
আবার জঙ্গি হানা! আবার রক্তাক্ত কাশ্মীর! আবার পাঁচ-পাঁচটা নিতান্ত নিরীহ নিরপরাধ তাজা প্রাণ চলে গেল! এবং ঘটনাচক্রে হতাভাগ্যদের পাঁচজনই এই বাংলার বাসিন্দা। কী অপরাধ করেছিল তারা? পেটের জ্বালা ঘর-সংসারের দায় মেটাতে দুটো টাকা রোজগারের আশায় তারা গিয়েছিল দক্ষিণ কাশ্মীরের কুলগাঁওয়ে আপেল বাগানের কাজে। একদা শান্তির ভূস্বর্গ যে এখনও যথেষ্ট ভয়ঙ্কর সেকথা কে না জানেন? কিন্তু সেই ভয়ঙ্করের জঙ্গি বীভৎসতা যে আপেল বাগানও এভাবে রক্তাক্ত করে দেবে তা হয়তো বিশ্বাস করতে পারেনি ওই পাঁচ হতভাগ্য। অবশ্য এই পাঁচজনই নয়, গত কয়েকদিনে জঙ্গিদের হামলায় আরও জনাপাঁচেক প্রাণ হারিয়েছেন ওই কাশ্মীরেই। এই হতভাগ্যদের কেউ ট্রাক চালক কেউ ব্যবসায়ী কেউ সামান্য শ্রমিক। গত সোমবার উত্তর কাশ্মীরের সোপরে জঙ্গিদের গ্রেনেড হামলায় কুড়িজনেরও বেশি ঘায়েল হলেন। এদের অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক! হয়েই চলেছে! দেখে শুনে মনে হচ্ছে, ওই জঙ্গিদের কাছে কে কী বলছে থোড়াই কেয়ার! বিশ্বজোড়া প্রতিবাদ আমেরিকা রাশিয়ার মতো শক্তিধরদের হুঁশিয়ারি ভারতের কড়া মনোভাব সশস্ত্র প্রতিক্রিয়া— কোনও কিছুকেই যেন তোয়াক্কা করছে না ওই নরকের কীটগুলো! ভূস্বর্গ জুড়ে নিরীহ মানুষ খুনের নারকীয় কাণ্ড ঘটিয়েই চলেছে!
কিন্তু, ভারতই হোক কি আমেরিকা রাশিয়া— সামরিক শক্তির তো অভাব নেই! ৩৭০ ধারা বিলোপের পর কাশ্মীরে যাতে অশান্তি ছড়াতে না পারে তার জন্য বিপুল সংখ্যায় সেনা সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে। কাশ্মীরি জনতার নিরাপত্তার স্বার্থে যে যে ব্যবস্থা করা দরকার সেনাবাহিনী সব করেছে। অন্তত খবর তেমনই। অবশ্য, সেই ‘ব্যবস্থা’ নিয়ে নানা মহলে ইতিমধ্যেই নানা সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। জঙ্গি দমনের নামে তল্লাশির নামে সেখানে নাকি আম পাবলিককে হেনস্তা করা হচ্ছে, নানান কড়াকড়ি বাড়াবাড়িতে স্বাভাবিক জনজীবনের অভাবে ধুঁকছে গোটা রাজ্য ইত্যাদি ইত্যাদি নানাবিধ অভিযোগের ফলঝুরি ৩৭০ বিলোপের পর থেকেই ঝরছে! সে সবের সত্যতা কতটা আছে বা নেই সেই বিতর্কে যাচ্ছি না। কিন্তু, একটা প্রশ্ন মনে জাগছেই— এত বজ্র আঁটুনির মধ্যেও কি গোরো আলগা আছে কিছু? না হলে সোপরে বাসস্ট্যান্ডে গ্রেনেড ছুঁড়ে কী করে পালায় জঙ্গি? সাম্প্রতিকে দেখা যাচ্ছে জঙ্গিরা সাধারণ মধ্য বা নিচুতলার মানুষজনকেই টার্গেট করছে— বাস ড্রাইভার, শ্রমিক, ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ী ইত্যাদি। তো, এ সত্য যদি সামান্য কটা খবর পড়ে লোকে এই বাংলায় বসে বুঝতে পারেন তবে ঘটনাস্থলে প্রহরারত ভারতের দুর্দান্ত চৌখস সেনাবাহিনী ও তাঁদের কর্তারাও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। তাহলে দিনের পর দিন এই অকারণ প্রাণহানি রোধ করা যাচ্ছে না কেনও?
কেউ কেউ বলছেন, রাজনীতি। সোশ্যাল মিডিয়াতে বিশেষ করে এই অভিযোগ উঠেছে। ওই সমালোচকদের বক্তব্য, নির্বাচন এলেই নাকি কাশ্মীরে অশান্তি ছড়ায় আর তা ঠেকাতে সেনা সক্রিয় হয়! সম্প্রতি মহারাষ্ট্র এবং হরিয়ানার নির্বাচনের দিকে লক্ষ রেখেই নাকি কিছুদিন আগে সীমান্তে ফের গোলাগুলি চলেছে। যাঁরা এই কথা বলেছেন, তাঁরা ভোটফল বেরনোর পর আর তেমন রা কাড়ছেন না। তার কারণটি বলা বাহুল্য। দুই রাজ্যের কোনওটিতেই নরেন্দ্র মোদিজি’র পদ্ম বাহিনী প্রত্যাশিত ফল পায়নি। দুই রাজ্যে বিজেপি’ই সরকারে থাকবে কিন্তু তার পথ এবার অন্তত কুসুমাস্তীর্ণ হল না— যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হল। কেন হল? যদি কাশ্মীর এবং জঙ্গি ইস্যু দিয়েই ভোট জেতা যেত তাহলে তো হওয়ার কথা নয়। কেউ কেউ বলছেন, ওই দুই রাজ্যে যথেষ্টভাবে মোদিজিকে ব্যবহার করা হয়নি তাই ঠিকঠাক ফল ফলেনি। এবং এতদ্বারা নাকি এটাই প্রমাণ হয়— মোদিজি ছাড়া বিজেপি অচল। ইন্দিরা গান্ধীর আমলে একসময় যেমন ধুয়ো উঠেছিল— ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া তেমনি ওঁরা বলতে চান— বিজেপি মানেই মোদিজি।
কিন্তু, মুশকিলটা হল— এঁরা কেউ ভোটদাতা জনতার মুখের ছবিটা খেয়াল করছেন না! করলে দেখতে পেতেন সেখানে দেশ জোড়া মন্দার ছায়া কতটা ঘনীভূত, সেই ছায়ায় কালোমুখ মানুষ তাঁদের ঘর সংসার পরিবার পরিজনের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় কতটা গ্রস্ত। তাঁরা অনেকেই জানেন, বিশ্ব বাজার জুড়েই এখন একটা মন্দার হাওয়া বইছে। কিন্তু তাঁদের একাংশের বক্তব্য মনমোহন সিংয়ের আমলে আমেরিকার মতো মহা অর্থনীতি যখন মন্দায় কাহিল হয়েছে ভারত তখনও বহাল তবিয়তে কাজকাম ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে গেছে। এখন তবে কী হল? কেন অর্থনীতি নিয়ে এত সংশয়? নোবেলজয়ী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য এক্ষেত্রে ইন্ধন জুগিয়েছে আরও— তাহলে কি সত্যিই এ দেশে গরিবের অর্থ সামর্থ্য বাড়েনি!? সেজন্যই বাজার ক্রমশ রুগ্ন হয়ে পড়ছে? অন্যদিকে মহারাষ্ট্রে একটি ব্যাঙ্কের ঘট উল্টোনো থেকে বিএসএনএল সমেত সর্বত্র বেসরকারিকরণের জল্পনা গাড়ি শিল্পে মন্দা সোনার দাম লাফিয়ে বাড়া ইত্যাদি প্রভৃতিতে একটা যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে দেশ জুড়ে তা-ই বা অস্বীকার করবেন কে?
আজকাল পথেঘাটে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, লোকে বলছে— কী চাইছেন বলুন তো?! গরিব মধ্যবিত্তরা কি দেশে থাকবে না? হু হু করে সবকিছুর দাম বেড়ে যাচ্ছে, কলকারখানা বন্ধ, তার জমিতে বিশ-চল্লিশ তলা উঠে যাচ্ছে, কোটি কোটিতে বিকোচ্ছে মুনাফা উঠছে! স্থায়ী চাকরির ভবিষ্যৎ নিয়েও নিশ্চিন্তে থাকা যাচ্ছে না— বেসরকারিকরণের খাঁড়া ঝুলছে রেলের মতো বিশ্বের সর্ববৃহৎ সরকারি প্রতিষ্ঠানে! শিক্ষা বিশেষত উচ্চশিক্ষাও মহার্ঘ থেকে মহার্ঘতর হয়ে যাচ্ছে রোজ প্রতিদিন! তাহলে কি গরিব, মধ্যবিত্তের ঘরের ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাবে না ভবিষ্যতে! কী চাইছে বলুন তো সরকার? সরকার বলছে, ভালো দিনের কথা। ভালো দিন নিশ্চয়ই চাই। কিন্তু, তার নমুনা কি এই— চারদিক জুড়ে কেবল সমস্যা আর সমস্যা! আমার এক বন্ধু বলছিলেন, একদম ঠিক। লোকে এবার জানতে চাইছে। চাইবে না? সামান্য একটা ভিটামিন সি ট্যাবেলেটের ১৫টার পাতা ছিল ১৫ টাকা। এক লাফে সেটা হয়েছে ৬০ টাকা! আর একটা কী কাশির সিরাপ শুনলাম ৩০ টাকা থেকে এক ধাক্কায় একশো! শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয় কিন্তু, গোটা দেশেই। সুতরাং, গোটা দেশের সাধারণ মানুষের ভাবনা আমাদের থেকে আজ আর আলাদা নয়। ভোটে এই ভাবনারই প্রতিফলন ঘটছে। মহারাষ্ট্র হরিয়ানাতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আসলে আজকাল মানুষ কী ভাবছে সেটা ভাবেন ক’জন নেতা? সকলে তো ধরেই নিয়েছেন— এ আমার লোক আর ও ওদের। ব্যস। হয়ে গেল। কিন্তু এই হিসেব আর বেশি মিলবে না। আমার বন্ধুটির এই মন্তব্য এককথায় উড়িয়ে দেওয়া যায় কি? বিদ্বজ্জনেরা কী বলবেন জানি না তবে সাধারণজনেরা এই কথাগুলোই রাস্তাঘাটে আলাপে আড্ডায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলছেন। তাঁরা এও বলছেন, কাশ্মীরে এত সহজে স্বচ্ছন্দে সন্ত্রাসের এমন উপদ্রবের কারণগুলো সংশ্লিষ্ট সকলে জানেন। সে সব নিয়ে বিস্তর রচনাবলি লিখিত ও পঠিত হয়েছে। নতুন করে বলার নেই। বলার যেটা তা হল— এখনও কারণগুলো যথারীতি আছে, ভূস্বর্গে সন্ত্রাসের সূচনার এত এত বছর বাদেও! এবং, তার জন্যই কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে সীমান্তের এপারে-ওপারে সারাক্ষণ একটা চাপা উত্তেজনার বাতাবরণ, গোলাগুলি সেনা কারফু বিপর্যস্ত জীবন আর একের পর এই ঘটনায় বলি হচ্ছেন সাধারণ মানুষজন! শেষ বলি বাংলার পাঁচ হতভাগ্য।
বাঙালির পুজো মরশুম প্রায় শেষ। মহামায়ার আবাহন বিসর্জন কেন্দ্র করে বাঙালির ঘরে বাইরে যে মহোৎসবের সূচনা হয়েছিল, বান ডেকেছিল আনন্দের তার রেশ এখন অনেকটাই ফিকে। এবং, গত রবিবার মা কালীর বন্দনা শেষে আর পাঁচটা বছরের মতো এবারও ছুটি ফুরনো কাজের বাঁশি বেজে উঠেছে গোটা বঙ্গে। আফিস কাছারি থেকে বাণিজ্য ফিরতে শুরু করেছে চেনা ছন্দে। কিন্তু, মুর্শিদাবাদে ওই পাঁচ হতভাগ্যের পরিবার কি সহজে ফিরতে পারবে জীবনের চেনা ছন্দে? তার চেয়েও বড় কথা, এভাবে আর কতদিন! আর কত ঘর খালি হলে কাশ্মীরে জঙ্গি যন্ত্রণা মিটবে, ভূস্বর্গ ফিরে পাবে তার মহিমা! উত্তর মেলে না। অপেক্ষার রাত শুধু বেড়ে যায়। অতঃ কিম্।