নতুন কোনও কর্ম পরিকল্পনায় সাফল্যের ইঙ্গিত। লটারি বা ফাটকায় প্রাপ্তি যোগ। খেলাধূলায় কৃতিত্ব। বাক্যে ও ... বিশদ
মোদি সরকারের সাংসারিক হালচালটা একবার দেখে নেওয়া যাক। দেশের জিডিপি নেমে গিয়েছে ৫ শতাংশে। বেকারত্বের হার গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বাধিক। ফলে কর্মসংস্থান তৈরি তো হচ্ছেই না, পাশাপাশি বাজারদর হু হু করে বাড়ছে। ২০১৪ সাল থেকে নরেন্দ্র মোদি স্বপ্ন বেচার সওদাগর। আচ্ছে দিনের স্বপ্ন দেখার ছিল সেই শুরু। নোট বাতিলে লক্ষাধিক ভারতীয়ের চাকরি যাওয়া, জিএসটি চালুর পর ছোট ছোট কোম্পানিগুলিতে তালা ঝুলে যাওয়ার পরও সেই স্বপ্ন থেকে মুখ ফেরায়নি দেশ। গত লোকসভা নির্বাচনে আরও বেশি জনসমর্থন নিয়ে ফিরে এসেছেন নরেন্দ্র মোদি। এবং নিন্দুকে বলছে, অর্থনীতির টানাপোড়েন তারপর আরও বেড়েছে। নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করতে গেলে বেসরকারি সংস্থাগুলির উপর নির্ভর করতেই হবে। মানুষের হাতে টাকার জোগান না থাকায় খুব স্বাভাবিকভাবে পণ্য বিক্রি কমেছে। অর্থাৎ চাহিদার ঘাটতি। চাহিদা না থাকলে পণ্যের সরবরাহ কমবে। কোম্পানিগুলিও উৎপাদন কমিয়ে আনবে। চাকরি যাবে আরও হাজার হাজার মানুষের। কেন্দ্রীয় সরকার তাই একটা ফাটকা খেলল... সর্বোচ্চ কর্পোরেট ট্যাক্সের হার ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে নিয়ে এল ২৫.২ শতাংশে। এর ফলে কী হতে পারে? প্রথমত, লাভের টাকা বেশি করে হাতে থাকলে উৎপাদনের দিকে ঝুঁকতে পারে সংস্থাগুলি। তেমন কিছু সত্যিই হলে কর্মসংস্থান বাড়বে। দ্বিতীয়ত, কর্পোরেট সংস্থাগুলি সরকারের তথা শাসক দলের প্রতি সদয় হবে। যার ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাবে আসন্ন সব নির্বাচনে। ভোটব্যাঙ্কের প্রসঙ্গই যদি ওঠে, তাহলে সাধারণ মানুষকে তো কিছুটা ফুল-বেলপাতা দিতেই হবে! তাই শোনা যাচ্ছে ব্যক্তিগত আয়করেও ছাড়ের কথা ভাবছে কেন্দ্রীয় সরকার। শুধু কর্পোরেট ট্যাক্সের হার ১০ শতাংশ কমিয়েই সরকারি কোষাগারে দেড় লক্ষ কোটি টাকার রাজস্ব কম আসবে। তার উপর ব্যক্তিগত আয়করেও ছাড় ঘোষণা করে দিলে রাজস্ব ঘাটতি আরও বাড়বে। অর্থনীতির আজকের বেহাল দশায় পরিকাঠামো খাতে উন্নয়নে সরকারকে আপাতত বিনিয়োগ বাড়াতেই হবে। একইসঙ্গে জোর দিতে হবে বাজারে নগদের জোগানে। গোটা পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের কোষাগার সমৃদ্ধ করা নিদারুণভাবে প্রয়োজনীয়। তাই উপায়? ওই যে... ঘটি-বাটি বিক্রি! রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার শেয়ার বিক্রি। পারলে কোপ ‘নবরত্নে’ও। অঙ্কটা অন্য জায়গায়... বেশ কিছু এমন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সরকার তালিকায় রেখেছে, যাদের শেয়ার বিক্রি করলেও তারা বেসরকারি হয়ে যাবে না। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ইন্ডিয়ান অয়েল... এখনই এই সংস্থায় সরকারের সরাসরি অংশীদারিত্ব ৫১.৫ শতাংশের নীচে। অথচ, ইন্ডিয়ান অয়েলে ওএনজিসির শেয়ার রয়েছে ১৪ শতাংশ, অয়েল ইন্ডিয়ার ৫.১৬ শতাংশ এবং এলআইসির ৬.৫ শতাংশ। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার যদি আরও ২০ শতাংশ শেয়ার ছেড়ে দেয়, তাহলেও কেন্দ্রের অংশীদারিত্ব ৫০ শতাংশের নীচে নামবে না। অর্থাৎ, ইন্ডিয়ান অয়েল একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাই থাকবে। একইভাবে রয়েছে এনটিপিসি, ভারত ইলেক্ট্রনিক্স, বিইএমএল, গেইল, ন্যাশনাল অ্যালুমিনিয়ামের মতো সংস্থা। এই প্রত্যেক ক্ষেত্রেই কেন্দ্রের শেয়ার ৬০ শতাংশের নীচে। কিন্তু অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার অংশীদারিত্ব মোদি সরকারকে আরও শেয়ার বিক্রির সুযোগ দিচ্ছে।
সম্প্রতি মোদি সরকার যে তালিকা বানিয়েছে, তাতে এমন বহু কোম্পানিই রয়েছে... ভারত পেট্রলিয়াম, নিপকো, শিপিং কর্পোরেশন, এয়ার ইন্ডিয়া, টিএইচডিসি...। লক্ষ্য, এই সংস্থাগুলির শেয়ার বিক্রি করে আগামী পাঁচ বছরে ৩.২৫ লক্ষ কোটি টাকা আদায় করা। আর ২০২০ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ১ লক্ষ কোটি ছাড়িয়ে যাওয়ার। প্রশ্ন হল, সেটাও কি সম্ভব হবে? ১৯৯১-’৯২ সালে যখন বেসরকারিকরণের রাস্তা খুলে দেওয়া হল, তখন ১০ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার শেয়ার বিক্রি করে ৫৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা আদায় ছিল প্রাথমিক টার্গেট। যদিও ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি কোষাগারে ভরতে পারেনি সরকার। প্রথম যে ৩১টি সংস্থাকে নিয়ে তালিকা তৈরি হয়েছিল, তার থেকে আয় হয়েছিল সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। এর নেপথ্যে অবশ্য অন্য অঙ্ক ছিল। অনেক সমীকরণ না মেলা অঙ্ক।
১৯৮০ থেকে ’৯০-এর দশকে উন্নত অর্থনীতির কিছু দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে বেসরকারিকরণের একটা হিড়িক দেখা গিয়েছিল। লক্ষ্য ছিল বেশ কয়েকটা... সংস্থাকে অর্থনৈতিক দিক থেকে চাঙ্গা করা, সরকারি হস্তক্ষেপ কমানো, সংস্থার লাভের পরিমাণ বাড়ানো এবং মার্কেটে মনোপলি ভেঙে সুস্থ প্রতিযোগিতার একটা পরিবেশ তৈরি। পাশাপাশি সরকারি কোষাগার আরও সমৃদ্ধ তো হবেই। আবার একটা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেসরকারি হাতে যাওয়া মানে তার শেয়ার উন্মুক্ত হয়ে গেল বাজারের জন্য। ফলে সেই কোম্পানির মার্কেট চাঙ্গা হবে। দাম বাড়বে শেয়ারের। আলোর মুখ দেখবে বাজার অর্থনীতিও। এই এতগুলো শর্ত একসঙ্গে পূরণ হয়ে গেলে দেশের অর্থনীতি চড়চড় করে আকাশ ছোঁবে। কিন্তু সেই সময়ে কিছু সমস্যা দেখা দিল। যে ভাবনা নিয়ে বেসরকারিকরণের ঘোড়া ছুটেছিল, তা আর্থ-সামাজিক পাঁকে আটকে অনেক জায়গাতেই মুখ থুবড়ে পড়ল। এবং উন্নত অর্থনীতির দেশগুলি তার থেকে শিক্ষাও নিল। কেমন শিক্ষা? আঁটঘাট বেঁধে নীতি তৈরিতে জোর দিল দেশগুলি। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার শেয়ার বিক্রির আগাম কিছু শর্ত চাপানো হল। প্রস্তাব দেওয়া হল, কোনও সংস্থার দায় ঘাড় থেকে নামিয়ে দেওয়ার আগে সরকার যেন সবদিক ভেবে কিছু নীতি নির্ধারণ করে নেয়। একটা সংস্থা যে পণ্য তৈরি করে বা যে পরিষেবা দেয়, তার সঙ্গে বহু গ্রাহক এবং কর্মীর স্বার্থ জড়িয়ে থাকে। অর্থাৎ ধরে নেওয়া যাক, একটি বিমান সংস্থা... এমন বহু ব্যক্তি থাকতেই পারেন, যাঁরা ওই সংস্থার পরিষেবা নিতেই স্বচ্ছন্দ। বেসরকারিকরণের ফলে যদি সেই পরিষেবায় আমূল পরিবর্তন ঘটে, তাহলে তার বাঁধা গ্রাহকদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হবে। যার ফল ভোগ করতে হবে সামনে থাকা বিমানকর্মীদের। যাঁদের হাল অনেক ক্ষেত্রেই আরও খারাপ দিকে যায়। প্রচুর পরিমাণে ছাঁটাই, বেতন নিয়ে সমস্যা, চাকরি পরবর্তী সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চনা... এমন অনেক কিছু। ফলে একটি সংস্থা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে বিক্রির আগে সরকার যে নীতি তৈরি করে, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে সবার আগে সরকারকে যা করতে হয় সেটা হল, কর্মী সুরক্ষার দিকে নজর দেওয়া। শেয়ার হস্তান্তরের নীতি এমনভাবে তৈরি করা প্রয়োজন, যাতে বেসরকারি হাতে গেলেও সেই সংস্থার কর্মীদের চাকরি নিয়ে কোনও অনিশ্চয়তা না তৈরি হয়। যদিও আদপে তেমন কিছু হয় না। বেসরকারিকরণের ফলে একটি সংস্থার পরিচালন দক্ষতা যেমন বাড়ে, ঠিক তেমনই কর্মীদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার একটা আবহ তৈরি হয়। সব সময় কী হবে, কী হবে একটা ব্যাপার...। আদৌ চাকরিটা থাকবে তো? মাইনে যা পেতাম, তা পাব তো?... এমন নানা প্রশ্ন আতঙ্কের আকারে ঘুরতে শুরু করে।
এ তো গেল কর্মী সমস্যা। একটি বড় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় খুব বেশি হলে কয়েক হাজার কর্মীর এই সমস্যা হবে। কিন্তু বিরাট ধাক্কা আসতে পারে বাজার অর্থনীতিতে। ধরা যাক, ভারত সরকার কোল ইন্ডিয়ার বেসরকারিকরণ করল। এবং ভারত সরকারের হাতে সেই সংস্থার ৫০ শতাংশের কম শেয়ার রয়ে গেল। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে কোল ইন্ডিয়ার উপর কেন্দ্রের আর নিয়ন্ত্রণ থাকল না। এবার বেসরকারি সংস্থাটি যদি যথেচ্ছভাবে কয়লার দাম বাড়ায়, তার সরাসরি প্রভাব পড়বে বাজার অর্থনীতির উপর। বাড়বে বিদ্যুতের দাম। আর বিদ্যুতের দাম বাড়লে যে কোনও পণ্যেরই উৎপাদন খরচ পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাবে। ফলে যে জিনিসটা আমরা হয়তো ১০ টাকায় কিনতাম, তার দাম ১৫ টাকা হয়ে যেতেই পারে। একই সমস্যা পরিষেবার ক্ষেত্রেও হতে পারে। ধরা যাক, বিএসএনএলের কথা। আপাতত এমটিএনএলের সঙ্গে সংযুক্তিকরণ ঘটিয়ে এবং প্যাকেজ দিয়ে সংস্থাটিকে বাঁচানোর চেষ্টা চলছে। এবার যদি এই সংস্থারও বেসরকারিকরণ ঘটে, পরিষেবার কিন্তু অতটাও সস্তা হবে না! ফোন এবং ইন্টারনেট পরিষেবা সংস্থাগুলি তখন নিজেদের ইচ্ছেমতো পরিষেবার জন্য দাঁ হাঁকবে। অর্থাৎ সরকারি হাতে সংস্থা থাকা মানে একটা নিয়ন্ত্রণ থাকা। পণ্য এবং পরিষেবার উপর নিয়ন্ত্রণ হাতের বাইরে চলে যাওয়া মানেই সাধারণ মানুষের উপর কোপের সম্ভাবনা প্রবল হওয়া।
দেশের অর্থনীতির এখন যা অবস্থা তাতে পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং বাজারে নগদের জোগান বাড়ানোর জন্য সরকারকে কোষাগার ভরাতেই হবে। আর তার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ ছাড়া সেই অর্থে আর কোনও রাস্তা মোদি সরকারের হাতে নেই। কোন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা? অবশ্যই লাভজনক। যে সংস্থা ধুঁকছে, তাকে বিক্রি করলে কি আর যোগ্য দাম তৈরি হবে? কখনওই না। আবার আরও একটা বিষয় দেখতে হবে। যে সংস্থা বিক্রি করার কথা ভাবা হচ্ছে, তার উৎপাদিত পণ্যের বাজার এই মুহূর্তে কেমন যাচ্ছে। যদি বিশ্ব বাজারে কয়লার দাম নিম্নগামী হয়, তাহলে কোল ইন্ডিয়ার শেয়ার বিক্রি করে মোটেই চাহিদামতো দাম পাওয়া যাবে না।
এবার রাজনীতি। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী হোক বা সাধারণ মানুষ, বেসরকারিকরণের ফলে যদি হেঁশেলে টান পড়ে, শাসক দল তার ঝাঁঝটা বুঝবে পরের ভোটে। ভারতের ভোটাররা চলতি বছরের লোকসভা ভোটেও নরেন্দ্র মোদিকে ঢেলে আশীর্বাদ করেছেন। এবার একের পর এক বিধানসভা নির্বাচন। হরিয়ানায় কেঁদে কঁকিয়ে সরকার গড়েছে বিজেপি। মহারাষ্ট্র এখনও ঝুলে। শিবসেনা সেখানে পারলেই বিজেপিকে একহাত নিচ্ছে। কাজেই বড্ড এবড়োখেবড়ো রাস্তা। বুঝে পা না ফেললেই আছাড় নিশ্চিত।