টোকিও থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস, রাশিয়া থেকে নিউজিল্যান্ড— ইসকনের কোটি কোটি ভক্ত বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা শুরু করেছেন। তাঁদের আশা, প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে শান্তি ফিরবে। রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় গ্রেপ্তার সন্ন্যাসী চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের মুক্তির দাবিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ শুরু করেছেন সংখ্যালঘুরা। তার আঁচ এসে পড়েছে এপার বাংলাতেও। চিন্ময়কৃষ্ণের নাগরিক অধিকার যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে, সে বিষয়ে দিল্লি থেকেও ঢাকাকে বার্তা দেওয়া হয়েছে। চিন্ময়ের পাশে দাঁড়িয়েছে ইসকনও। এই আবহে আজ মঙ্গলবার ফের বাংলাদেশের আদালতে শুনানির জন্য উঠবে চিন্ময়ের মামলা। জামিন কি পাবেন তিনি? গোটা দুনিয়া আপাতত তাকিয়ে রয়েছেন সেই উত্তরের অপেক্ষায়। ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল অবশ্য জানিয়ে রেখেছেন, ‘আশা করব চিন্ময়কৃষ্ণের বিরুদ্ধে অভিযোগের স্বচ্ছ এবং নিরপেক্ষ বিচার হবে। তাঁর আইনি অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকবে।’
সেই জুলাই মাস থেকেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক আন্দোলন ও শেখ হাসিনা-বিরোধী অভ্যুত্থান ভারত বিরোধিতার চড়া সুরে বাঁধা। পালাবদলের পরেই সংখ্যালঘুদের প্রতি নির্যাতন প্রবল আকার ধারণ করেছে সে দেশে। মফস্সল শহরে গ্রামে, এমনকী রাজধানী ঢাকাতেও। চট্টগ্রামে বৌদ্ধদের উপর নেমে এসেছে অমানুষিক অত্যাচার। হিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষ প্রচার চলেছে, নানা স্থানে হিন্দু মন্দির ও বিগ্রহ ভাঙা হয়েছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্য একাধিক ধর্মীয় সংগঠন ঐক্যবদ্ধ হয়ে গঠন করেছে ‘সনাতনী জাগরণ মঞ্চ’। ওই মিলিত মঞ্চের অন্যতম মুখপাত্র চিন্ময়কৃষ্ণ দাস। গত ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রামের লালদিঘির মাঠে চিন্ময়ের ডাকে একটি সমাবেশ আয়োজিত হয়। এরপর ৩০ অক্টোবর চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানায় ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা রুজু হয়। অভিযুক্তের তালিকায় রাখা হয় চিন্ময়কেও। তাঁকে গ্রেপ্তারির পরে চট্টগ্রাম পুলিস জানিয়েছে, রুদ্রপতি কেশব দাস এবং রঙ্গনাথ শ্যামসুন্দর দাস নামে আরও দুই সন্ন্যাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একইসঙ্গে প্রশাসনিক প্রশ্রয়ে বিভিন্ন প্রান্তে চলছে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার। এত দিন যা চলছিল আড়ালে আবডালে, তা একেবারে প্রকাশ্যে। ভাবুন একবার, যে মহম্মদ ইউনূস শান্তির প্রচারক হিসেবে নোবেল শান্তি পুরস্কার-ভূষিত, তাঁর নেতৃত্বেই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিপীড়নের ইতিহাস রচিত হচ্ছে। এর থেকে বড় দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে!
স্বাভাবিকভাবেই ওপার বাংলায় সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের অভিযোগে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্নের মুখে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই প্রসঙ্গে সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান জানিয়েছেন মহম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল ইসলাম। বলেছেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের ‘হস্তক্ষেপ’ পছন্দ করছে না তাঁরা। সে দেশে সংখ্যালঘুরা নিরাপদই রয়েছেন। এমন ডাহা মিথ্যাচার চালিয়ে যাওয়া এখন ইউনূস সরকারের গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। ইদানীং ভারতের নাম শুনলেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠছেন। গত কয়েক মাসে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের একের পর এক অভিযোগে দু’দেশের নাগরিকদেরও একটি বড় অংশের মধ্যে সম্পর্কে তিক্ততা বৃদ্ধি হয়েছে। মাত্রা ছাড়াতে ছাড়াতে একসময় সরকারি অ্যাটর্নি জেনারেল-এর ইসকন-কে ‘মৌলবাদী ধর্মীয় সংগঠন’ বলতেও ছাড়েননি। এই মন্তব্যে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারে যাঁরা উপবিষ্ট তাঁদের মনের গভীরের সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ মনোভাব প্রকাশ্যে এসে গিয়েছে। অথচ, এরাই একের পর এক বিবৃতি দিয়ে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়ে চলেছেন। মুখে যাই বলুন না কেন, আদৌ যে তাঁরা এই সংখ্যালঘু বিদ্বেষের প্রচ্ছন্ন সমর্থক নন, তাঁদের আচরণ সেটুকুও প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। ভারত সরকার স্বভাবতই তা নিয়ে অতি বিচলিত। আসলে মৌলবাদের চক্করে পড়ে বাংলাদেশ অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম। বাংলাদেশ তো বটেই, সমগ্র উপমহাদেশেরই সবচেয়ে বড় বিপদ মৌলবাদ। মৌলবাদীরাই ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির সংশ্রব ঘটিয়ে হিংস্র ও ধ্বংসাত্মক রাজনীতির জন্ম দেয়। যা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরুদের ক্ষেপিয়ে তোলে। একইসঙ্গে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতি যে কোনও দেশের যেকোনও সমাজের বিকাশের অন্তরায়। এটা মানুষের ঐক্য ও সম্প্রীতি ভেঙে চুরমার করে দেয়। অশান্তির আগুন জ্বালায়। শান্তি ও সুস্থিতি নষ্ট করে। বিভাজনের রাজনীতি থেকে ফায়দা তোলাই মৌলবাদীদের প্রধান লক্ষ্য। এ নিয়ে ক্রমাগত সতর্ক করে চলেছে আমাদের রাজ্যের শাসকদল। বাংলাদেশের হিন্দু নিগ্রহের ঘটনাকে সামনে রেখে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু মেরুকরণের কৌশল নিয়ে এগচ্ছে বলে সরব তৃণমূল নেতৃত্ব। তৃণমূলের অভিযোগ, বাংলাদেশের মতো পরিস্থিতি পশ্চিমবঙ্গেও হতে পারে বলে প্রচার চালাচ্ছে বিজেপি। লক্ষ্য, রাজ্যে সাম্প্রদায়িক অশান্তির বাতাবরণ তৈরি করা। বিজেপি চায়, পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু ভোটের মেরুকরণ। হিন্দু ভোটকে একজোট করা। বঙ্গ বিজেপি কি জানে, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের পাশে থাকা, আর তা নিয়ে উগ্র রাজনীতি করা যে এক বিষয় নয়, এটা এ রাজ্যের মানুষ বিলকুল বোঝেন। তাই চিন্ময়কৃষ্ণের মুক্তির দাবিতে সরব হলেও, তাঁরা বিজেপির সদস্য হতে নারাজ। পরিসংখ্যান অন্তত তাই-ই বলছে!