বেশিরভাগ মানুষের আয় রোজগার সবসময় সমান থাকে না। এরপর থাকে বাড়ি, গাড়ি, গয়না প্রভৃতি ক্রয় এবং সন্তানের উচ্চশিক্ষা, ভ্রমণ প্রভৃতির মতো কিছু বড় বাজেটের খরচাপাতি। সর্বোপরি অবসর জীবনে নিয়মিত আয় শূন্য হলেও খরচের প্রয়োজন ও অভ্যাস বহাল থাকে, বরং চিকিৎসার খরচ বেড়ে যায়। ফলে সচেতন গৃহস্থকে কিছু সঞ্চয় করতেই হয়। মানুষ সেখানেই কষ্টার্জিত টাকা সঞ্চয় করতে চায়, যেখানে তার ভালো বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। কারণ মুদ্রাস্ফীতির অভিঘাতে আজকের সঞ্চয়ের বাস্তব মূল্য পরে হ্রাস পায়। আজ এক হাজার টাকায় কোনও একটা জিনিস যে পরিমাণ কেনা সম্ভব পাঁচ বছর বাদে তা কিনতে দ্বিগুণ অর্থ খরচ করতে হতে পারে। কিন্তু ব্যাঙ্ক, ডাকঘর এবং অন্য এনবিএফসিতে টাকা জমিয়ে শীঘ্রই ‘ডাবল’ পাওয়া আর সম্ভব নয়। অন্যদিকে গৃহঋণ এবং গাড়ির ঋণ দামি হলেও সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের উপর সুদের হার দীর্ঘদিন যাবৎই বেশ কম এবং ‘অনড়’। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষকে সবচেয়ে হতাশ করেছে পিপিএফ। ফলে বহু মানুষ একটু বেশি সুদ বা লাভের আশায় চিটফান্ডওয়ালাদের ফাঁদে পা দিয়ে ফেলে। তাদের বেশিরভাগেরই অবস্থান সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণিতে। অন্যদিকে, একটু লেখাপড়া জানা মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকে এখন ঝুঁকেন শেয়ার বাজার কিংবা মিউচুয়াল ফান্ডের দিকে। এই ব্যবস্থা দুটি আইনসিদ্ধ। সেবি ও আরবিআইয়ের মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থারও নজরদারি রয়েছে তাদের উপর। তবু এই দুই ক্ষেত্রে সঞ্চয় সবসময়ই ঝুঁকিসাপেক্ষ। তিন ধরনের ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে শেয়ার বাজার এবং মিউচুয়াল ফান্ডে টাকা খাটাতে হয়। 
তবে কোনও মারাত্মক কেলেঙ্কারি ছাড়া বাজার সাধারণভাবে দীর্ঘকালের জন্য ধসে পড়ে না। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ওঠাপড়ার প্রেক্ষিতে এই দুই ক্ষেত্রে মাঝেমধ্যে যে ‘পতন’ ঘটে, তা স্বাভাবিক। তখন বিনিয়োগকারী ধৈর্য ধরতে পারলে অল্প দিনেই ‘কারেকশন’-এর সুবিধাও পেতে পারেন। কিন্তু এই আর্থিক বাজারকে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিতে পারে কিছু অসাধু দালাল। আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার নেশায় তারা বাজারের উপর কৃত্রিম প্রভাব বিস্তার করে। নিয়মকানুনে কিছু ফাঁক থেকেই যায়, অসাধু কারবারিরা ঢুকে পড়ে সেখান দিয়ে। তারা কোনও কোনও ব্যাঙ্ককে ম্যানেজ করে ‘রেডি-ফরওয়ার্ড ডিল’ বা আরএফ-এর সুযোগ নেয় এবং ‘সার্কুলার ট্রেডিং’ টেকনিক প্রয়োগ করে। সংশ্লিষ্ট দালালরা গভর্নমেন্ট সিকিউরিটিজ বেচে দিয়ে নতুন করে কেনে, তাতে চক্রের সঙ্গে জড়িত পার্টিদের মধ্যে একটা বিপুল অঙ্কের ‘রেডি ক্যাশ ফ্লো’ তৈরি হয়। শেয়ারের দাম এবং বণ্টন ব্যবস্থাও উল্টেপাল্টে দিতে ওস্তাদ এই কীর্তিমানরা। বিভিন্ন কোম্পানির আইপিও নিয়ে অনাসৃষ্টি কারবার ফাঁদে এই ব্রোকার বাহিনী! তাদের এই ‘খেলা’ শেষ হওয়ার পর চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষ। শেয়ার মার্কেট স্ক্যাম যত ছোটই হোক না কেন, তাতে অভ্যন্তরীণ (ডিআইআই) তো বটেই, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের লগ্নিকারীদেরও (এফআইআই) আস্থা টলে যেতে পারে। আর্থিক বাজার এমন ধরনের অস্থিরতায় গ্রস্ত হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয় উন্নয়নশীল দেশগুলি, সেখানে ১৪৪ কোটি মানুষের ভারতের পরিণতি কী হতে পারে তা অনুমেয়। ভারত সাম্প্রতিক অতীতে অন্তত ছয়টি সুবৃহৎ শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারির সাক্ষী—হর্ষদ মেহতা, সিআরবি, ইউটিআই, সত্যম, সাহারা এবং এনএসই কোলোকেশন স্ক্যাম। ১৯৯২ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে সংঘটিত এই স্ক্যামগুলিতে সাধারণ ভারতবাসীর হাজার হাজার কোটি টাকা ‘হাওয়া’ হয়ে গিয়েছে। 
অতএব বিষয়টি কতটা স্পর্শকাতর তা বোঝাই যায়। এর মধ্যে অন্তত রাজনীতির কারবারি, বিশেষ করে দায়িত্বশীল নেতা-মন্ত্রীদের নাক গলানোই উচিত নয়। কারণ তাঁদের কথা শুনে মানুষ ফের প্রতারণার শিকার কিংবা অন্যভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হলে তার দায় তাঁরা নেবেন কি? এ দেশের রাজনীতিকদের বেশিরভাগের অতীত রেকর্ডের ভিত্তিতে হলফ করে বলা যায়, তখন চোখ উল্টেই দেবেন তাঁরা। এই প্রসঙ্গেই নিন্দা করতে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে। তাঁরা প্রকাশ্য জনসভা থেকে মানুষকে প্ররোচনা দিচ্ছেন এখনই শেয়ার বাজারে বেশি টাকা বিনিয়োগ করার জন্য! কেন? তাঁরা নাকি ‘হ্যাটট্রিক’ করতে চলেছেন। ৪ জুনের ফলাফলেই তা পরিষ্কার হয়ে যাবে, আর অমনি রকেট গতি নেবে শেয়ার বাজারের সূচক! এমন উস্কানি—কোনও অসাধু ব্রোকারই দিতে পারে, দেশনেতাসুলভ কোনোভাবেই নয়।