অধিকার আসলে কী? জীবনধারণের ন্যূনতম চাহিদা মেটাতে সকলের জন্য অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-পানীয় জলের ব্যবস্থা করবে রাষ্ট্র। প্রাথমিক শিক্ষার আলো পৌঁছে যাবে দেশের প্রতিটি কোণে ঘরে ঘরে। সংবিধানই মৌলিক অধিকারের কথা বলেছে। কিন্তু এসব না পেয়ে ধীরে লয়ে কত শত জীবন গিয়েছে চলে....। স্বাধীনতার সাত দশক পরে এখনও এই ন্যূনতম চাহিদাগুলোই ফাঁপা প্রতিশ্রুতি হয়ে সরকারের ‘অগ্রাধিকারের’ তালিকায় থেকে যাচ্ছে! করোনার কোনও ইতিহাস নেই। ঝড়ের গতিতে এসে সে সব তছনছ করে দিচ্ছে। মৃত্যু এখানে ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ড ধরে আসছে। রোগের সংক্রমণ ছড়াচ্ছে আলোর গতিতে। এখন আর রোটি-কাপড়া-মকান নয়, এই অসমযুদ্ধে বেঁচে থাকার ন্যূনতম চাহিদা হয়ে দেখা দিয়েছে টিকা-অক্সিজেন-ওষুধ। কোভিডের প্রবল গতির ঝড় সামলে দেশের সরকারের কাছে বাঁচার রসদ জোগানোর আর্জি জানিয়ে চলেছে বিভিন্ন রাজ্য সরকার। বাংলার সরকার দেশব্যাপী গণ টিকাকরণের আর্জি জানিয়েছে। দেশের এই বিজেপি সরকার তো সব ক্ষমতাই কেন্দ্রীভূত করতে চায়। এক দেশ এক রেশন কার্ড চালু করতেও তারা বদ্ধপরিকর। তাহলে কেন জরুরি পরিস্থিতিতে অভিন্ন টিকানীতি থাকবে না? প্রশ্ন সেখানেই। তাই নেহাতই বাধ্য হয়ে দেশজুড়ে অভিন্ন টিকাকরণ নীতি প্রণয়ের জন্য হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে বাংলার সরকার। বিনামূল্যে সব ভারতবাসীর জন্য টিকাকরণ নিশ্চিত করার দায়িত্ব তো কেন্দ্রেরই। কিন্তু সেই দায়িত্ব তারা যথাযথভাবে পালন না করায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বৈষম্যের অভিযোগও উঠছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার বলেছেন, কোভিড মোকাবিলা ও চিকিৎসায় জরুরি টিকা, অক্সিজেন ছাড়াও রেমডিসিভির, তোসিলিজুমাব ইত্যাদি ওষুধ ইঞ্জেকশন সরবরাহ ঠিক মতো হচ্ছে না। তাঁর অভিযোগের সারবত্তা কেন্দ্রীয় সরকারের পাঠানো এক অভ্যন্তরীণ নোটেই প্রমাণিত। বৈষম্যের নজির গড়ছে কেন্দ্রের মোদি সরকার। সেক্ষেত্রেও লাজলজ্জার বালাই নেই। অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর বাংলার নাম ‘অ্যাডিশনাল অ্যালোকেশন বা অতিরিক্ত বরাদ্দের জায়গায় ঠাঁই পেলেও দেখা যাচ্ছে উত্তরপ্রদেশ কর্ণাটকের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্য যথাক্রমে ৮৭০ এবং ৮৫৫ ভায়াল তোসিলিজুমাব পেয়েছে আর বাংলার ভাগ্যে জুটেছে মাত্র ২৮৫ ভায়াল! করোনা সঙ্কটে মানুষের প্রাণ বাঁচাতে অবশ্য দেশের বিভিন্ন আদালত একের পর এক নির্দেশ দিচ্ছে কেন্দ্রকে। অক্সিজেন ইস্যুতে এক মামলায় সুপ্রিম কোর্টে হেরেও গেছে মোদি সরকার। হচ্ছে ভর্ৎসনা, খাচ্ছে ধমকও। কিন্তু তিনি? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নীরব। মুখ্যমন্ত্রীদের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে তিনি তাঁর নিজের মনের কথা শোনাতেই ব্যস্ত। এই হল তাঁর রাজধর্ম!
তথ্যে প্রকাশ, শুক্রবার পর্যন্ত দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ২ কোটি ১৫ লক্ষের কাছাকাছি। আর মৃত্যু হাজারে হাজারে। এবারও আগাম প্রস্তুতি না থাকায় কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্ত দিল্লি থেকে বিভিন্ন রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো। অথচ জাতীয় বিপর্যয়ের সময়ে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ঢেলে সাজার দায় কেন্দ্রেরই। সে দায়িত্ব তারা পালন করেনি। তাই আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পর্যাপ্ত বেড নেই। বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার মতো অক্সিজেন নেই। সংক্রমণের সঙ্গে যুঝতে প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ নেই। সংক্রমণ ঠেকাতে প্রতিষেধক টিকাও অপ্রতুল। এমনকী মৃত্যুর পর শ্মশানে দাহ করার জায়গাও বাড়ন্ত। করোনার আতঙ্কে গোটা দেশ সিঁটিয়ে গেছে। আর্তনাদ আর নেই নেই হাহাকার দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে ফিরে আসছে। তবু নির্বিকার কেন্দ্রীয় সরকার! দেশের এমন ভয়াবহ দুর্যোগেও তাদের অগ্রাধিকার দিল্লিতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সেন্ট্রাল ভিস্তা, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন নির্মাণের কাজ সময়ে শেষ করা। এই হল ‘জনকল্যাণকামী’ সরকারের কাজের নমুনা!
এসব দেখেশুনে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে মোদি-শাহদের কাছে জীবনের মূল্য কতটা? একজন আক্রান্ত স্রেফ অক্সিজেন না পেয়ে মারা যাবেন? একজন অসুস্থর ওষুধ না পেয়ে, হাসপাতালে বেড না পেয়ে জীবনে দাঁড়ি পড়ে যাবে? প্রধানমন্ত্রী দেশমাতার কথা বলেন, নিজেকে দেশমাতার সন্তান বলে গর্বের ঘোষণা করেন, কিন্তু যাঁরা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা পাচ্ছেন না, যাঁরা মৃত্যু পথযাত্রী—তাঁরাও তো এই দেশমায়েরই সন্তান। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো ভিভিআইদের শারীরিক সমস্যা হলে কি তাঁদেরও অক্সিজেন, বেড, ওষুধ টিকার সমস্যা হবে? উত্তরটা অবশ্যই জানা। তাহলে ভাগ্যবান কারা? ক্ষমতাবানরাই নয় কি? আর দেশের আমজনতা ভাগ্যহীন। মৃত্যুর হাতছানি যাদের শিয়রে কড়া নাড়ে অহরহ। অথচ পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে যত টাকা খরচ করল গেরুয়া বাহিনী তা দিয়ে ভ্যাকসিন কেনা যেত, সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রজেক্টের ৩০ হাজার কোটি টাকায় অনায়াসে সব রাজ্যে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পাঠানো যেত। নির্বাচন প্রচারে নিরাপত্তারক্ষী ও পারিষদবর্গ নিয়ে উড়ান সফরে যে অর্থ খরচ করেছেন মোদি-শাহরা তাই দিয়ে করোনার ওষুধও কেনা যেত। এসব কিছুই হয়নি। কারণ, কেন্দ্রের অগ্রাধিকারের তালিকায় যে করোনা মোকাবিলা ছিল না।