শরীর-স্বাস্থ্যের আকস্মিক অবনতি। বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ আসতে পারে। সম্পত্তি নিয়ে পারিবারিক বিবাদ। ব্যবসায় নতুন সুযোগ ... বিশদ
এবারের নির্বাচনের মূল লড়াইটি হয়েছে অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য প্রস্তাবিত দু’টি নীতির মধ্যে। একটি দরিদ্রবান্ধব পেরোনিস্ট নীতি, প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিনা ফার্নান্দেজ ডি কির্চনারকে রানিং-মেট হিসেবে নিয়ে যার নেতৃত্বে আলবার্তো ফার্নান্দেজ। আর অন্য পক্ষে ব্যবসায়ীবান্ধব মুক্তবাজার নীতি নিয়ে ছিলেন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট মরিসিও মাক্রি। বিশ্বখ্যাত নাচ ‘ট্যাঙ্গো’র জন্মভূমি এই সেই আর্জেন্টিনা। গত শতকের একই সময়ে যে দেশ ছিল বিশ্বের প্রথম দশ অর্থনৈতিক শক্তির একটি, সে দেশের অর্থনীতিই এখন তলানিতে। গত দুই দশক ধরে এই ফুটবল ও ট্যাঙ্গোর দেশেই অর্থনীতিতে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে, যা ২০০১ সালে মাত্র ১০ দিনে পাঁচজন প্রেসিডেন্ট উপহার দিয়েছিল আর্জেন্টিনাকে।
শুরু থেকেই এবারের নির্বাচনে এগিয়ে ছিল পেরোনিস্টরাই। এই পেরোনিস্ট আবার কী? এও এক রাজনৈতিক তত্ত্ব, যা একান্তই আর্জেন্টাইন। হুয়ান ডোমিঙ্গো পেরোনকে মনে আছে? প্রাক্তন এই জেনারেল ১৯৪৬ সালে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি ও তাঁর স্ত্রী ইভা পেরোন ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন মানুষের মধ্যে। পরপর দুই মেয়াদে নির্বাচিত হন পেরোন। ১৯৫৫ সালে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা হারানোর আগে পর্যন্ত টানা ন’বছর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। পরে ১৯৭৩ সালে আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত এই হুয়ান ডোমিঙ্গো পেরোনের নির্দেশিত রাজনৈতিক পথই মূলত পেরোনিজম নামে পরিচিত। যা পুঁজিতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র থেকে সমান দূরত্ব রেখে চলার নীতি অনুসরণ করে। বুঝতে সমস্যা হয় না যে, স্নায়ুযুদ্ধের সময় ধীরে ধীরে আকার পাওয়া এই পথ মূলত সবদিকে ভারসাম্য রেখে চলার নীতি অনুসরণ করেছিল।
পেরোনিজমের কথা আসছে, কারণ এবারের নির্বাচনে এই পেরোনিজমের পুনরুত্থানের ঘটনাই ঘটেছে। বুয়েন্স আইরেসের ত্রেস ডি ফেব্রেরো এলাকায় গেলে অন্তত তেমনটাই মনে হবে। যে এলাকার নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি যুদ্ধ। ১৮৫২ সালের দিকে এই জায়গাতেই হয়েছিল এক যুদ্ধ, যার বিজয়ী জেনারেল জাস্তো হোসে উরকুইজা পরে আর্জেন্টিনার ফেডারেল সংবিধান অনুমোদন করেন। আর্জেন্টিনার ভাগ্য নির্ধারণে এই অঞ্চলের গুরুত্ব এখনও অনেক। কারণ, বলা হয় কোনও নির্বাচনে এই অঞ্চল থেকে যিনি বিজয়ী হন, তিনি জাতীয় নির্বাচনেও বিজয়ী হন। আর এবার এই অঞ্চলের ভোটারদের অধিকাংশের মধ্যে বর্তমান প্রেসিডেন্ট মরিসিও মাক্রির প্রতি ক্ষোভ দেখা গিয়েছিল। প্রতিশ্রুতি মতো অর্থনৈতিক সংস্কারে ব্যর্থতাই এই বিরাগের কারণ। আর এই ব্যর্থতাকেই নিজের প্রচারের মুখ্য অস্ত্র করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী আলবার্তো ফার্নান্দেজ, যিনি একজন পেরোনিস্ট।
২০১৫ সালে ত্রেস ডি ফেব্রেরোর ভোটাররা মাক্রিকে ভোট দিয়েছিলেন, যার মাধ্যমে তিনি আর্জেন্টিনাকে ১৪ বছরের পেরোনিস্ট শাসন থেকে বের করে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর দেশকে অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে বের করতে পারেননি। যে পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন, তা ব্যর্থ হয়েছে পুরোপুরি। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, আর্জেন্টিনার অর্থনীতি এক অনিঃশেষ মন্দার মধ্য দিয়ে চলছে। দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতির হার ৫০ শতাংশের বেশি। অবস্থা এতটাই সঙ্গীন যে, আইএমএফ-এর কাছ থেকে আর্জেন্টিনাকে ৫ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের অনুদান নিতে হয়েছে। দেশে বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ৩৫.৪ শতাংশ, যা গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এই অবস্থায় আর্জেন্টিনার ভোটাররা আবারও পেরোনিজমের দিকেই ঝুঁকতে বাধ্য হয়েছে। শুধু ত্রেস ডি ফেব্রেরো নয়, পুরো আর্জেন্টিনাতেই পেরোনিস্টরাই এগিয়ে।
পেরোনিস্টদের উত্থানে মূলত শঙ্কায় পড়েছে আর্জেন্টিনার আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও মধ্যবিত্তরা। তাদের ভয় আলবার্তোকে নিয়ে নয়, বরং তাঁর রানিংমেট ক্রিস্টিনা ডি কির্চনারকে নিয়ে। যিনি মাক্রির আগে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ক্রিস্টিনাকেই মূলত আর্জেন্টিনার বর্তমান অর্থনৈতিক দৈন্যের কারণ হিসেবে দেখা হয়। আট বছর প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তিনি দেশের কল্যাণ মূলক কাজের পরিসর ভীষণভাবে বাড়িয়েছিলেন। বাড়িয়েছিলেন ভর্তুকি ও সরকারি চাকরির পরিসর। সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির বিপরীতে তিনি আয়ের পথ সন্ধান দিতে পারেননি। ফলে দীর্ঘ মেয়াদে দেশটি এক ভয়াবহ সঙ্কটের আবর্তে পড়ে। ক্রিস্টিনা যখন মাক্রির কাছে ক্ষমতা ছাড়েন, তখন আর্জেন্টিনার উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও মোট জিডিপি প্রায় ৬ শতাংশ ঘাটতি নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে চলছে। এই দুর্গতি থেকে উদ্ধার করতে না পারাতেই এখন আবার মাক্রির উপর ক্ষুব্ধ হয়ে পেরোনিস্ট ধারার দিকে ঝুঁকেছে দেশটি। তাছাড়া ক্রিস্টিনা ফার্নান্দেজের বিরুদ্ধে ছ’টি দুর্নীতি মামলা চলছে। কিন্তু সিনেটর হওয়ার কারণে তাঁকে জেলে থাকতে হয়নি। ফলে মানুষের মধ্যে এই ধারণা স্বাভাবিক যে, ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তিনি রেহাই পেয়ে যাবেন।
ক্রিস্টিনা ফার্নান্দেজ নিজে একজন পেরোনিস্ট হলেও তাঁর মূল ঝোঁক অতি বামপন্থার দিকে। আর এটিকেই তাঁর ব্যর্থতার মূল কারণ হিসেবে দেখেন তাঁর সমালোচকেরা। আর্থিক ক্ষেত্রের উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রবণতাকে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখা হয়। ক্রিস্টিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে লা ক্যাম্পোরার, যা আর্জেন্টিনার সবচেয়ে শক্তিশালী বামপন্থী সংগঠন। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আবার তাঁরই ছেলে ম্যাক্সিমো কির্চনার। আলবার্তোর সমর্থকদের মধ্যে যতটা সংশয় ছিল, তা এই ক্রিস্টিনার কারণেই। অনেকেই মনে করছেন, আলবার্তোকে সামনে রেখে ক্রিস্টিনাই আসলে শাসকের চেয়ারটিতে বসলেন। আলবার্তো ফার্নান্দেজের সামনে এখন নিজের পরিচয়টি তুলে ধরাই এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি একদিকে মাক্রির ‘নয়া–উদারবাদি’ পথের সমালোচনা করছেন, অন্যদিকে ‘নিজে ক্রিস্টিনার মতো নন’—এ কথাও তাঁকে বলতে হয়েছে। তিনি মূলত ঐক্যের ডাক দিচ্ছেন। নিজেদের জোটের নামও দিয়েছেন ফ্রেন্টে ডি টোডোস (ফ্রন্ট ফর অল)। এ ক্ষেত্রে অবশ্য তাঁর ‘লড়াই নয়, আলোচনায় বিশ্বাসী’ ভাবমূর্তিটি কিছুটা সহায় হয়েছে।
আলবার্তো ফার্নান্দেজ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আর্জেন্টিনার অর্থনীতিকে তিনি সবল করবেন। বলেছেন, তিনি ব্যর্থ হবেন না। কিন্তু তারপরও সংশয় কাটছে না। কারণ, এই ভোটের দিনই দেখা মিলেছে মার্টিনের মতো ব্যক্তিদের, যারা নগদ অর্থ নিয়ে ছুটছেন ডলারে বদলে নেবেন বলে। ৫০ বছর বয়সি চলচ্চিত্র নির্মাতা মার্টিনের সোজা কথা, তিনি ফার্নান্দেজকে বিশ্বাস করেন না। শুধু মার্টিন নন, এএফপি জানাচ্ছে, প্রাথমিক নির্বাচনে আলবার্তো ফার্নান্দেজ বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে প্রার্থী হওয়ার পরপরই আর্জেন্টাইনরা নিজেদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্তত ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার তুলে নিয়েছেন। ফলে নিঃসন্দেহে নয়া প্রেসিডেন্টের সামনে এক কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। মেসি–মারাদোনার দেশের ভবিষ্যৎ কোন পথে, কেউ জানে না।