শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে উন্নতির সম্ভাবনা। গুপ্ত শত্রুতার মোকাবিলায় সতর্কতা প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষায় বিলম্বিত ... বিশদ
ড. শঙ্কর ঘোষ।
সামনেই দুর্গাপুজো। ফি বছর মা আসেন পতিগৃহ থেকে পিতৃগৃহে। তেমনই একবার দুর্গা মর্তে আসার প্রাক্কালে পতিদেব মহাদেবের কাছে আর্জি জানালেন যে তিনি মর্তবাসীর দুঃখ-দুর্দশা সইতে পারছেন না। মহাদেব এমন কিছু করুন যাতে মর্তের লোকেদের দুর্গতি দূর হয়। দুর্গার মন রাখতে মহাদেব মর্তবাসীর জন্য একটি গোলক প্রেরণ করলেন, যেটি সোনা দিয়ে গড়া। তবে এতে মুশকিলও আছে। যে এই গোলকটি পাবে, সে যখন অন্য কাউকে সেই গোলকটি দেবে, তৎক্ষণাৎ এই দু’জনের চিত্ত পরিবর্তিত হবে। দুর্গা শুনে বললেন এ তো ভয়ঙ্কর ব্যাপার। মহাদেব আশ্বস্ত করে বললেন এই চিত্ত পরিবর্তন সাময়িক। ঘটনাচক্রে জমিদার নীলরতনবাবুর জামাই তস্য চাকরকে নিয়ে পুজোর ছুটিতে জমিদারবাড়িতে আসার পথে, সেই গোলকটি ভৃত্যের নজরে আসে। গোলকটি তুলে জমিদার জামাইয়ের হাতে তুলে দেওয়া মাত্র ওই দুটি মানুষের চিত্ত পরিবর্তিত হয়। ভৃত্যটি তখন নিজেকে ভাবে জামাই আর জামাই ভাবে সে যেন ভৃত্য। এই অবস্থায় এরা জমিদার বাড়িতে এলে সকলেই ধন্ধে পড়ে যায়। কে জামাই কে ভৃত্য। ইতিমধ্যে কোন ফাঁকে সেই গোলকটি জমিদারবাবুর বাড়ির মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে। সেটি নজরে আসে জমিদার বাড়ির ঝি তরলার। তরলা তা তুলে দেয় জমিদার নীলরতন বাবুর হাতে। ব্যস। জমিদার তখন নিজেকে ভেবে নেন তিনি এ বাড়ির ঝি। আর ঝি তরলা মনে করতে থাকে সে হল জমিদার। জমিদার ও ঝিয়ের চিত্ত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নাটকটির ইন্টারভ্যাল। যে নাটকের কথা বলছিলাম, তার নাম ‘সুবর্ণ গোলক’। কাহিনীকার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। নাট্যরূপ দেন সন্তোষ সেন। রঙমহল থিয়েটারে (৬৫/১ বিধান সরণী) এই নাটকের যাত্রা শুরু ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। দমফাটা হাসির নাটকের মূল স্থপতি জহর রায়। তিনি এ নাটকে জমিদার নীলরতনবাবু। ইন্টারভ্যালের দৃশ্যটিতে তিনি যেভাবে ধুতির কোঁচা খুলে ঘোমটা
দিয়ে বাড়ির পরিচারিকা হয়ে যান, সে অভিনয় যিনি একবার দেখেছেন তাঁর পক্ষে বিস্মৃত হওয়া দুঃসাধ্য। ইন্টারভ্যালের পর সমস্ত স্টেজ জুড়ে জহর রায় যে ধুন্ধুমার কাণ্ড করলেন, দর্শকদের পক্ষে সিটে বসে থাকাই দুরূহ হয়ে ওঠে। পুরো প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে, শুধু হাসির বন্যা বয়ে যাচ্ছে। এই কাহিনী নিয়েই মানু সেনের পরিচালনায় ‘সুবর্ণ গোলক’ সিনেমা তৈরি হয়েছিল। সেখানে নীলরতনবাবু হয়েছিলেন সবার প্রিয় উৎপল দত্ত। কিন্তু সবিনয়ে জানাই যাঁরা জহর রায়ের নীলরতন দেখেছেন তাঁরা এ তুলনার মধ্যে যাবেনই না। রঙমহলের টিকিট কাউন্টারের মাথায় পোস্টার লাগিয়ে ঘোষণা করা হয়েছিল, এ নাটক দেখতে বসে যিনি না হেসে থাকতে পারবেন, তাঁকে পুরস্কৃত করা হবে। বলাবাহুল্য সে পুরস্কার কারও ভাগ্যেই জোটেনি।
জহর রায়ের নাটকের প্রতি ভালোবাসা একেবাবে ছোটবেলা থেকে। প্রবাসী পিতার চাকরির সূত্রে পুত্র জহর যখন পাটনায় রয়েছেন, সেই সময়ে পাটনার প্রবীণ হাস্যকৌতুক শিল্পী অজিত চট্টোপাধ্যায় আমন্ত্রিত শিল্পী হিসাবে গেলে, তাঁর সঙ্গে জহর রায় পরিচিত হন। অজিতবাবুই তখন জহর রায়কে কলকাতায় নিয়ে আসেন এবং রঙমহল থিয়েটারে যুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দেন। সালটি ছিল ১৯৫৪। সেই থেকে ১৯৭৭ সালের ১ আগস্ট জহর রায় মারা যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই রঙমহল থিয়েটারের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন। মঞ্চ বদল করেননি। শেষ অভিনীত নাটক ‘অপরিচিত’। তিনি নাটকটির পরিচালক এবং ভুজঙ্গ রায় চরিত্রের অভিনেতাও বটে। রঙমহলের ওপর বয়ে যাওয়া ঝড় ঝাপটা তিনি সামলেছেন বারে বারে। রঙমহলে তাঁর প্রথম মঞ্চাভিনয় ‘দূরভাষিণী’ নাটকে নকুলের চরিত্রে। তিনি যখন যোগ দিলেন তখন সবেমাত্র রঙমহলের মালিকানা পরিবর্তিত হয়েছে। ‘প্রাচী’ সিনেমার মালিক জীতেন বোস এবং ‘জ্যোতি’ সিনেমার মালিক ভিটল ভাই মানসাটা রঙমহলের দায়িত্ব নিলেন। পরপর কয়েকটি নাটকে জহর রায় অভিনয় করলেন এই মঞ্চে। যার মধ্যে রয়েছে শেষ লগ্ন (গোবিন্দ), কবি (বিপ্রপদ), মায়ামৃগ (শ্যামাপদ), এক মুঠো আকাশ (রঘু), সাহেব বিবি গোলাম (বিধু সরকার) প্রভৃতি।
১৯৬২ সালে রঙমহলে আবার সংকট ঘনিয়ে আসে। থিয়েটার হলের দুই মালিক জীতেন বোস আর ভিটল ভাই মানসাটা ঠিক করলেন রঙমহল থিয়েটার বন্ধ করে সেখানে সিনেমা হল চালু করবেন। একথা জানতে পেরে রঙমহলের শিল্পী ও কর্মীবৃন্দ ধর্মঘট শুরু করেন এবং মালিকপক্ষের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে মুখর হন। থিয়েটারের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন অজিত চট্টোপাধ্যায়, জহর রায় এবং সরযূবালা দেবী। শেষ পর্যন্ত ড. প্রতাপচন্দ্র চন্দ্রের মধ্যস্থতায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় উভয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেন। ডাঃ রায়ের উদ্যোগেই রঙমহল থিয়েটারটিকে শিল্পী কলাকুশলী ও কর্মীদের হাতেই পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সমবায় ভিত্তিতে এরপর রঙমহল থিয়েটার পরিচালিত হতে থাকে। জহর রায় সমবায় ভিত্তিক (Co-operative) থিয়েটারের তরফে পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, সঙ্গে অভিনেত্রী সরযূবালা দেবী। বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে এ এক অত্যন্ত স্মরণীয় ঘটনা। ড. দর্শন চৌধুরী জানাচ্ছেন, ‘মালিকানা ভিত্তিক সাধারণ রঙ্গালয়ের ইতিহাসে এই প্রথম একটি রঙ্গালয় সমবায় প্রথায় পরিচালিত হতে থাকে, শিল্পী-কলাকুশলী-কর্মীরা যার সদস্য।’
সমবায় প্রথায় প্রথম যে নাটকটি অভিনীত হল তাঁর নাম ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’। জহর রায় অভিনয় করলেন মতি চাকরের। সমবায় প্রথায় পরিচালিত রঙমহল থিয়েটারে পরপর সফলভাবে নাটক অভিনীত হতে থাকল। প্রায় প্রতিটি নাটক দর্শক আনুকূল্য লাভে ধন্য হল। জহর রায় গুরুত্ব দিলেন হাস্যরস প্রধান নাটকে। যার মূল কাণ্ডারী তিনি নিজেই। সব রেকর্ড ভাঙল ‘আমি মন্ত্রী হব’ নাটকটি। এর যাত্রা শুরু ১৯৬৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। নাট্যকার সুনীল চক্রবর্তী। পরিচালক জহর রায়। তখন সারা ভারত জুড়েই চলেছে আয়ারাম গয়ারামদের রাজ, যাঁরা মন্ত্রী হওয়ার লোভে দল বদল করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেন না। তেমনই এক চরিত্র যদু দত্ত, যিনি ভোটে দাঁড়াতে চলেছেন স্রেফ মন্ত্রী হবেন বলে এবং দু’হাতে টাকা লুটবেন বলে। সেই চরিত্রের শিল্পী
জহর রায়। সহজেই অনুমেয় যে মঞ্চ জুড়ে যদু দত্ত কী কী কাণ্ডই না ঘটাবেন। তার দু-একটি নমুনা তুলে ধরি। বক্তৃতা তৈরি করতে বসে বলেন, ‘আমি কোনও রাম-শ্যাম-যদু-মধু নই যে আজ এ দলে, কাল ও দলে নাম লেখাব।’ তারপর নিজেই ঢোক গিলে বললেন ‘আ! আমার নামের মধ্যেই তো যদু ঢুকে বসে আছে।’ যদু দত্তের পোলিং এজেন্ট পতিতপাবন হয়েছেন হরিধন মুখোপাধ্যায়। তিনি এসে যদুকে বললেন, ‘স্যার ওই নতুন বাড়ির টয়লেট আপনাকে উদ্বোধন করতে যেতে হবে।’ শুনেই যদু বলেন, ‘আমি যাব টয়লেট উদ্বোধন করতে বল কি পতিতপাবন?’
পতিতপাবন আশ্বস্ত করে বললেন, ‘ওই বাড়িতে চল্লিশজন ভোটার আছে।’ এবারে সম্মতি মিলল যদু দত্তের ‘অতগুলি ভোটার, তবে তো আমি যাবই টয়লেট উদ্বোধন করতে।’ যাওয়ার প্রস্তুতির সময় ড্রাইভারকে ডেকে ডেকে হন্যে হয়ে যাওয়ার পর ড্রাইভার আসামাত্র খেঁকিয়ে বলে ওঠেন, ‘তোকে জুতো মেরে মেরে লম্বা করে দেব’। ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে দেখেন ড্রাইভার এমনিতেই ছ-ফুটের ওপর লম্বা। অগত্যা নিজের কথা নিজেই ফিরিয়ে নেন, ‘তেকে আর জুতিয়ে কাজ নেই’। বক্তৃতা মঞ্চে নির্দ্বিধায় যদু দত্ত বলতে পারেন, ‘রবীন্দ্রনাথ সাধে কি আমাদের বলেছিলেন হে ভারত তুলিও না দরিদ্র ভারতবাসী আমার ভাই, মূর্খ ভারতবাসী আমার ভাই’, দশর্কদের মধ্যে থেকে গুঞ্জন উঠলে, পতিতপাবন যদু দত্তকে সাংশোধন করাতে উঠলে যদু দত্ত বলেন, ‘আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ সবাই এক।’ এমন ভোট প্রার্থীর কী দশা হবে তা দর্শকেরা উপভোগ করেছেন চূড়ান্তভাবে। নাটকের মধ্যে সংলাপ বদল হামেশাই তিনি করতেন। শুনলেন কোনও নেতা হয়তো এ নাটক দেখতে এসেছেন; তখন যদু দত্তের বক্তৃতার মধ্যে এই সংলাপ ঢুকিয়ে দিতেন; ‘একটু বৃষ্টিতে প্রচণ্ড জল দাঁড়িয়ে গেলে আপনারা ভাববেন না, আমি রাস্তায় রাস্তায় নৌকোর ব্যবস্থা করে দেব’। দর্শকদের সঙ্গে নেতাও যে এটি উপভোগ করেছেন তাতে সন্দেহ নেই।
এল নতুন নাটক ‘বাবা বদল’। মনোজ মিত্রের ‘কেনারাম বেচারাম’ নাটকের ছায়া অবলম্বনে। বাড়ির কর্তা বেচারাম (হরিধন মুখোপাধ্যায়) নিখোঁজ। খোঁজ খোঁজ রব পড়ে গেল। দু’নম্বরি বাবাকে (মৃত্যুঞ্জয় মুখোপাধ্যায়) হাজির করলেন দালাল নগেন পাঁজা (জহর রায়)। সেই শুরু হল হুলস্থুল কাণ্ড। এক একটা ঘটনায় দর্শকদের হাসি আর থামতে চায় না। বাড়ির নাতনি দাদুকে অর্থাৎ ওই দু’নম্বরি বাবাকে জিজ্ঞাসা করলে, ‘বলো দাদু সামনের ওই গাছটা কী গাছ?’ দু’নম্বরি মানুষটি কীভাবে এর সদুত্তর দেবে! মুশকিল আসান নগেন পাঁজা হাজির। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে জানলার ধারে যেতেই দু’নম্বরি মানুষটি উত্তর দেওয়ার রসদ খুঁজে পেলেন, ‘ওই গাছটা, ওই গাছটা, ওটা হল ল্যাংড়া আমের গাছ।’ এরকম অজস্র ঘটনায় ভরপুর ‘বাবা বদল’ নাটক। সম্পত্তি হাতানোর নানান ফিকিরে নগেন পাঁজারূপী জহর রায় মাত করে দিলেন।
অন্যান্য শিল্পীদের প্রতি জহর রায়ের দরদ ভোলবার নয়। তিনি নিজে ‘শিল্পী সংসদ’-এর সভ্য, অনুপকুমার ‘অভিনেত্রী সঙ্ঘের’ সভ্য। তবু অনুপকুমারের নাটক ‘সম্রাজ্ঞী নুরজাহান’ যখন অভিনয় চলাকালীন ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হলে আগুন লাগায় বন্ধ হয়ে যায়, তখন জহর রায় অনুপকুমারদের নিজে নিয়ে এলেন রঙমহলে ওই নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য। রঙমহলে ‘সম্রাজ্ঞী নুরজাহান’ নাটকের যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৬ সালের ১৪ এপ্রিল। এর আগে পরে জহর রায় যেসব নাটকগুলিতে অভিনয় করলেন রঙমহলে, সে তালিকায় আছে কথা কও, স্বীকৃতি, নাম বিভ্রাট, টাকার রং কালো, প্রতিমা, অতএব, নন্দা, আলিবাবা, অনন্যা, সেমসাইড প্রভৃতি। রঙমহলে তাঁর শেষ অভিনীত নাটক ‘অপরিচিত’। কাহিনীকার সমরেশ বসু। জহর রায়ই পরিচালক। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে রঙমহলের শিল্পী-কলাকুশলী-কর্মীদের সমবায় প্রথার অস্তিত্বও শেষ হয়ে যায়।
জহর রায় যে সাংগঠনিক দায়িত্ব নিয়ে অজিত চট্টোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় রঙমহল চালাচ্ছিলেন, শেষের দিকে তা বিভিন্ন কারণে বিঘ্নিত হতে থাকে। হতোদ্যম জহর রায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন, দায়িত্ব পালনেও আর মন দিতে পারছিলেন না, নানানরকম রোগে ভুগছিলেন। অবশেষে জীবন মঞ্চ থেকে বিদায়। কৌতুক রসাত্মক প্রচুর নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে বাংলা থিয়েটারের হাস্যরসের মরাগাঙে জোয়ার এনে দিয়েছিলেন জহর রায়। সেই অমর শিল্পীর জন্মের শতবর্ষে (জন্ম: ১০/৯/১৯১৯) তাঁকে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম।
তথ্যঋণ: ‘বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস’ ড. দর্শন চৌধুরী