অতিরিক্ত পরিশ্রমে শারীরিক ক্লান্তি। প্রিয়জনের বিপদগামিতায় অশান্তি ও মানহানির আশঙ্কা। সাংসারিক ক্ষেত্রে মতানৈক্য এড়িয়ে চলা ... বিশদ
প্রযোজনা: থিয়েলাভার্স
পরিচালনা: অতনু সরকার ও ভর্গোনাথ ভট্টাচার্য
থিয়েলার্ভাস প্রযোজিত দুটি ভিন্নধর্মী নাটক ‘অনার্যবারতা ও পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির আর্থিক সহায়তায় কর্মশালা ভিত্তিক ‘গাজনাচরের বাজনা’ মঞ্চস্থ হল গিরিশ মঞ্চে। সময়, কাল ও নিয়তি— এই তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে সকলের ভাগ্য। এরাই নির্ধারণ করে প্রত্যেকের গন্তব্য। জন্ম এবং মৃত্যুর ক্ষণ নির্ধারিত হয় জীবনের ওই তিনটি বস্তুর দ্বারা। এই ধ্রুব সত্যটির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় ‘অনার্যবারতা’ নাটকটি। নাটকের বিষয়টির তাৎপর্য বুঝতে আমাদের সময়ের অনেক পেছনদিকে ফিরে যেতে হবে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের একটা দৃশ্যে। মহাভারতের এই যুদ্ধক্ষেত্রে যেখানে এক ভাই অন্য ভাইয়ের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে। মাতা হিরিম্বা যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে ঘটোৎকচের সন্দেহজনক প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত। এইসব প্রশ্নের উত্তরের দ্বারাই তার অতীতের যন্ত্রণার ছবি, বর্তমান সময় এবং ভবিষ্যৎ জীবনের কাহিনী ব্যখ্যা করে। মা ও ছেলের এই আলোচনাতেই গোটা নাটকের বক্তব্য বর্ণিত হয়।
মহাভারতের যুগ থেকে পৃথিবীতে নিচু জাতের মানুষেরা, বঞ্চিতরা, নিজেদের প্রাপ্য সম্মানের জন্য, অধিকারের জন্য প্রাণ দিয়ে লড়ে যায়। জগৎজুড়ে ভিন্নস্থানে, ভিন্নরূপে, এই বঞ্চিত মানুষেরা স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য যুদ্ধ করে। কোথাও জাত-পাতের বঞ্চনা, কোথাও আলো-আঁধারির দ্বন্দ্ব, আবার কোথাও ভূমিপুত্রের লড়াই। এই ভূমিপুত্রেরা দেশের জন্য নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে। এমনই এই দেশপ্রেমী, আজ্ঞাহীন, দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমের পুত্র, মহাবীর ঘটোৎকচ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে অন্তিমবারের মতো তার মাকে প্রশ্ন করছে। সে জানে যুদ্ধ থেকে তার আর ফেরা হবে না। তার মা হিরিম্বাও জানে পুত্রের সঙ্গে তার এই শেষ দেখা। কেন এই মা পুত্রকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে? যেটা আদতে আত্মঘাত, সেটাকে পিতৃবংশ রক্ষা কেন বলছে? অথচ ঘটোৎকচকে কেউ চিনত না যদি সে পাণ্ডবপক্ষে অস্ত্রধারণ করে আত্মঘাত না করতেন। তাঁর মৃত্যুই তাঁর পরিচয়। সেই বীর আত্মঘাতী ঘটোৎকচ, তাঁর জ্যেষ্ঠের আজ্ঞা পালন করে যুদ্ধে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো তাঁর পিতৃবংশ পরিচয়, তাঁর জীবনের দ্বিধা, তাঁর মনের সংশয় মেটানোর প্রশ্ন করছে মাকে।
এক সুন্দর ঐতিহাসিক মর্মগাথা, যার বীজ বপন করা হয় সেই অতীতে, তবে এর প্রভাব আজও চলছে। তাই এ শুধু বীরের অমরত্ব লাভ বা বলিদান নয়। দুটো জাতের বিভেদ ও বঞ্চনা সমানে কায়েম রয়েছে। তাই এটা আজও প্রাসঙ্গিক বলেই মনে হয়। রচনা ও নির্দেশনা, গল্প বলার ভঙ্গিমা এবং অসাধারণ উপস্থাপনার জন্য অবশ্যই ভর্গনাথ ভট্টাচার্যকে ধন্যবাদ দিতে হয়। সময়, নিয়তি ও কালের বর্ণনায় মঞ্চকে ব্যবহার করার পদ্ধতিটাও বেশ অভিনব। নাটকের প্রতিটি চরিত্রই বেশ সাবলীল, প্রাণবন্ত। আলো, মিউজিকের ব্যবহার বিষয়টিকে আরও গভীরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। দুটি মূল চরিত্র নাটকটিকে বিন্যস্ত করলেও পার্শ্বরূপকারীরাও যথাযোগ্য সহায়তা করে। তাদের অভিনয়ে পেশাদারিত্বের ছাপ স্পষ্ট লক্ষ করা যায়। শ্রীলেখা সিনহা, মেহুলি সরকার, মেখলা ঘোষ, অলোকান্না ভট্টাচার্যকে হিরিম্বার রূপে বেশ ভালো লাগে। অন্যান্য চরিত্রে রাহুল সওদাগর (কৃষ্ণ), সুমন দে (কাল), সাগর দাস (সময়), রূপসা নাগ (নিয়তি) নিজেদের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
দ্বিতীয় নাটক ‘গাজনাচরের বাজনা’। এই নাটকটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে পরিবেশিত হয়। প্রেম চিরন্তন সত্য, মানে না বর্ণ, মানে না জাতপাত, মানে না ধর্ম। কিন্তু সবধর্মের মিলনেও যখন স্বজাতির বা স্বধর্মের আগ্রাসন আর এই আগ্রাসনের চরম পরিণতি হয়ে ওঠে মৃত্যু! হত্যা! তখন নববধূর সিঁথির সিঁদুর মুছে যায়। এ ছবি ভারতবর্ষের অলিগলিতে ঘটে চলেছে প্রতিদিন। তবে প্রেম সত্য—সত্য মানবতা। মানবতার হত্যা আটকানোর প্রচেষ্টা এই ‘গাজনাচরের বাজনা’।
বাংলাদেশের পল্লি কবি জসিমউদ্দিনের কালজয়ী পল্লিকাব্য ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ আশ্রিত নাটক এটি।
রুপাই ও সাজু নামের দুই গ্রামীণ যুবক-যুবতীর অবিনশ্বর প্রেমের করুণ কাহিনী। বাস্তবে দুটি চরিত্রের নাম ছিল রূপা ও ললিতা। বাংলাদেশের ময়মনসিংহর গফরগায়ের উপজেলার শিলাসি গ্রামে যার বাড়ি ছিল। এই দুটি বাস্তব চরিত্রকে উপজীব্য করে কবি লিখেছিলেন এই যুবক-যুবতীর গল্প। তাদের নাম বদল করে হয় রুপাই ও সাজু। রুপাই চাষআবাদ করে। বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে আনন্দে মজায় দিন কাটায়। একদিন পাশের গ্রামের কয়েকজন মেয়ে গান গাইতে গাইতে তাদের গ্রামে আসে। তাদের মধ্যে ছিল সাজুও। সাজুকে রুপাইয়ের ভালো লাগে। সে জানতে পারে তার পরিচিত এক আত্মীয়ের মেয়ে সাজু। তাই একদিন সে পাশের গ্রামে যায়। তাদের দু’জনের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ হয়। একে অপরের প্রেমে পড়ে তারা। রুপাই সাজুর ভালোবাসার কথাটা সকলে জানতে পারে। বিষয়টা ভালোভাবে নেয় না মামুদ। সে চক্রান্ত করে। সাজুর সঙ্গে রুপাইয়ের বিয়ে হয়। সংসার পাতে তাঁরা। কিন্তু সুখে সংসার করা হয় না তাদের। মামুদ বনগেঁয়োর দলকে খেপিয়ে তোলে। তারা নিজেদের জমি ফিরে পাওয়ার আশায় রুপাইয়ের গাজনাচরের ধানজমি দখলের জন্য আক্রমণ করে। বনগেঁয়োদের প্রতিরোধ করতে সেখানে বড় ধরনের দাঙ্গা হয়। সেই দাঙ্গায় নেতৃত্ব দেয় রুপাই। দাঙ্গায় প্রাণ হারায় রুপাইয়ের কিছু বন্ধু ও বনগেঁয়োর দল। বাকি সকলে পালিয়ে যায়। সাজু ঝরা পাতার মতো মন নিয়ে, সেই প্রথম দেখা বাঁশ বাগানের দৃষ্টি বিনিময় থেকে শুরু করে তাদের জীবনের সব কথা, এমনকী যে রাতে রুপাই চলে গেল সেসব স্মৃতি কাঁথার ওপর ফুটিয়ে তুলতে থাকে সুচ-সুতো দিয়ে। এবং তার মাকে বলে যায় তার মরণের পরে যেন সেই কাঁথাটি কবরের উপর বিছিয়ে দেওয়া হয়। বহু দিন পরে গ্রামের কৃষকরা গভীর রাতে বেদনার্ত বাঁশির সুর শুনতে পায়। আর ভোরে সবাই এসে দেখে সাজুর কবরের পাশে এক ভিনদেশি লোক মরে পড়ে আছে। পল্লিকবি সেই দাঙ্গা দেখেন, গ্রামাঞ্চলে জমি দখলের এক নারকীয় দৃশ্য। লাঠিয়াল দলের নেতৃত্বদানকারী রুপাইয়ের তেজোদীপ্ত এক ভয়ঙ্কর বীরত্ব। ‘নকশি কাঁথার মাঠ’ আশ্রিত নাটকে সেই দাঙ্গাই মূল উপজীব্য হয়ে ওঠে। নাচেগানে জমজমাট এই নাটকে সূত্রধারের ভূমিকাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেটি মেহুলি সরকার ও অলকানন্দা ভট্টাচার্য খুব সুন্দর করে পালন করেছেন। আঞ্চলিক ভাষায় গানের বর্ণনায় উপস্থাপিত নাটকটিও মনোগ্রাহী হয়। অভিনয়ে রুপাইয়ের চরিত্রে সৌরভ দত্ত ও সাজুর ভূমিকায় শিবাঙ্গী ভট্টাচার্য এককথায় অনবদ্য।
অন্যান্য চরিত্রগুলির প্রতি যথাযোগ্য সুবিচার করেছেন আবির ঘোষ (মামুদ), সুরজিৎ দেবনাথ (রহিম চাচা), সুতপা মুখার্জি (আসমা), স্বাতী চক্রবর্তী (বরু), শুভাশীষ দত্ত (অছি মিঞা)। উপস্থাপনায় অতনু সরকার এবং মুখ্য উপদেষ্টা ভর্গোনাথ ভট্টাচার্য।