যারা বিদ্যার্থী তাদের মানসিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবে। নানা বিষয়ে খুঁতখুঁতে ভাব জাগবে। গোপন প্রেম থাকলে ... বিশদ
ছেলেটা কলকাতা শহরের পথে পথে কলা ফেরি করে বেড়ায়। নাম তার গোপাল। গোপাল করণ। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা পথে পথেই হাঁক দিয়ে সে কলা বেচে। শুধুমাত্র দুটি অন্ন সংস্থানের জন্য সে ছুটে এসেছে সেই উড়িষ্যা থেকে। কটকের জাজপুরে তার বাড়ি। বাবা মুকুন্দ করণ করতেন আদা আর বেগুনের চাষ। তাতে সংসার চলে না। জোয়ান বয়স। এখনই সংসারের হাল ধরা দরকার। কিন্তু আদা আর বেগুন চাষে সংসারের অবস্থা ফিরবে না। গ্রামেরই একজন পরামর্শ দিল, ‘গোপাল তুই কলকাতা শহরে চলে যা। বিরাট শহর। সেখানে মানুষের হাতে পয়সা আছে। কিছু একটা ব্যবসা করতে পারলে তোর জীবনটা ফিরে যাবে।’ সময়টা তখন ১৮৩৪ বা ৩৫।
গোপাল ভাবল, সেটা করলে মন্দ হয় না। বয়স এখন কম। এভাবে খেতখামারিতে কাজ করতে তার ভালোও লাগে না। প্রভু জগন্নাথের নাম করে গোপাল হাতে কিছু পয়সা নিয়ে চলে এল কলকাতায়। তারপর এটা সেটার ব্যবসা শুরু করল। পরে সে কলার ব্যবসা ধরে। এভাবেই চলে কয়েকটা বছর।
সেদিন কলকাতা গরমের তাপে ফুটছে। রাস্তায় লোকজন তেমন নেই। গোপাল সেদিন মাথায় কলার ঝুড়ি নিয়ে বউবাজারের অলিতে গলিতে ঘুরছে। কিছু বিক্রি না হলে আজ সন্ধ্যায় হয়তো পেটে কিছুই জুটবে না। বউবাজারের সেই গলিতে বাড়ি ছিল মতিলালদের। বাড়ির কর্তা বিশ্বনাথ মতিলাল তখন কয়েকজনের সঙ্গে বিদ্যাসুন্দর পালা নিয়ে আলোচনা করছেন। কীভাবে এই পালা দিয়ে মানুষের মন জয় করা যায়, তাই নিয়ে চলে জোর আলোচনা। তখন বাংলাদেশে বিদ্যাসুন্দর খুব জনপ্রিয়।
বস্তুত বাংলা নাট্যসংস্কৃতি বা যাত্রার ধারায় বিদ্যাসুন্দর প্রথম এক কাহিনি, যা দেবদেবীর বাইরে গিয়ে সাধারণ মানুষের প্রেম-ভালোবাসার কথা বলেছিল।
কয়েকটা বছর পিছিয়ে গেলে আমরা দেখব কবি ভারতচন্দ্রের জীবনাবসান হল ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে। এর পর রুশ সঙ্গীত বিশারদ গেরাসিম স্তেফানোভিচ লেবেদেফ বেঙ্গলি থিয়েটার স্থাপন করে অভিনয় করলেন এক বাংলা নাটক। রিচার্ড পল জোডরেলের দি ডিসগাইজ অবলম্বনে অভিনীত হল কাল্পনিক সংবদল। মঞ্চে প্রথম বাংলা নাটক। এ নাটকে তিনি বিদ্যাসুন্দর পালার গান ব্যবহার করেছিলেন। লেবেদেফের নাটক তখন ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে। মানুষের মুখে মুখে ফিরছে তাঁর নাম। সেই সময় একদিন আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল বেঙ্গলি থিয়েটার। লেবেদেফের জনপ্রিয়তা দেখে বুকে আগুন জ্বলেছিল ইংরেজদের। একজন রুশ নাট্যপ্রেমীর নাম মানুষের কাছে জনপ্রিয় হচ্ছে এটা তারা মেনে নিতে পারেনি। তাই একদিন রাতের অন্ধকারে তারা লোক লাগিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল সেই থিয়েটারে। দেনায় ডুবে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন লেবেদেফ। কিন্তু ইতিহাসকে মুছে ফেলা গেল না। ইংরেজরা এদেশে নাট্য উপস্থাপনায় অনেক অবদান অবশ্যই রেখেছে, কিন্তু বাংলা নাটকের উন্মেষকালে তাদের যে খলনায়কের ভূমিকা ছিল, তাকে ইতিহাস ভুলে যায়নি।
একবারে হার মানেননি লেবেদেফ। দেশে ফিরে তিনি রুশ ভাষায় বিদ্যাসুন্দর অনুবাদের কাজে হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর কারণে সে কাজ তিনি শেষ করতে পারলেন না।
তারপর আবার বিদ্যাসুন্দর ফিরে এল প্রায় চল্লিশ বছর পর। বউবাজারের রাধামোহন সরকারের হাত ধরে। ধনপতি রাধানাথবাবুর একটা দল ছিল। সেই দল নিয়ে উৎসাহী ছিলেন মতিলালরা। ঘরের ভিতর তখন পালাগানের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা চলছে। বিদ্যাসুন্দর তো নামানো হবে কিন্তু মালিনী সাজবে কে? দলে তখন সখী সাজতেন রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেই সময় দুপুরবেলা বাইরে সুর করে কেউ বলছে, ‘চাঁপাকলা চাই চাঁপাকলা।’ ঘরের মধ্যে বিশ্বনাথ মতিলাল চমকে তাকালেন। ‘এমন সুর করে কে কলা বেচে! আরে বাবা এতো গান্ধার সুর! এই সুরে যে কলা বেচে তার গানের গলা কতই না সুন্দর হবে।’ কলাবিক্রেতাকে দেখার খুব কৌতূহল হল। বিশ্বনাথবাবু বাড়ির চাকরকে ডেকে বললেন, ‘যা তো ওই চাঁপাকলা বিক্রি করছে যে ছেলেটা, তাকে ডেকে আন তো।’
চাকর গিয়ে ডাকল গোপালকে। আশান্বিত হল গোপাল। যাক দুটো কলা তাহলে বিক্রি হবে। আজ রাতে না খেয়ে থাকতে হবে না। বিশ্বনাথবাবুর সামনে এসে দাঁড়ালেন গোপাল। তাকে ভালো করে দেখলেন বিশ্বনাথ। খুব একটা লম্বা নয়। গায়ের রং একটু চাপা। নাকটি টিকলো। একের পর এক প্রশ্ন করে চললেন বিশ্বনাথ। তার নাম কী, বাবার নাম কী, বাড়ি কোথায়, জাত কী,বর্ণ কী, এমন কী গোত্র পর্যন্ত জানতে চাইলেন। গোপাল নরম স্বরে সব প্রশ্নের জবাব দিলেন। এরপর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এই কলা বিক্রি করে তার কেমন রোজগার হয়।
গোপাল একটু বিরক্তই হল। কিনবে দুটো কলা, তাতে এত জিজ্ঞাসার কী আছে বাপু! কিন্তু তাও নরম করে বলল, ‘আজ্ঞে সেভাবে আর চলে কই। যেদিন বিক্রি হয় সেদিন খাবার জোটে আর যেদিন বিক্রি হয় না, সেদিন শুধুই জল’। বিশ্বনাথবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি গান জানো?’ গোপাল মাথা নেড়ে বললেন, না সে গান জানে না।
বিশ্বনাথবাবু একটু ভেবে বললেন, ‘দেখো হে রাধানাথ, একে শিখিয়ে পড়িয়ে যদি নিতে পারো তবে একদিন লাভ পাবে। অবশ্য পাখি যদি উড়ে না যায়।’
রাধানাথ বললেন, ‘গলা তো মন্দ নয়, ছেলে যদি খাটে তবে মনে হয় একটা রত্ন পাব।’ গোপালকে জিজ্ঞাসা করা হল, সে যাত্রা দলে অভিনয় করবে কিনা। করলে সে দশ টাকা পাবে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল গোপাল। এর পরের কয়েকটা বছর ইতিহাস। রাধামোহনবাবুর বাড়িতে গানের আসরে মাঝে মাঝেই গান গাইতেন ওস্তাদ হরিকিষণ মিশ্র। রাধামোহনবাবুর অনুরোধে গোপালকে গান শেখাতে শুরু করলেন তিনি। সেই সঙ্গে তালিম চলল বাংলা ভাষা শুদ্ধভাবে উচ্চারণ করার এবং অভিনয়ের। উড়িষ্যা থেকে আগত গোপাল করণ সকলের মুখে মুখে হয়ে গেলেন গোপাল উড়ে। এই নামেই তিনি মঞ্চে নেমে আসর মাত করতেন।
হরিকিষণ মিশ্রের কাছ থেকে খুব তাড়াতাড়ি গোপাল শিখে নিলেন টপ্পা, ঠুংরি। শিখলেন অভিনয়ের ছলাকলাও। তাকে দিয়ে মালিনী করানোর কথা ভেবে রেখেছিলেন রাধামোহনবাবু। অবশেষে আসর বসল ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে। শোভাবাজারে রাজা নবকৃষ্ণ দেবের বাড়িতে।
প্রথম আসরেই মাতিয়ে দিলেন গোপাল উড়ে। মালিনীর ভূমিকায় তাঁর গান, অভিনয় ও চাউনি, ভ্রু-ভঙ্গিমা এবং চটক দেখে মজে গেলেন দর্শকরা। অনেকেই ভেবেছিলেন মালিনীর ভূমিকায় নেমেছেন কোনও অভিনেত্রী। এক রাতের অভিনয়ের পরই তাঁর বেতন মাসিক দশ টাকা থেকে বেড়ে হল পঞ্চাশ টাকা। আর সেই সঙ্গে গোপালের নাম ছড়িয়ে পড়তে লাগল। এরপর রাধামোহনের দলে গোপাল উড়ে আরও দু’বার মালিনীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সেই দুটি অভিনয়ের আসর বসেছিল হাটখোলার দত্তদের বাড়িতে এবং শিমুলিয়ার সাতুবাবুর বাড়িতে। এই দত্তবাড়ি থেকেই আমরা পেয়েছিলাম সে যুগের বিখ্যাত অভিনেতা অমরেন্দ্রনাথ দত্তকে।
বিদ্যাসুন্দর পালা নামানোর আগে দু’বছর ধরে রিহার্সাল হয়েছিল। এই পালার জন্য রাধামোহনের মোট ব্যয় হয়েছিল লক্ষ টাকারও বেশি। সেই সময় লক্ষ টাকা মানে বিরাট অঙ্কের টাকা। কিন্তু রাধামোহনের মৃত্যুর পর হঠাৎ সঙ্কট দেখা দিল। দল বন্ধ হয়ে গেল। গোপাল তখন সেই দলের সাজপোশাক, বাদ্যযন্ত্র সব কিনে নিলেন। স্থির করলেন নতুন দল গড়বেন। বিদ্যাসুন্দর তাঁকে দিয়েছে খ্যাতি। দিয়েছে অর্থ। তাই তিনি বিদ্যাসুন্দর ছাড়তে পারবেন না। যুগ বদলাচ্ছে। যুগের প্রয়োজন মেটাতে হবে। তাই বিদ্যাসুন্দরকে ঘষেমেজে নবরূপে উপস্থাপন করা দরকার।
একটা হিসাবে দেখা যাচ্ছে ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার মোট জনসংখ্যা ছিল মাত্র বারো হাজার। আর ১৭৫০ থেকে ৬০-এর মধ্যে এই জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২ লক্ষ ১০ হাজার এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে জনসংখ্যা পাঁচ লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ক্রমবর্ধমান শহর। বাইরে থেকে অর্থনৈতিক কারণে আশপাশের গ্রাম থেকে এসে জুটছিল ময়রা, ধোপা, জেলে, নাপিত, দরজি। ক্রমে গড়ে ওঠে ছোট ব্যবসায়ী শ্রেণী। এদের বিনোদনের চাহিদা অন্যরকম। সেই চাহিদা কেমন, সেটা গোপাল উড়ে ভালো করেই জানতেন। তাই তিনি বিদ্যাসুন্দরকে নিয়ে গেলেন অন্যমাত্রায়। নাচে, গানে আরও সরল, আরও অপেরাধর্মী। সেই যাত্রা শুধু সাধারণ মানুষকেই নয়, মজিয়ে দিয়েছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িকেও। গোপাল উড়ের পালা দেখে ঠাকুরবাড়ি নাট্যশালা প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়েছিল। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ইংরেজিতে একটা চিঠি লিখেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাতে তিনি লেখেন, ‘গোপাল উড়ের যাত্রা থেকেই আমরা থিয়েটার করার প্রেরণা পেয়েছি।’