কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীর ঈর্ষার কারণে সম্মানহানি হবে। ব্যবসায়ীদের আশানুরূপ লাভ না হলেও মন্দ হবে না। দীর্ঘ ... বিশদ
পৃথিবীতে বসে বিজ্ঞানীরা সূর্যকে নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন, তবে আরও নিখুঁত ও পূর্ণাঙ্গ গবেষণার জন্য সূর্যের কাছে যাওয়াটা ভীষণ জরুরি। সেই কাজই করবে ‘আদিত্য এল-১। সংস্কৃত শব্দ আদিত্য মানে সূর্য। ২০২০ সালের শুরুতে এই মহাকাশ যানটিকে পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল-এক্সএল বা পিএসএলভি-এক্সএল রকেটের সাহায্যে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান মহাকাশ কেন্দ্র থেকে উৎক্ষেপণ করা হবে। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি এই মহাকাশযানটির নির্মাণে ইসরোকে সাহায্য করেছে বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আইআইএ), পুনের ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আইইউসিএএ), আমেদাবাদের ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি (পিআরএল), কলকাতার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইআইএসইআর), রাজস্থানের উদয়পুর সোলার অবজারভেটরি রাজস্থান এবং তিরুবনন্তপুরমের স্পেস ফিজিক্স ল্যাবরেটরি।
প্রথমে মনে করা হয়েছিল আদিত্য এল-১-কে দিয়ে সূর্যের করোনা বা সোলার করোনার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। কারণ, ৪০০ কিলোগ্রাম ওজনের এই উপগ্রহে ‘ভিজিবল এমিশন লাইন করোনাগ্রাফ’ নামে একটি মাত্র ‘পে-লোড’ থাকার কথা ছিল। সেজন্য এটিকে ৮০০ কিলোমিটার পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথে স্থাপন করার পরিকল্পনা হয়েছিল। পরে সেই পরিকল্পনা পাল্টে যায় এবং আদিত্য-১ রূপান্তরিত হয় আদিত্য এল-১-এ।
এল-১ হল প্রথম ল্যাগর্যাঞ্জ পয়েন্ট। একটি উপগ্রহ ল্যাগর্যাঞ্জিয়ান পয়েন্টের চারদিকে যে পথ অনুসরণ করে তাকে হ্যালো অরবিট বলে। পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যে মোট পাঁচটি ল্যাগর্যাঞ্জিয়ান পয়েন্ট আছে — এল-১, এল-২, এল-৩, এল-৪ এবং এল-৫। এই এল-১-কে কেন্দ্র করে একটি ‘হ্যালো কক্ষপথে’ পরিক্রমণ করবে আদিত্য এল-১। এল-১ পয়েন্ট হল সোলার সিস্টেমের এমন একটি অবস্থান যেখানে পৃথিবী ও সূর্যের সম্মিলিত মাধ্যাকর্ষণ বল ওই অবস্থানে রাখা তৃতীয় কোনও ছোট বস্তু বা উপগ্রহের ওপর অনুভূত কেন্দ্রাতিক বলের সমান ও বিপরীতমুখী। ফলে উপগ্রহটি স্থিতিশীল একটি কক্ষপথে আবর্তন করবে।
পৃথিবী থেকে ১৫ লক্ষ কিলোমিটার এবং সূর্য থেকে ১ হাজার ৪৮১ লক্ষ কিলোমিটার দূর অবস্থান করে কোনও গ্রহণ বা বাধা ছাড়াই কমপক্ষে পাঁচ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে আদিত্য এল-১ সূর্যকে পর্যবেক্ষণ করবে। উৎক্ষেপণের প্রায় ১০০ দিন পরে উপগ্রহটি এল-১-কে কেন্দ্র করে হ্যালো অরবিটে ঘুরতে শুরু করবে। এইভাবে সূর্যের বাড়িতে গোপন নজরদারি চালিয়ে সূর্যের যাবতীয় কার্যকলাপের কথা ও ছবি পাঠিয়ে দেবে এই নীলগ্রহে। উপগ্রহটিতে মোট সাতটি পে-লোড বা পরীক্ষা-নিরীক্ষামূলক অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক যন্ত্র থাকবে। জ্বালানি সহ ১ হাজার ৫০০ গ্রাম ওজনের এই সর্বাধুনিক উপগ্রহটি সৌর করোনার রহস্য উন্মোচন করতে পারবে বলেই বিজ্ঞানীদের ধারণা।
কিন্তু, কেন সৌর করোনা এত রহস্যময়? সূর্যের কেন্দ্রে একটি পরমাণু চুল্লি রয়েছে। সেখানে প্রতিনিয়ত হাইড্রোজেন নিউক্লীয়-সংযোজন প্রক্রিয়ায় হিলিয়ামে পরিণত হয়। এই রূপান্তরের সময় যে পরিমাণ ভর ‘হারিয়ে’ যায় সেই ভরই তাপশক্তি এবং আলোকশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটি হয় আইনস্টাইনের E=mc2 সূত্র মেনে। এর ফলে সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা প্রায় ১.৫ কোটি কেলভিন হয়। সূর্যপৃষ্ঠের বা ফোটোস্ফিয়ারের তাপমাত্রা ৫ হাজার কেলভিন। অর্থাৎ, সূর্যের কেন্দ্র থেকে সূর্যপৃষ্ঠের দিকে এগিয়ে গেলে তাপমাত্রা কমতে থাকে। কিন্তু ফোটোস্ফিয়ার থেকে দশ গুণের বেশি দূরত্বে থাকা সোলার করোনার তাপমাত্রা প্রায় ১০ লক্ষ কেলভিন।
অর্থাৎ সূর্যের কেন্দ্রের কাছে থাকা ফোটোস্ফিয়ারের তুলনায় অনেক দূরে থাকা করোনার তাপমাত্রা প্রায় ২০০ গুণ বেশি। আবার করোনার তাপমাত্রা সব জায়গায় সমান নয়। কোথাও অনেক বেশি, কোথাও অনেক কম। কেন করোনার তাপমাত্রা এত বেশি, কেনই বা করোনার বিভিন্ন অংশের তাপমাত্রার মধ্যে এত পার্থক্য — সূর্যের এই সমস্ত হেঁয়ালিপনার কারণ অনুসন্ধান করবে আদিত্য এল-১।
করোনা ছাড়াও এই মহাকাশযানটি ফোটোস্ফিয়ার এবং ক্রোমোস্ফিয়ারের ওপর নজরদারি চালাবে। ফোটোস্ফিয়ার হল সূর্যের সর্বনিম্ন একটি স্তর। পৃথিবীতে আমরা যে সমস্ত আলোকিত বস্তুকে দেখি, সেই আলো এই ফোটোস্ফিয়ার থেকেই নির্গত হয়। সূর্য থেকে এই আলো ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড পরে আমাদের পৃথিবীতে এসে পৌঁছয়। দ্বিতীয় স্তরটি হল, ক্রোমোস্ফিয়ার। সবচেয়ে বাইরে থাকে করোনা। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় চাঁদ ফোটোস্ফিয়ারকে ঢেকে দেয়। আমরা তখন গোলাপি-লাল রঙের ক্রোমোস্ফিয়ার এবং করোনাকে দেখতে পাই।
২০১৮ সালের ১২ আগস্ট আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা বিশ্বের প্রথম সৌর মহাকাশযান ‘পার্কার সোলার প্রোব’ মহাকাশে পাঠায়। ইতিমধ্যেই সেটি সফলভাবে দু’বার সূর্যকে ভীষণ কাছ থেকে (সূর্য থেকে মাত্র ৮০ লক্ষ কিলোমিটার) প্রদক্ষিণ করেছে। এই মহাকাশযানটি ইতিমধ্যেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাঠিয়েছে। এগুলো আদিত্য এল-১-কে অনেক সাহায্য করবে বলে মনে করা হচ্ছে। যে সূর্যকে আমরা আকাশে রোজ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দেখি, যার জন্য শুধু এই পৃথিবীতেই জল তরল অবস্থায় আছে, পৃথিবীতে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে, সেই সূর্যের গোপন রহস্য উন্মোচন করতে পারবে আদিত্য এল-১। এমনটাই ধারণা ইসরোর বিজ্ঞানীদের।
নাসা আর ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির পর ভারতই প্রথম পাড়ি দিচ্ছে সৌর মুলুকে। এই অভিযান সফল হলে মহাকাশ বিজ্ঞানের ইতিহাসে ভারতের জায়গাটা শুধু শক্তিশালীই হবে না, পদার্থবিজ্ঞানের দীর্ঘস্থায়ী অনেক প্রশ্নের সমাধানও করা যাবে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে চাঁদে ভারত নিজস্ব স্পেস স্টেশন তৈরি করবে। ২০২০ সালটা তাই ভারতের মহাকাশ গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। এরপর ইসরো যথাক্রমে গগনযান, চন্দ্রযান-৩, মঙ্গল-২ এবং শুক্র মিশন পাঠাবে মহাকাশে।
আদিত্য এল-১-এর সাতটি পে-লোডের কাজ:
১. ভিজিবল এমিশন লাইন করোনাগ্রাফ: করোনার উপর নজর রাখার
জন্য থাকবে শক্তিশালী এই করোনাগ্রাফ। এটি সূর্যের মধ্যে ঘটে চলা বিভিন্ন গতিমান প্রক্রিয়া এবং কীভাবে করোনা থেকে ভর নির্গত (করোনাল মাস এমিশন) হয় তা পরীক্ষা করবে। করোনার চৌম্বকক্ষেত্রের পরিমাপ করবে। করোনাগ্রাফ হল একটি বিশেষ যন্ত্র, যা সূর্যের আলোকে আটকানোর জন্য তৈরি করা হয়েছে। যাতে করে জ্বলন্ত সূর্যের উত্তপ্ত বহির্মুখী স্তরটিকে দেখতে পাওয়া যায়। অন্যথায় যে স্তরটি সূর্যের আলোতে লুকিয়ে থাকে। করোনাগ্রাফ আসলে সূর্যালোককে অবরুদ্ধ করে মহাকাশে কৃত্রিমভাবে একটি পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ সৃষ্টি করবে।
২. সোলার আল্ট্রাভায়োলেট ইমেজিং টেলিস্কোপ: এটি সূর্যের ফোটোস্ফিয়ার এবং ক্রোমোস্ফিয়ারের ছবি পাঠাবে। এই টেলিস্কোপটি ২০০-৪০০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (আল্ট্রাভায়োলেট অঞ্চল) পরিসরের মধ্যে সূর্যেকে পর্যবেক্ষণ করবে।
৩. আদিত্য সোলার উইন্ড পার্টিকেল এক্সপেরিমেন্ট: এটি সৌরবায়ুর বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন এবং তার বণ্টন ব্যবস্থা ও আলোকধর্মের অধ্যয়ন করবে।
৪. প্লাজমা অ্যানালাইজার প্যাকেজ ফর আদিত্য: এটি সৌরবায়ুর উপাদান এবং সৌরবায়ুর শক্তির বিন্যাস পর্যবেক্ষণ করবে।
৫. সোলার লো এনার্জি এক্স-রে স্পেক্ট্রোমিটার: কোন বিশেষ কৌশলে করোনার তাপমাত্রা এত বেড়ে যায় তা বোঝার জন্যে এক্স-রে ফ্লেয়ার (সৌর শিখা) গুলির ওপর নজর রাখবে এই স্পেক্ট্রোমিটার। এক্স-রে ফ্লেয়ার হল শক্তিশালী সৌর বিকিরণ যা করোনা থেকে নির্গত হয়।
৬. হাই এনার্জি এল-১ অরবিটিং এক্স-রে স্পেক্ট্রোমিটার: সৌর করোনায় ঘটে চলা প্রক্রিয়াগুলি পর্যবেক্ষণ করবে এবং বিস্ফোরণের সময় সৌরশক্তি যুক্ত কণাগুলিকে ত্বরান্বিত করতে কী পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন তার একটা আন্দাজ দেবে এই স্পেক্ট্রোমিটার।
৭. ম্যাগনেটোমিটার: আন্তঃগ্রহ চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের (Interplanetary Magnetic Field) পরিমাপ এবং প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করবে এই ম্যাগনেটোমিটার।
আদিত্য মিশনের মূল লক্ষ্য:
সূর্যপৃষ্ঠ থেকে বহু দূরে থাকা করোনার তাপমাত্রা সূর্যপৃষ্ঠের তাপমাত্রার থেকে এত বেশি কেন, করোনা থেকে কীভাবে ভর নির্গত হয় তা বোঝার চেষ্টা করা। কোনও অঞ্চলের আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানতে এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সৌরঝড়ের কারণ এবং তার গতিপথ বোঝার চেষ্টা করা। এটা বুঝতে পারলে এই গ্রহের টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও নিখুঁত এবং নির্ঝঞ্ঝাট করা যাবে।
সৌরঝড় কোন পথে পৃথিবীতে আসে, কেন অন্য পথে না গিয়ে ওই পথ ধরেই সৌরঝড় আমাদের গ্রহে আসছে তা জানার চেষ্টা করা হবে। এই সৌরঝড় পৃথিবীর চারপাশে প্রদক্ষিণরত যোগাযোগ রক্ষাকারী উপগ্রহগুলিকে তছনছ করে দিতে পারে।
সূর্য থেকে আসার ক্ষতিকারক অতিবেগুনি রশ্মি সূর্যের ঠিক কোন জায়গা থেকে এবং কী পরিমাণে আসে তা অনুধাবন করার চেষ্টা করা হবে।
(লেখক হুগলি জেলার নেতাজি মহাবিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রধান)