সোমবার, 28 এপ্রিল 2025
Logo
  • সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫

হিন্দু

ভারতে ইদানীংকালে সম্প্রদায়, সাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়-সংহতি ইত্যাদি বিষয়ে বহু বাগাড়ম্বর শোনা যায়। বিশেষ করে এক শ্রেণীর সংকীর্ণ স্বার্থান্বেষী মানুষ এমন একটি হাওয়া বইয়েছেন এ দেশে যে, ‘হিন্দু’ বললেই তাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বা ‘কম্যুনাল’ বলে চিহ্নিত করা হবে এবং ‘হিন্দু’ বলাটাই একটা নিন্দনীয় ব্যাপার!

হিন্দু

ভারতে ইদানীংকালে সম্প্রদায়, সাম্প্রদায়িকতা, জাতীয়-সংহতি ইত্যাদি বিষয়ে বহু বাগাড়ম্বর শোনা যায়। বিশেষ করে এক শ্রেণীর সংকীর্ণ স্বার্থান্বেষী মানুষ এমন একটি হাওয়া বইয়েছেন এ দেশে যে, ‘হিন্দু’ বললেই তাকে ‘সাম্প্রদায়িক’ বা ‘কম্যুনাল’ বলে চিহ্নিত করা হবে এবং ‘হিন্দু’ বলাটাই একটা নিন্দনীয় ব্যাপার! কারা কেন এটা করছেন, সে দিকে না গিয়েও আমরা সুদৃঢ় কণ্ঠে বলতে পারি যে, এধরণের কথাবার্তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং অযৌক্তিক। হিন্দুধর্মে প্রকৃত কল্যাণের যে উদার ভাব সতত বিদ্যমান, বহু সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি তারই একটা প্রমাণ। হিন্দুধর্ম এক মহাসমুদ্র, যেখানে এসে মিলিত হয়েছে অসংখ্য ধর্মের প্রবহমাণ ধারা। নদীরূপী এই সম্প্রদায়গুলি তাদের আলাদা অস্তিত্ব অক্ষুণ্ণ রেখেও মহাসমুদ্রের সঙ্গে এক দেহে লীন। হিন্দুরূপী এহেন এক অসীম অনন্ত সত্তাকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেওয়া হাস্যকর নয় কি? ছোট ছোট সম্প্রদায়ের সমভাবাপন্ন গোষ্ঠী ধর্ম ও সংস্কৃতির পথে ব্যক্তি ও সমাজের চলাকে সুগম করে। সম্প্রদায় তাই মানবসমাজে অনিবার্য রূপে আবশ্যক। কিন্তু সাম্প্রদায়িক কলহ অবান্তর ও অবাঞ্ছিত। সাম্প্রদায়িক কলহের মূলে হয় অজ্ঞান নয় অহংকার। ধর্মাচরণের মূল উদ্দেশ্য ও তত্ত্ব সম্বন্ধে সচেতন থাকলে সাম্প্রদায়িকতা হয়ে যায় সম্পূর্ণ অস্তিত্বহীন। অজ্ঞান এবং অহং থেকে উদ্ভূত সাম্প্রদায়িকতাকে সহজেই দূর করা যায় ধর্মবিষয়ক প্রকৃত তত্ত্বজ্ঞানের শিক্ষা ও প্রচারের মাধ্যমে এবং বহু বাঞ্ছিত অসংখ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক প্রেমের উদার মিলন ক্ষেত্র নির্মাণের মাধ্যমে। আত্মবিশ্বাসকে বিসর্জন দিয়ে, অকারণ আত্মনিন্দায় মুখর হয়ে কোনও মহৎ কাজ সম্পাদন করা সম্ভব নয়। হিন্দু জাতির অদ্ভুত অবস্থা লক্ষ্যণীয়। না বুঝে না জেনে নিজেদের গুণকেও দোষ বলে ঘোষণা করা, নিজেদের ভালকেও মন্দ বলে প্রচার করা, নিজেদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকেও সাম্প্রদায়িকতা বলে চীৎকার করা একমাত্র এই মহান হিন্দু জাতি ছাড়া আর কোনও জাতিতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। হিন্দু হয়ে হিন্দুকে যারা ‘সাম্প্রদায়িক’ অপবাদ দেয় তাদের জন্য স্বামী বিবেকানন্দের কিছু মন্তব্য উদ্ধৃত করা প্রয়োজন। বিবেকানন্দ বলেছেন—“সর্বাপেক্ষা অল্প বাধার মধ্য দিয়া অগ্রসর হওয়া যদি যথার্থ কর্মপন্থা হয়, তবে আমার মনে হয়, প্রত্যেক ধর্ম বিভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত হইলে উহা দ্বারা ধর্ম রক্ষাই হয়, ইহাতে কঠোর একঘেয়েমির প্রবণতা ব্যর্থ হয় এবং স্পষ্ট কর্মপন্থা নির্ধারিত হয়। অতএব মনে হয় উদ্দেশ্য—সম্প্রদায়গুলির ধ্বংস নয়, বরং উহাদের সংখ্যা বৃদ্ধি, যে পর্যন্ত না প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেই একটি সম্প্রদায় হইয়া দাঁড়ায়। ‘অন্যপক্ষে আবার সব ধর্ম মিলিত হইয়া একটি বিরাট দর্শনে পরিণত হইলেই ঐক্যের পটভূমিকা সৃষ্টি হয়।”
“বেগবতী জীবন্ত নদীতেই ঘূর্ণাবর্ত থাকে, বদ্ধ ও স্রোতহীন জলে আবর্ত হয় না। যখন ধর্মগুলি বিনষ্ট হইয়া যাইবে, তখন আর সম্প্রদায়ও থাকিবে না, তখন শ্মশানের পূর্ণশান্তি ও সাম্য বিরাজ করিবে। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত মানুষ চিন্তা করিবে, ততদিন সম্প্রদায়ও থাকিবে। বৈষম্যই জীবনের চিহ্ন এবং বৈষম্য থাকিবেই।…”
স্বামী মৃগানন্দের ‘ধর্মের রহস্য’ থেকে