ব্যবসা ও পেশায় ধনাগম ভাগ্য আজ অতি উত্তম। বেকারদের কর্ম লাভ হতে পারে। শরীর স্বাস্থ্য ... বিশদ
মৎস্য বিজ্ঞান সায়েন্সের অন্যতম শাখা। তাই বিজ্ঞানে আগ্রহ থাকলে এ বিষয়ে উচ্চস্তরে পড়াশোনা ও গবেষণার প্রভূত সুযোগ আছে। তবে মনে রাখতে হবে, মাছ চাষ মূলত গ্রামকেন্দ্রিক পেশা। তাই শহুরে জীবনে অভ্যস্তদের প্রথম দিকে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে। তাই ফিশারিজ সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করতে চাইলে গ্রামেগঞ্জে কাজ করার মানসিকতা থাকা দরকার। যদিও শিক্ষকতা ও গবেষণার সঙ্গে যুক্ত হতে পারলে শহরাঞ্চলেও কাজ করার সুযোগ আছে।
ফিশারিজ সায়েন্স বিষয়টা কী
সহজ করে বললে ফিশারিজ সায়েন্স হল বিজ্ঞানসম্মতভাবে মাছ চাষের উপায়। পাশাপাশি যেসব বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অ্যাকোয়াটিক অর্গানিজম বা জলজ প্রাণী আছে (বিভিন্নরকম শামুক, ঝিনুক, নানারকম অয়েস্টার, চিউইড) সেগুলো বিজ্ঞানসম্মতভাবে চাষ করা, প্রতিপালন করা, বাজারজাত করার পদ্ধতিও এই বিষয়ের মধ্যে পড়ে। মাছ কী খাবার খাবে, রোগ হলে চিকিৎসা কী হবে, চাষের পরে বাজারজাত করতে কী পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে, মাছের বিভিন্ন খাবারের (ফিশ কাটলেট / ফিশ চপ/ ফিশ বল) প্রিপারেশন সম্বন্ধেও পড়ানো হয় এই পাঠ্যক্রমে। এছাড়া মাছের যে অংশগুলো ফেলে দিই, সেইসব বর্জ্যপদার্থ ফেলে না দিয়ে কীভাবে কাজে লাগানো যায় তাও শেখানো হয়। এই বর্জ্যপদার্থ অগার্নিক ম্যানিওর তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও রয়েছে অর্নামেন্টাল ফিশ। এই ধরনের মাছ ঘরের সৌন্দর্য বাড়াতে বা অ্যাকোয়ারিয়ামে ব্যবহার করা হয়। এই ধরনের মাছের প্রজনন করা বা একটা অ্যাকোয়ারিয়াম কীভাবে ঘরে সেট করা যায় সে সংক্রান্ত বিষয়ও পড়ানো হয় এই পাঠ্যক্রমে।
পড়ার চাহিদা
ফিশারিজ সায়েন্সকে এককথায় বলা যায় হাই রাইজিং সেক্টর অর্থাৎ যে বিষয় নিয়ে পড়ার চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়ছে। যেহেতু বিষয়টা খুব ইন্টারেস্টিং আর সম্ভাবনাময়, তাই পড়ুয়ারা ক্রমশ ফিশারিজ সায়েন্স নিয়ে পড়তে আগ্রহী হচ্ছে। হাইপ থাকার পাশাপাশি বিষয়টা এখনও আনএক্সপ্লোরড। অনেকেরই ধারণা নেই বিষয়টা সম্পর্কে।
মাছ তো জলে ভাসে আর পাতে স্বাদ আনে। সেটা নিয়েও আবার পড়াশোনা করা যায়! বিষয়টা নিয়ে জানলে ভবিষ্যতে আরও বেশি পড়ুয়া ফিশারিজ সায়েন্স নিয়ে পড়ার চিন্তাভাবনা করবে। কোভিড মহামারীর পরে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য মাছের যে কতখানি গুরুত্ব সেটা বোঝাতে সরকারও অনেক পরিকল্পনা নিয়েছে। প্রত্যেকের পাতে যাতে মাছ পৌঁছে দেওয়া যায় তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সরকারি স্কিম চালু হয়েছে, প্রোডাকশন বাড়ানোর পদ্ধতি গ্রহণ করা হচ্ছে।
কারা পড়ার যোগ্য
১০+২ শিক্ষাপদ্ধতিতে যারা সায়েন্স নিয়ে পড়েছে, তারাই একমাত্র এই কোর্স করতে পারবে। ইংরেজি, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি অথবা ম্যাথামেটিক্স নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক বা সমতুল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া আবশ্যক। সাধারণ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের ন্যূনতম ৫০ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাশ করতে হবে। তফসিলি জাতিদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম নম্বর ৪০ শতাংশ পেতে হবে।
রাজ্যে পড়ার সুযোগ
আমাদের রাজ্যে একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি অব অ্যানিমাল অ্যান্ড ফিশারি সায়েন্স বা পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়েই পেশাগত মৎস্য বিজ্ঞান বিষয়ে ডিগ্রি কোর্স পড়ানো হয়। এখানে এই বিষয়ে ৪ বছরের স্নাতক (বি এফ এসসি বা ব্যাচেলর ইন ফিশারিজ সায়েন্স), ২ বছরের স্নাতকোত্তর (এম এফ এসসি বা মাস্টার্স ইন ফিশারিজ সায়েন্স) ও ৩ বছরের ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করা যায়।
বেসরকারি কলেজের মধ্যে একদম প্রথম সারিতে আছে দ্য নেওয়াটিয়া ইউনিভার্সিটি। এছাড়াও আরও একটি উল্লেখযোগ্য বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হল মিদনাপুর সিটি কলেজ। এখনও পর্যন্ত আমাদের রাজ্যে এই তিনটি কলেজ থেকে ফিশারিজ সায়েন্সে ৪ বছরের ডিগ্রি কোর্স পড়ানো হচ্ছে।
কীভাবে সুযোগ পাওয়া যায়
এই কোর্সে পড়ার জন্য কোনও এন্ট্রান্স পরীক্ষা নেওয়া হয় না। ১০+২ পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতেই ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি নেওয়া হয়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ভর্তি হতে প্রায় ৯০ শতাংশ নম্বর পাওয়া বাধ্যতামূলক। বেশ কিছু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ৫৫ শতাংশ নম্বর পেলে তবেই এই কোর্সের জন্য আবেদন করা যায়।
আনুমানিক খরচ বা কোর্স ফি
বেসরকারি কলেজের থেকে সরকারি কলেজে পড়ার খরচ তুলনামূলকভাবে কম। সরকারি ক্ষেত্রে ৪ বছরের ডিগ্রি কোর্সে সেমেস্টার খরচ নিয়ে শুধুমাত্র পড়াশোনার জন্য খরচ পড়বে ৫০ হাজার টাকা। হস্টেল বা অন্যান্য খরচ এখানে ধরা হচ্ছে না।
বেসরকারি কলেজের ক্ষেত্রে ৪ বছরের কোর্সের প্যাকেজ হল ৪ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা। এরমধ্যে হস্টেল খরচ যুক্ত রয়েছে।
স্নাতকোত্তর পাঠ্যক্রম
গ্র্যাজুয়েশনের পর স্পেশালাইজেশন করার সুযোগ রয়েছে। এমএসএফসি বা মাস্টার্স ইন ফিশারিজ সায়েন্স পাঠ্যক্রমে ৯টা ডিপার্টমেন্ট রয়েছে— অ্যাকোয়াকালচার, অ্যাকোয়াটিক এনভায়র্নমেন্ট ম্যানেজমেন্ট, অ্যাকোয়াটিক অ্যানিমাল হেলথ ম্যানেজমেন্ট, ফিশ প্রসেসিং টেকনোলজি, ফিশারিজ ইকোনমিক্স অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিকস, ফিশারিজ এক্সটেনশন, ফিশারিজ ইঞ্জিনিয়ারিং, ফিশ নিউট্রিশন আর ফিশারিজ রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট।
বিদেশে পড়াশোনা
ফিশারিজ সায়েন্স নিয়ে বিদেশে পড়াশোনার সুযোগও রয়েছে যথেষ্ট। বেশ কিছু নামী বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেখানে এই বিষয়টি পড়ানো হয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আমেরিকার ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটি। এছাড়াও রয়েছে ইউনিভার্সিটি অব বোহেমিয়া, এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, আটলান্টিক টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি ইত্যাদি। অ্যাকোয়াকালচার, মেরিন বায়োলজি, ওশানোগ্রাফিসহ নানা কোর্স রয়েছে এই সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। ডিগ্রি কোর্স ছাড়াও মাস্টার্স বা পিএইচডি করার সুযোগও রয়েছে। মিলতে পারে স্কলারশিপও। প্রায় প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়েই ১ থেকে ২ হাজার ডলার স্কলারশিপের ব্যবস্থা আছে। কোথাও এনট্রান্স টেস্টের ব্যবস্থা নেই। অ্যাডমিশন নোটিস দেখে আবেদন করতে হবে।
চাকরির বাজার
ফিশারিজ সায়েন্সে যেহেতু এখনও প্রতিযোগিতা অনেকটাই কম, তাই চাকরির সুযোগ তুলনামূলকভাবে বেশি। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা যেহেতু কম, স্বাভাবিকভাবে উত্তীর্ণ ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাও কম। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে গ্র্যাজুয়েশন করলেই ফিশারি এক্সটেনশন অফিসার বা মৎস্য সম্প্রসারণ আধিকারিক পদে আবেদন করা যাবে। প্রত্যেকটা ব্লকে একজন করে মৎস্য সম্প্রসারণ আধিকারিক নিয়োগ করা হয়।
ওয়েস্ট বেঙ্গল পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মধ্যমে শুধুমাত্র ইন্টারভিউ দিয়ে এই পদে নিয়োগ করা হয়। মোটামুটিভাবে ২-৩ বছরের ব্যবধানে শূন্যপদ সৃষ্টি হলে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলে।
বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অনেক ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে অনেকসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের চুক্তি থাকে। সফল ছাত্র-ছাত্রীদের ক্যাম্পাসিংয়ের মাধ্যমে এইসব কোম্পানিতে চাকরি মেলে। এছাড়াও কিছু সরকারি প্রজেক্ট আছে যেখানে কাজের সুযোগ মেলে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ডব্লুবিএবিএমআইটি বা আদমি প্রজেক্টে ফিশারিজ এক্সপার্ট বা অ্যাসিস্ট্যান্ট ফিশারিজ এক্সপার্ট হিসেবে স্থায়ী বা অস্থায়ী পদে চাকরির সুযোগ রয়েছে। সেন্ট্রাল রিসার্চ স্টেশন যেমন সিএমএসআরআই-এরও নানা প্রজেক্ট আছে। সেখানেও প্রজেক্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট, প্রজেক্ট অ্যাসোসিয়েট বা সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, এম প্রফেশনাল ১ বা এম প্রফেশনাল ২ হিসেবে কাজের সুযোগ থাকে। তবে এই পদগুলি সবই অস্থায়ী বা চুক্তিভিত্তিক।
এছাড়াও যদি বিদেশে চাকরি করার চিন্তাভাবনা থাকে তাহলে অ্যাকোয়াকালচারিস্ট, ফিশফার্ম ম্যানেজার, হ্যাচারি টেকনোলজিস্ট, মেরিন বায়োলজিস্টের মতো পদে কাজের সুযোগ থাকে। চার বছরের ডিগ্রি কোর্স পাশ করলেই এই সমস্ত চাকরি পাওয়া যায়। এবার যদি উচ্চশিক্ষার কথা ধরি (মাস্টার্স বা পিএইচডি) ডিগ্রি কমপ্লিট করলে সরকারের বিভিন্ন কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্রে এসএমএস বা সাবজেক্ট ম্যাটার স্পেলাশিষ্ট হিসেবে কাজের সুযোগ পাওয়া যায়। রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ বিভিন্ন ফিশারিজ কলেজে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে কাজের সুযোগ পাওয়া যায়।
কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে মৎস্য বিজ্ঞানী হিসেবে কাজের সুযোগ পাওয়া যায়। সর্বাপেক্ষা ভালো চাকরি হল এগ্রিকালচারাল রিসার্চ সায়েন্টিস্ট বা এআরএস। এছাড়াও ব্যাঙ্ক বা কমবাইন্ড গ্র্যাজুয়েট লেভেল (সিজিএল) চাকরির পরীক্ষাতেও অবশ্যই বসা যায়। আবার বিদেশেও উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও চাকরির অনেক সুযোগ রয়েছে।
নিজস্ব ব্যবসা
ফিশারিজ সায়েন্স নিয়ে পড়ে বাঁধাধরা চাকরি না করে অন্ত্রপ্রনর হিসেবেও কেরিয়ার গড়ে তুলতে পারে। প্রথমে একটা ছোট ফার্ম করে পরে তার এক্সটেনশন করা যেতেই পারে। বিভিন্ন অর্নামেন্টাল মাছ চাষ করা, তাকে বাজারজাত করা বা অ্যাকোয়ারিয়াম সেটআপ তৈরি করাও লাভজনক হতে পারে।
সহযোগিতায় চন্দন পাল