ব্যবসার গতি ও বেচাকেনার সঙ্গে লাভও বাড়বে। মানসিক অস্থিরতা থাকবে। শত্রু সংখ্যা বাড়বে। ... বিশদ
আরাম ও আরোগ্যে এগিয়ে রোবটিক
একটা গল্প বলি বরং!
ধরুন, একটি পাড়ায় জঙ্গি লুকিয়ে আছে। পুলিস বোমাবাজি করছে। একটি বোমার আঘাতে পাড়ার দু’-তিনটি বাড়ি ভেঙে গেল। বেশ কিছু পাড়ার লোকজনও মারা গেল। দেখা গেল, যে জঙ্গিদের মারতে পুলিস এসেছিল, তারা মরলেও সঙ্গে কিছু নিরপরাধ লোকজনেরও প্রাণ গেল।
এবার পদ্ধতি একটু উন্নত হল। দেখা গেল, পুলিস এমন পদ্ধতিতে জঙ্গি নিকেশ করছে, যাতে নির্দিষ্ট যে বাড়িতে জঙ্গিটি লুকিয়ে, সেটিই শুধু ভেঙে পড়ল। অন্য কোনও বাড়ির ক্ষয়ক্ষতি হল না। তবে সেই বাড়িতে থাকা নিরপরাধ লোকজন দু’-একজন মারা গেলেন। এতে ক্ষতির পরিমাণ অনেকটা কমানো গেল।
যুগ বদলেছে। পুলিসি অভিযানও বদলেছে। এবার এমন যন্ত্রপাতিতে পুলিস জঙ্গি খতম করে যে ঠিক যে ঘরে সে লুকিয়ে আছে, সেখানে ঢুকে শুধুমাত্র জঙ্গিটিকেই গ্রেপ্তার করে বা মেরে ফেলে। ওই বাড়ি তো ছাড়, ঘরে থাকা অন্য কোনও নিরপরাধের কোনও ক্ষতি হয় না।
গল্পের প্রথম ভাগটিকে যদি ওপেন অপারেশন ধরা হয়, দ্বিতীয়টি তবে ল্যাপেরোস্কপিক সার্জারি ও তৃতীয়টি অবশ্যই রোবোটিক সার্জারি।
কাকে বলে রোবটিক সার্জারি?
মানুষের হাত ও চোখের উপর ভরসা করে অস্ত্রোপচার হওয়াটাই দস্তুর হয়ে উঠেছিল। তারপর বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে অপারেশনের বেদনা, রক্তপাত কমাতে ও অস্ত্রোপচারকে আরও নিখুঁত করে তুলতে ল্যাপারোস্কপির উপর ভরসা করা শুরু হল। একটা সময় ল্যাপারোস্কপির কিছু কিছু অসুবিধা দূর করতে আরও উন্নত মানের রোবটিক সার্জারি নিয়ে আসা হল। এটি এমন একটি অস্ত্রোপচার পদ্ধতি, যেখানে রোবটিক সার্জারি সিস্টেমের সাহায্য নেওয়া হয়। চিকিৎসকরা একটি রোবটিক হাতের সঙ্গে সংযুক্ত খুব ছোট একটি সরঞ্জাম ব্যবহার করে অস্ত্রোপচার করেন। রোবটিক আর্ম কম্পিউটারে বসে নিয়ন্ত্রণ করেন সার্জেন স্বয়ং। এই ধরনের সার্জারির মাধ্যমে আরও সুনির্দিষ্ট ও নিখুঁতভাবে অস্ত্রোপচার করা যায়।
কেন করব?
গত দু’বছরে গোটা বিশ্বে প্রায় ২০০ কোটি রোবটিক অস্ত্রোপচার হয়েছে। দিনে দিনে এই ধরনের সার্জারির জনপ্রিয়তা বাড়ছে। ল্যাপেরোস্কপির তুলনায় এই অস্ত্রোপচার বেছে নেওয়ার নেপথ্যে অনেকগুলো কারণ আছে।
• ল্যাপেরোস্কপিতে ব্যবহৃত ক্যামেরার চোখ দ্বিমাত্রিক। আবার রোবটের চোখ মানুষের মতোই ত্রিমাত্রিক। তাই রোবটের চোখ অবশ্যই ল্যাপারোস্কপির ক্যামেরার চেয়ে বেশি দেখবে।
• মানুষের চোখের চেয়ে প্রায় ১০-৪০ গুণ জুম করে রোবটের চোখ দিয়ে দেখতে পারেন সার্জেন। ফলে অস্ত্রোপচারের জায়গার সূক্ষ্ম শিরা-উপশিরা পর্যন্ত দেখা যায়।
• রোবটিক সার্জারিতে রক্তপাত অনেক কম হয়। নামমাত্র রক্তপাতেই সারা যায় অস্ত্রোপচার।
• এই পদ্ধতিতে যেহেতু রোবটের সূক্ষ্ম আঙুলের সাহায্যে অস্ত্রোপচার সারা হয়, তাই অস্ত্রোপচারের সময় আনুষঙ্গিক ব্যথা-বেদনা ও অন্যান্য অঙ্গে চাপ পড়া এড়ানো যায়।
• রোবটিক সার্জারিতে যেহেতু রক্তপাত খুব কম হয় ও ব্যথা-বেদনা প্রায় থাকে না, তাই রোগীর আরোগ্য তড়িৎগতিতে হয়। জটিল হার্নিয়া বা গলব্লাডার স্টোন অপারেশনের পর চার-পাঁচদিনের মাথায় রোগী সুস্থ হয়ে অফিসে যোগ দিয়েছেন, এমন উদাহরণও আছে।
• অনেক সময় দেখা যায়, কোনও এক রোগীর বেলায় চিকিৎসক ঠিক করলেন ল্যাপারোস্কোরি করবেন। কিন্তু অপারেশন করতে গিয়ে জটিলতা এল। রোগী ওপেন সার্জারি করতে বাধ্য হলেন। রোবটিক উপায়ে সার্জারি হওয়ার কারণে এই ধরনের জটিলতা আসবে কি না, তা আগে থেকেই বোঝা যায়। কার্যক্ষেত্রে কোনও সমস্যা হয় না।
কী কী অপারেশন সম্ভব?
কোলোরেক্টাল অর্থাৎ কোলন বা রেক্টাল রিসেকশন, মেদ ঝরানোর বেরিয়াট্রিক সার্জারি, গলব্লাডারে স্টোন, হার্নিয়া-সহ গাইনোকলজি বিভাগে এন্ডোমেট্রিওসিস, বিনাইন হিস্টেরেক্টমি, ফাইব্রয়েড বাদ দেওয়া, পেলভিক অঙ্গের নানা অপারেশন এর সাহায্যে করা যায়। এছাড়াও জিভের সাধারণ কিছু অপারেশন, লাং সার্জারি, কিডনি, প্রস্টেটের কিছু অস্ত্রোপচারও রোবটিক সার্জারির মাধ্যমে করা সম্ভব।
অসুবিধা কী কী?
এই ধরনের অস্ত্রোপচারে রোগীর শারীরিক অসুবিধা প্রায় নেই বললেই চলে। তবে এই প্রযুক্তি যেহেতু বিশ্বে বছর কয়েক হল প্রচলিত হয়েছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই এটি ব্যয়বহুল। সবক্ষেত্রে সকলে এই সুবিধা নিতে পারেন না। কিছু কিছু স্বাস্থ্যবিমা এই ধরনের অস্ত্রোপচারের ব্যয়ভার বহন করতেও চায় না। এছাড়া রোবটিক সার্জারিতে প্রশিক্ষণ লাভ করেছেন এমন চিকিৎসকের সংখ্যাও বর্তমানে কম। ফলে সব হাসপাতালে এই সুবিধা মেলে না। নইলে রোগীর শরীর ও আরোগ্যের প্রশ্নে সবসময়ই রোবটিক সার্জারি এগিয়ে থাকবে। চিকিৎসকরা নিজেও নিজের বা তাঁর নিকটজনের ক্ষেত্রে এই ধরনের সার্জারিই বেশি পছন্দ করেন।
পদ্ধতি নয়, আসল কথা চিকিৎসকের জ্ঞান
কদিন আগেই অজিতবাবু জানতে পেরেছেন, তাঁর গলব্লাডার স্টোনের অপারেশেন করাতে হবে তাড়াতাড়ি। সেইমতো হাসপাতালে ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া, অফিসে ছুটির ব্যবস্থা করা চলল কিছুদিন। কিন্তু অপারেশনটা হবে কীভাবে? ওপেন করে না ল্যাপারোস্কপি? নিজেই ইন্টারনেটে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে আবার জানতে পারলেন রোবটিক সার্জারির কথাও। এছাড়া, অফিসে, বাড়িতে, পাড়ার আড্ডায়—নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন, কনভেনশনাল সার্জারির কথা, কেউ আবার নয়া প্রযুক্তির পক্ষে। সব মিলিয়ে অজিতবাবু ঘেঁটে ঘ!
অপারেশনের প্রয়োজন হলে আমাদের সকলকেও অজিতবাবুর মতো দ্বিধায় পড়তে হয়। অপারেশন তো আর মুদির দোকান থেকে বিস্কুট কেনা নয় যে, ভালো না লাগলে পাল্টে নেওয়া যাবে। তাহলে কোন পদ্ধতিটা সবচেয়ে সুরক্ষিত, সবচেয়ে ভালো? প্রশ্নটা শুনে অবশ্য হেসেই ফেলেন বিশিষ্ট সার্জেন ডাঃ শুদ্ধসত্ত্ব সেন। তাঁর জবাব, ‘এভাবে ভালো খারাপ তো হয় না। সুরক্ষিত সবই। তবে নতুন নতুন প্রযুক্তি আসবেই। ঠিক যেমন কদিন অন্তর বাজারে নতুন গাড়ি আসে। তাতে কত নয়া প্রযুক্তি। কিন্তু গাড়িটা তো মানুষকেই চালাতে হয়। তেমন যে পদ্ধতিই হোক, অপারেশনটাও চিকিৎসকই করেন।’
কিন্তু এই যে প্রযুক্তি, এর ফলে তো চিকিৎসাশাস্ত্রের তো প্রচুর উন্নতি। তাহলে কনভেনশনাল অপারেশন মানুষ করবে কেন? ডাঃ সেন বললেন, রোবটিক সার্জারির কিছু সুবিধা আছে, সেটা অস্বীকার করব না। তবে তা এখনও বহুল পরীক্ষিত নয়। যে কোনও জটিল অপারেশন কিন্তু এখনও রোবোটিক ভাবে নয়, চিরাচরিতভাবেই করা হয়। একটা জটিল ক্ষেত্রে ডাক্তারের নিজের হাতে কোনও অপারেশন করার বিকল্প আর কিছু হতে পারে না। তিনি আরও বলেন, একটি রোবটিক সার্জারিতে যে সময় লাগে, তাঁর থেকে ল্যাপারোস্কপি বা ওপেনে অনেকটা কম সময় লাগে। তার অপর এই রোবটিক সার্জারির খরচ অনেক বেশি। সাধারণ মানুষের পক্ষে তা এই মুহূর্তে ধরাছোঁয়ার বাইরেই একপ্রকার। কেউ কেউ বলবেন, ওপেনে রিকভারি টাইম তো অনেক বেশি। সেক্ষেত্রে কম জটিল অপারেশনে ল্যাপারোস্কপি করানো যেতে পারে। তবে তারও সীমাবদ্ধতা আছে। মস্তিষ্ক, হার্ট বা অন্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের জটিল অপারেশনের ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে রোবটিকের থেকে কিন্তু ওপেন সার্জারি অনেকটাই এগিয়ে। তাহলে ইন্টারনেট খুললেই যে রোবটিক সার্জারির এতো স্তুতি? ডাঃ সেনের উত্তর, কোনও জিনিস নতুন এলে তাঁকে নিয়ে একটু হইচই তো হবেই। আর এই সার্জারির যন্ত্রপাতিও বহুমূল্যের। ফলে তার বিজ্ঞাপনও তো বেশি হওয়াটাই স্বাভাবিক। সবচেয়ে বেশি দরকার চিকিৎসকের সঠিক জ্ঞান। তা না হলে, হাইটেক প্রযুক্তি এনেও কোনও লাভ হবে না।
তাহলে ভবিষ্যৎ কী? ডাঃ শুদ্ধসত্ত্ব সেন বললেন, ওপেনের কোনও বিকল্প হতে পারে না। ওপেন সার্জারি থাকবেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স চিকিৎসাক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।