ব্যবসার গতি ও বেচাকেনার সঙ্গে লাভও বাড়বে। মানসিক অস্থিরতা থাকবে। শত্রু সংখ্যা বাড়বে। ... বিশদ
হঠাৎ এই ভয় এবং তার জেরে প্রধানমন্ত্রীর ‘ন্যারেটিভ’ বদল ইতিমধ্যেই নির্বাচনী পণ্ডিতদের ভাবাচ্ছে। প্রথম দফার ভোটের পর গত রবিবার রাজস্থানের সভা থেকেই রাষ্ট্রনেতার মুখে যেন আর কোনও আগল নেই। নির্বাচন কমিশনও দেখেও কিছু দেখছে না, নীরব দর্শক। দায় এড়াতে শুধু নাড্ডাজির কৈফিয়ত তলব করেই দায়িত্ব এড়াচ্ছে। যিনি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন গুজরাত দাঙ্গা হয়েছে এবং ‘হাম পাঁচ হামারে পচ্চিস’ স্লোগানই যাঁর রাজনৈতিক উত্থানের প্রধান অনুঘটক তাঁর কাছ থেকে এর বেশি আর কী আশা করা যায়। উত্তরপ্রদেশে ২২ জানুয়ারির রামমন্দির উদ্বোধনের রেশ কখন উধাও হয়ে গিয়েছে, তার ঠিক ঠিকানা নেই। উল্টে রাজপুত-জাঠ দ্বন্দ্ব পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে বিজেপিকে বেজায় অস্বস্তিতে ফেলেছে। ফুঁসছে গুজ্জররাও। এর রেশ ছড়াচ্ছে অন্যত্রও। হিন্দি বলয়ে যাদব, কুর্মি, ভূমিহার ভোটের সিংহভাগই যে বিজেপির দখলে থাকবে, তাও হলফ করে বলা যাচ্ছে না। বারবার গিয়েও মোদির পক্ষে দক্ষিণের দ্রাবিড় রাজনীতিতে দাঁত ফোটানো সম্ভব হয়নি। খবর আসছে, কংগ্রেসকে খতম করতে গিয়ে রাজ্যে রাজ্যে ফল হয়েছে উল্টো। ছোট ছোট দলগুলি অক্সিজেন পেয়ে গিয়েছে। গোয়েন্দা রিপোর্ট বলছে, বিভিন্ন রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলি এবার ভালো ফল করতে চলেছে বিজেপির ভোট কেটে। সঙ্গে এই প্রচণ্ড গরম এবং আড়াই মাসের ক্লান্তিকর ভোটপর্ব। এতটা দীর্ঘ সময় কারও পক্ষে টেম্পো ধরে রাখা অত্যন্ত কঠিন। বাংলা, মহারাষ্ট্র, বিহার, ঝাড়খণ্ড, পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও দিল্লি এবং অবশ্যই দক্ষিণ ভারত থেকে বিজেপির গ্রাউন্ড রিপোর্ট ও সঙ্ঘের খতিয়ানও মোটেই আশানুরূপ নয়। তামিলনাড়ু, কেরলে এবারও শূন্য হাতেই থামতে হচ্ছে। কর্ণাটক, তেলেঙ্গানায় আসন কমবে। আসন কমতে পারে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশেও। মহারাষ্ট্রের রাজনীতি সম্পূর্ণ ঘেঁটে গিয়েছে গেরুয়া শক্তিরই খামখেয়ালিপনায়। জটিল জাতপাতের সমীকরণ এমন পর্যায়ে যে মহারাষ্ট্রের মানুষ এবার খুব বেশি আশীর্বাদ করবে না কোনও একটি দলকে। মারাঠা ভূমে বত্রিশভাজা ভোটভাগের সুফল কে শেষ পর্যন্ত ঘরে তুলবে, তার হদিশ কারও কাছেই নেই।
এই পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে ভোটারের নাড়ি টিপে বেড়াচ্ছেন একজনই, নরেন্দ্র মোদি। রাজ্যে রাজ্যে একবার নয়, একাধিকবার নামছে তাঁর ধুলো ওড়ানো বিমান, কপ্টার, অলিগলিতেও ছুটছে কনভয়। জনগণের মন পড়তে পারছেন কি? দল ও সরকারের দু’নম্বর মুখ অমিত শাহ দেরিতে হলেও প্রচারে নেমেছেন বটে, আসরে রাজনাথ, স্মৃতি ইরানি, অনুরাগ ঠাকুররাও আছেন, কিন্তু সূর্যের তেজের পাশে বাকি সবাই বড্ড ম্লান। তিনি কথা দিয়েছেন, সারা দেশে দেড়শোর উপর সভা করবেন। কিন্তু নতুন কথা কী বলবেন? একই কথার ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তিতে তাঁর মুখ, অবয়ব ক্রমেই ক্লিশে। দু’দফার ভোটের পর ইনটেলিজেন্স রিপোর্টেও তাঁর আত্মবিশ্বাস কোথাও যেন ধাক্কা খাচ্ছে। ভোট কম পড়ার কারণ নিয়েও নানা মুনির নানা মত। এক সমীক্ষার সঙ্গে অন্যের হিসেব মিলছে না। দু’দফায় মাত্র ১৯০ আসনে ভোট হয়েছে। আরও পাঁচ দফার মতদান বাকি। প্রথম দফায় ভোটের শতাংশ কমে যাওয়ায় উল্টে একটা ভয় চেপে বসেছে যেন। এটা ঠিক, আমরা কেউ ভবিষ্যৎদ্রষ্টা নই। আসলটা জানা যাবে ৪ জুন দুপুরেই। তার আগে শুধুই সম্ভাবনা আর আশঙ্কার দু’শো কাটাকুটি। কিন্তু মোদিজির কদর্য ভাষার সঙ্গে হঠাৎ বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বদলে যাওয়াতেই একটা অজানা ভয় দানা বাঁধছে যেন।
কিন্তু যিনি তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর, যিনি স্বঘোষিত ‘বিশ্বগুরু’, বারে বারে বলেন, গত দশ বছরে নাকি বৈদেশিক রাজনীতির মানচিত্রে অতীত জমানার তুলনায় অনেক বেশি সমীহ আদায় করতে সক্ষম হয়েছে নতুন ভারত। সেই তথাকথিত ‘নয়া ভারতের রূপকার’ ভোটের স্বার্থে ঘোমটা খসিয়ে খুলে আম বিভাজনের বিষবৃক্ষ রোপণ করবেন, কে ভেবেছিল! এখানেই তিনি থামেননি। এরপরই সবাইকে চমকে দিয়ে বলেছেন, তাঁর এই আশঙ্কার কারণ মনমোহন সিংয়ের ১৮ বছর আগের একটি আপাত নিরীহ মন্তব্য এবং এবারের কংগ্রেস ইস্তাহারের একটি বাক্যবন্ধ। ইউপিএ জমানাতেও জাতীয় উন্নয়ন পর্ষদ (ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল) নামে একটি সংস্থা ছিল। মোদি জমানায় যোজনা কমিশনের (প্ল্যানিং কমিশন) মতোই তাও একপ্রকার বিলুপ্তই বলা চলে। তারই ৫২তম বার্ষিক সভায় ২০০৬ সালের ৯ ডিসেম্বর মনমোহন বলেছিলেন, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে সব গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়কে সমানভাবে শামিল করতে হবে। তাঁর অপরাধ ওইটুকুই। ইনক্লুসিভ গ্রোথের পক্ষে সওয়াল। কৃষক, শ্রমিক, সংখ্যালঘু, পিছড়ে বর্গ সবাইকে রাষ্ট্রের উন্নয়নে শামিল করার কথা বলতে গিয়ে শেষে বলেছেন একটি বাক্য। পিছিয়ে পড়াদের এগিয়ে নিয়ে যেতে দেশের সম্পদে মুসলমানদেরই প্রথম অধিকার। আগের অংশটি না বলে শুধু ওই একটি বাক্যকে তুলে এনে হিন্দু-মুসলিম কার্ড খেলা কোনও পোড়খাওয়া রাষ্ট্রনায়কের কাছে কি আশা করা যায়? মনমোহন কী বলেছিলেন সেদিন: ‘ The component plans for schedule castes and tribes will need to be revitalised. We will have to devise innovative plans to ensure that minorities, particularly muslim minority, are empowered to share equitably in the fruits of development. They must have the first claim on our resources.’ এই গোটা বক্তব্যে কোথাও হিন্দুদের ধনসম্পদ কেড়ে সংখ্যালঘুদের দেওয়ার কথা বলা আছে কি? নাকি মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নেওয়ার প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে? বরং ঠিক উল্টোটাই। আদর্শ নেতার মতোই সংখ্যালঘুসহ সমাজের দুর্বলতর অংশের ক্ষমতায়নের অঙ্গীকার করা হয়েছে। এই গোটা বক্তব্যকে ধার করেই তো নরেন্দ্র মোদি আজ ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশের’ বুলি কপচাচ্ছেন। অস্বীকার করার উপায় নেই, মনমোহনজির একশো দিনের কাজই আজ গ্রামীণ ভারতের বেকারত্বের জ্বালা কিছুটা হলেও জুড়োতে সক্ষম হয়েছে।
আসলে বাস্তব কোনও সমস্যাকে না ছুঁয়ে আবারও শুধু একটা কৃত্রিম বাতাবরণ তৈরি করে কুর্সি দখলের কিছু ‘সাইড এফেক্ট’ তো থাকবেই। বিশেষ করে তিনি যখন ঠান্ডাঘরে বসে দেশ চালান না, ঘুরে ঘুরে ভাত কতটা সেদ্ধ হয়েছে নিজেই পরখ করে দেখেন। কিন্তু তিনি এও জানেন ধর্ম, মন্দির এবং বিভাজনকে স্টেরয়েড হিসেবে ব্যবহার করলে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি অনিবার্য। কোনও ওষুধ আর কাজ করবে না। তা থেকেই একটা অজানা ভয় মোদিজিকে তাড়া করছে। যদি না-হয়, যদি হিসেব উল্টে যায়, যদি রাজ্যপাট হাতছাড়া হয়, এমনই কু ডাকছে মন। আর তা ঢাকতেই সরাসরি হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের রাজনীতির নিরাপদ ঘেরাটোপে আশ্রয় নিতে চাইছেন ভোটের ভরা মরশুমে। কী ভাষার শালীনতা, কী দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা—সবই আজ ব্রাত্য! এটাই দেশের চরম দুর্ভাগ্য। যিনি তৃতীয়বার দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসীন হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, তাঁর পক্ষে এমন নিম্নরুচির শব্দ ও বিভাজনের খুল্লামখুল্লা বিষ ছড়ানো কি সভ্য নাগরিক সমাজ মেনে নিতে পারে?
এবং, যে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য তুলে ধরে তিনি এই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন, এক মুহূর্তের জন্য দীর্ঘ রাজনৈতিক কেরিয়ারে তাঁকে ‘জিব ছুট’ হয়ে কোনও অপশব্দ উচ্চারণ করতে দেখা যায়নি—শত্রু, মিত্র কারও সম্পর্কেই। মনমোহন সিংয়ের সমালোচনা করতে গিয়ে ‘দুর্বল’, সোনিয়া রাহুলের ‘তল্পিবাহক’, ‘মেরুদণ্ডহীন’, এমন অনেক অপশব্দ তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকী, তাঁর মন্ত্রিসভার অর্ডিন্যান্স পর্যন্ত তাঁর দলেরই শীর্ষ নেতা প্রকাশ্যে ছিঁড়ে দিয়েছেন বলেও বিতর্ক কম হয়নি। সেদিনও মার্কিন মুলুকে বসে তিনি নির্বিকার ঠান্ডা। সমালোচনা যতই হোক, কেউ বলতে পারবেন না যে ব্যক্তিগত স্তরে তিনি কখনও ভোটের স্বার্থে হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের রাজনীতিকে ব্যবহার করেছেন, কিংবা দাঙ্গা বাধিয়ে হানাহানির ফসল ঘরে তুলেছেন, অথবা বুকের ছাতি ফোলানোর মিথ্যে প্রহসনে শামিল হয়েছেন! বলা বাহুল্য, এসব থেকে শতহস্ত দূরে ছিলেন বলেই বহু চেষ্টা করেও তাঁর সফেদ পাঞ্জাবিতে কাদা লেপতে আজও ব্যর্থ মোদির বিজেপি। বরং চারশো আসন জয়ের ‘খোয়াব’ মুখ থুবড়ে পড়তেই সচেতনভাবে তিনি ভয় দেখাচ্ছেন কুৎসিত ভাষায়। লজ্জার মাথা খেয়ে বলছেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে আপনার জমি, জায়গা, স্থাবর অস্থাবর তো বটেই সোনার মঙ্গলসূত্রটা পর্যন্ত বাঁচবে না। এক ধাক্কায় সব নিয়ে নেবে। কংগ্রেস সরকার সুচতুরভাবে তা কেড়ে নিয়ে নাকি যাদের বেশি সন্তান (ইঙ্গিতটা বুঝুন!), যাঁরা অনুপ্রবেশকারী (ঘুসপেটিও!) তাঁদের মধ্যে ভাগ করে দেবে। তাহলে কংগ্রেস শাসনের ৫৫ বছরে কত মঙ্গলসূত্র হিন্দুর ঘর থেকে মুসলমানের কাছে গিয়েছে, সেই হিসেবটা কি দেবেন গেরুয়া থিঙ্কট্যাঙ্করা?
এমন ভয়ঙ্কর মিথ্যেকে যিনি সত্যিতে পরিণত করতে পারেন, তাঁর সম্পর্কে সাবধান হোন। না-হলে সর্বনাশের আর দেরি নেই। গণতন্ত্র, সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা কিচ্ছু বাঁচবে না। অমৃতকাল শুধু বিদ্বেষ আর গরল বর্ষণেরই নির্মম সাক্ষী হয়ে থেকে যাবে।