ব্যবসার গতি ও বেচাকেনার সঙ্গে লাভও বাড়বে। মানসিক অস্থিরতা থাকবে। শত্রু সংখ্যা বাড়বে। ... বিশদ
এবারের লোকসভা কি এই হতাশা দূর করতে পারবে? প্রাথমিক খবরাখবর বলছে, ‘না’। পশ্চিমবঙ্গে প্রথম দফার প্রার্থীদের মধ্যে অর্ধেকেরই সর্বোচ্চ শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চ মাধ্যমিক। এক মহিলা প্রার্থী তো স্রেফ ‘সাক্ষর’! দু-পাঁচজন নিরক্ষর ব্যক্তিও সংসদে প্রবেশের খোয়াব দেখেন। ছবিটা পাল্টানো দরকার। কিন্তু এ কোনও জাদু নয়। উদ্যোগ কই? নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি শিক্ষাখাতে ব্যয়বরাদ্দ জিডিপির ৬ শতাংশ করতে বলেছে। কিন্তু সরকার বাহাদুরের দরাজ হাত দিয়ে এবছরও যে-বাজেট বরাদ্দ পেয়েছি আমরা তাও ৩ শতাংশের নীচে! অতএব, নয়া সংসদ ভবন আলো করে আমাদের যেসব জনপ্রতিনিধি বসবেন তাঁরা যে উচ্চশিক্ষিত এবং বিরাট বিবেক-বিচার-বুদ্ধি-সম্পন্ন হবেন, সেই পরিবেশ আর রচিত হল কোথায়? পাঁচতলা উঁচু এবং ১৪৩১ জন এমপি বসার সুবিধাযুক্ত ভবনটি নির্মাণের খরচ হয়েছে মোটামুটি সাড়ে বারোশো কোটি টাকা। এই ‘প্লাটিনাম রেটেড গ্রিন বিল্ডিং’ নিঃসন্দেহে ভারতের গর্ব।
আর এখানেই প্রশ্ন, এটি গণতন্ত্রের জন্য গর্বের হতে পারল কতখানি? সুন্দর ভবন, অত্যন্ত আরামদায়ক বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে যাঁরা বসছেন তাঁদের সকলে কি লাখো লাখো মানুষের প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্য? সংসদ ভবনে আলোচনার পরিকাঠামোটিও নিশ্চয় অনবদ্য! কিন্তু সেখানে নানা শ্রেণির মানুষের অজস্র সমস্যা এবং চাওয়া-পাওয়া নিয়ে যাঁরা আলোচনা করবেন, তাঁদের ক’জন বিষয়গুলি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল? ক’জন হোমওয়ার্ক করেন? ইতিবাচক উত্তর পাওয়ার আশা ক্ষীণ। শুধুমাত্র মানুষের ভোটে (সেটাও কিছু ক্ষেত্রে সন্দেহজনক) জেতার জোরেই গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ মন্দিরে প্রবেশাধিকার পান তাঁরা। অতঃপর আমরা কী দেখি? কিছু সদস্য স্রেফ বাজে বকে সদনের সময় নষ্ট করেন কিংবা ওয়াকআউট করেন। কেউ কেউ করে বসেন বিতর্কিত মন্তব্য। কিছু সদস্য অসংসদীয় ভাষা ব্যবহারেও লজ্জিত নন।
মোদিযুগে আরও একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য এই যে, সরকারও সংসদে সুষ্ঠু আলোচনা চায় না। নানা বিষয়ে জবাবদিহিতার বাধ্যবাধকতা এড়াতেই শাসক পক্ষের এই কৌশল। সব মিলিয়ে ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্র কেবলই গাছের ডগায় জল ঢেলে চলেছে। অযোগ্য মালির হাতে একটি বাগিচার গাছগাছালির যে করুণ দশা হওয়ার কথা, মোদির হাতে ভারতের সংসদ ঠিক সেই দশাপ্রাপ্ত হয়েছে।
শিক্ষাচিত্র বলে দিচ্ছে, নির্বাচনে শিক্ষা নিয়ে শর্ত আরোপের সময় এখনও আসেনি। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও মানুষ ভদ্র সভ্য মার্জিত রুচি ও বিবেক সম্পন্ন হতে পারে। ইতিহাসে বহু দেখেছি, আমাদের পরিবারে, প্রতিবেশেও তাঁদের সংখ্যা ন্যূন নয়। অথচ আইনসভাগুলিই হতাশ করছে প্রতিবার।
বিদায়ী লোকসভা এবং রাজ্যসভার এমপিদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস (এডিআর) এবং ন্যাশনাল ইলেকশন ওয়াচ (নিউ) জানাচ্ছে, ৪০ শতাংশ এমপির বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল কেস বা ফৌজদারি মামলা রয়েছে। ২৫ শতাংশ ফৌজদারি অভিযোগ অত্যন্ত গুরুতর! সেগুলির মধ্যে আছে খুন, খুনের চেষ্টা, অপহরণ এবং মহিলাদের সঙ্গে অপরাধের মতো জঘন্য কারবারও! এঁদের মধ্যে অনেকে এবারও ভোটযুদ্ধে শামিল। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে রয়েছেন স্পিকার ওম বিড়লা স্বয়ং। এই বিজেপি প্রার্থীও একটি ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত! মোদি মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য নীতিন গাদকারি এবারও লড়ছেন নাগপুর থেকে। উচ্চশিক্ষিত, আইনজ্ঞ নীতিনের নামে ফৌজদারি মামলার সংখ্যা ১০! এই দলে আছেন কংগ্রেসের এলিট প্রার্থী ডঃ শশী থারুরও—তাঁর নামে ক্রিমিনাল কেস নয় নয় করে ন’টি। তাঁকে পিছনে ফেলে দিয়েছেন কংগ্রেসের অলিখিত শীর্ষনেতা রাহুল গান্ধী (একটি পকসো-সহ ফৌজদারি মামলা ১৮টি)! বঙ্গে দ্বিতীয় দফার নির্বাচনের প্রার্থীদের মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। তাঁর নামে মামলার সংখ্যা ১৬ এবং সেগুলি চলছে মোট ৮৪টি ধারায়! কংগ্রেসের তরুণ প্রার্থী আলি ইমরান রমজ ওরফে ভিক্টর অভিযুক্ত তিনটি ফৌজদারি মামলায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ডেপুটি নিশীথ অধিকারীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার সংখ্যা ১৪। কোচবিহার আসনে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জগদীশচন্দ্র বর্মা বসুনিয়ার বিরুদ্ধে ঝুলে আছে চারটি ফৌজদারি মামলা। বিজেপির মনোজ টিগ্গা এবং তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূলের প্রকাশচিক বরাইক—দু’জনেই ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত। মহিলারাই-বা কম যান কোথায়? বেঙ্গালুরু দক্ষিণের বিজেপি প্রার্থী সৌম্যা রেড্ডিও ছয়-ছয়টি ফৌজদারি মামলা নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। তবে এই তালিকা দীর্ঘ করে লাভ নেই। এর তল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
আক্ষেপ এটাই যে, ভোটারদের চুজি হওয়ার অবকাশ সামান্যই? সেক্ষেত্রে তো ‘নোটা’র বোতাম টিপেই ঘরে ফিরতে হয়! ধরেই নেওয়া হচ্ছে, এঁদের অনেকেই জিতছেন। নিষ্কলুষ এমপিরা কি ডুমুরের ফুল হয়েই থাকবেন? স্বচ্ছ ভাবমূর্তির প্রার্থী তো চাওয়াই যায়। স্বচ্ছতার পাঠ নিতে পয়সা এবং প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন নেই। কিন্তু বহু প্রার্থী এবং তাঁদের সমর্থকদের কুভাষণ প্রচারের পরিবেশটাকে কলুষিত করে তুলছে। এর প্রভাব পরিবেশ দূষণের চেয়ে কম নয়। কিন্তু কোনও দল কি স্বচ্ছ ভাবমূর্তির প্রার্থী দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে? অথচ ভোটের বিনিময়ে কম দামে ভালো মদ খাওয়াবার প্রতিশ্রুতি আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি! ‘স্পর্শকাতর’ বুথের সংখ্যা ক্রমার্ধমান। যেমন এবার বাংলায় প্রথম দফার ভোটের সব বুথই ‘স্পর্শকাতর’ ছিল নির্বাচন কমিশনের খাতায়! এর পিছনে এই প্রার্থীচিত্র অনেকাংশেই দায়ী বইকি। এমন দিন হয়তো আসবে, কলঙ্কশূন্য প্রার্থী দেওয়ার দাবি জানাবে নাগরিক সমাজ। যেমন পরিবেশ রক্ষার দাবি জানিয়ে ‘ইস্তাহার’ প্রকাশ করেছে সবুজ মঞ্চ।
ফৌজদারি মামলাগুলি যেন কিছু প্রার্থীর কাছে ‘অলঙ্কার’! এত এত অভিযোগ এবং মামলা প্রসঙ্গে প্রশ্ন রেখে বহু প্রার্থীর কাছ থেকে তেমনই প্রতিক্রিয়া মেলে। তাহলে কি ধরে নিতে হবে, মারাত্মক অপরাধ করেও পার পাওয়ার সুযোগ আছে ভারতীয় আইনে—বিশেষ করে যখন ওয়াশিং মেশিন তত্ত্ব জাঁকিয়ে রাজ করছে!
বিভিন্ন রাজনীতিকের ব্যক্তিগত মামলা নিয়ে আলোচনার পরিসর এটা নয়। তবুও প্রশ্ন, তাঁরা যে ধরনের ফৌজদারি মামলা নিত্য আহ্বান করেন তার সবগুলিই কি অনিবার্য? যে-দেশ সারা পৃথিবীকে সত্যাগ্রহ ও অসহযোগ আন্দোলনের চমৎকারী শিখিয়েছে সে-দেশের কাছে এগুলি অনেকাংশেই অবাঞ্ছিত। যেমন ধরুন থানা এবং হাসপাতাল প্রভৃতিতে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া। থানা ও হাসপাতাল কখনও কি বন্ধ করা উচিত? যেসব নেতার বাড়ি থেকে কাঁড়িকাঁড়ি টাকা কিংবা বোমা ও বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয় তাঁরা কি আদৌ রাজনীতিতে থাকার যোগ্য? হত্যা, গুপ্তহত্যা, বেআইনি নিয়োগ, বেআইনি নির্মাণ প্রভৃতিতে ইন্ধন কি সুস্থ রাজনীতির অংশ? রাষ্ট্রদ্রোহ এবং গরিবের প্রাপ্য খাদ্য, মজুরি প্রভৃতি চুরি, স্বজনপোষণ, যোগ্যতরকে বঞ্চনা, আদিবাসীদের জমি আত্মসাৎ, পাহাড়-জঙ্গল নির্বিচারে নির্মূলকরণ, সর্বোপরি দুর্বলের উপর অত্যাচারের অভিযোগও কম নেতার বিরুদ্ধে নেই।
আর হামেশা অভিযোগ ওঠে, ভোট-প্রচারে হামলা, প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলের এজেন্ট অপহরণ এবং ভোটে হারের বদলা নানা নৃশংস কায়দায় গ্রহণ। প্রার্থী-তালিকায় এমন-কিছু মানুষও তো ‘উজ্জ্বল’! অনেকের দাবি, রাজনীতিতে এসব স্বাভাবিক! তাহলে যাকে তাকে যেমন খুশি অভিযোগে বেঁধা যায়! দেশের আইন সেই অবকাশ রেখেছে তাহলে? আচ্ছা, ফৌজদারি আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সরকারি চাকরি করতে পারবেন? তাতে বাধা থাকলে ফৌজদারি আইনে অভিযুক্ত নেতারা ভোটে জিতে এসে আইন প্রণয়নের অধিকারী হতে পারেন কোন যুক্তিতে? আইন তো সবার আগে তাঁদেরই মানার কথা। তাঁদের স্থান আইনের রক্ষাকর্তাদেরও উপরে। তাঁরাই এসব আইন তৈরি করেছেন সুস্থ সমাজ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। নিজেদের তৈরি আইনকে নিজেরাই বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছেন নাকি? একজন নেতা বা রাজনৈতিক কর্মীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ আনার ক্ষেত্রে আইনে লাগাম থাকবে না কেন? সেই অভিযোগ মিথ্যা বা ষড়যন্ত্রমূলক হলে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কেন নেবে না আদালত? তেমন অভিযোগকারী খোদ সরকারি প্রশাসন হলেও তাকে সমঝে দেওয়া হবে না কেন? ফৌজদারি অভিযোগ নিয়ে রাজনীতির কারবারিদের এই ডোন্ট কেয়ার অ্যাটিটিউড সমাজকে ধ্বংস করে দিতে পারে। একজনের মনে হতেই পারে, আইন আসলে দুর্বলকে শায়েস্তা করার জন্য, প্রভাবশালী অত্যাচারীকে রুখতে নয়। সারা জীবনে একটিও ফৌজদারি মামলায় ঝুলে গেলে, একজন ‘সাধারণ’ মানুষ পাড়ায় কিংবা অফিসে মুখ দেখাবেন কী করে ভেবে পান না। এজন্যই রাজনীতির কারবারিরা ‘অসাধারণ’! এরপর কি অপরাধ/দুর্নীতি/ফৌজদারি মামলাকে ‘হালাল’ ধরেই এগতে থাকবে সমাজ?