কর্ম নিয়ে স্থানান্তর গমনে সাফল্যের যোগ। কর্মে স্থানগত বা সংস্থাগত পরিবর্তন অসম্ভব নয়। পারিবারিক ক্ষেত্রে ... বিশদ
—জার্মানির সময়ে বিকেল পাঁচটা।
বলতেই স্যার ভয় পেয়ে বললেন, ‘বিকেল পাঁচটা!’ তবে আমি গুরুত্ব দিইনি। উল্টে স্বাভাবিক হয়েই বললাম, ‘এই ঠান্ডায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে আপনি? ঘরে বসলেই তো হয়!’
—আজ বাদে কাল জার্মানি যাচ্ছ, ওখানকার টেম্পারেচার জানো?
স্যারের কথাটা শুনে আমার বেশ বিরক্তই লাগল। রাতটা একটু ভালো করে ঘুমোতে চাইছিলাম। স্যার যেন মনের কথাটা বুঝতে পারলেন। আর সেজন্যই তাড়াহুড়ো করে ‘তোমাকে কিছু বলার আছে’ বলেই বলতে শুরু করলেন—
‘হাইডেলবার্গ ছাত্র-শিক্ষকে ভরপুর একটা শহর। পড়াশোনার জন্য বিখ্যাত। অনেকবার গিয়েছি। বিভিন্ন গেস্ট হাউস, ইয়ুথ হস্টেলে থেকেওছি। তা সেবারেও সেমিনার ছিল। এডিনবরা থেকে ফ্রাঙ্কফুর্টে পৌঁছলাম জার্মানির সময় দুপুর তিনটেতে। কিন্তু ট্রেনে করে হাইডেলবার্গে ঢুকতে একটু দেরি হয়ে গেল। হাইডেলবার্গে যখন পৌঁছলাম তখন সূর্য ডুবে গিয়েছে, তুষারপাত হচ্ছে ঝিরঝিরে। গাড়ি প্রস্তুতই ছিল। ড্রাইভারকে আমার কার্ড আর আমন্ত্রণপত্র দেখাতেই ভ্রু কুঁচকিয়ে বলল, ‘এখন যাবেন?’ প্রশ্নটাতে মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল। এই তুষারপাতের বাজারে গেস্ট হাউসে যাব না তো কি রাস্তায় ঘুরব! তবে বলিনি কিছু। চুপচাপ চেপে বসেছিলাম গাড়িতে। গাড়িটা নেকার নদীর উপরের ওল্ড ব্রিজ দিয়ে ওল্ড সিটির দিকে অনেকটা এগিয়ে একটা শুনশান জায়গায় ঢুকতেই তুষারপাতটা বাড়ল। ভয়ভয় করছিল। আসলে টাকা-পয়সা নয়, দুশ্চিন্তা ছিল আমার গবেষণাপত্র নিয়ে। ওটা তখন সঙ্গে। ছাত্র-শিক্ষকে ভরা শহরে ছিনিয়ে কেউ নিজের নামে চালিয়ে দিলেই শেষ। তারপর ছাত্ররাও এখানে অবসরে গাড়িটারি চালিয়ে রোজগার করে। যাইহোক শেষ পর্যন্ত সেরকম কোনও বিপদ হয়নি। রাস্তাটা কিছুটা এগিয়ে মিশল একটা পাহাড়ের গায়ে। এদিকটাতে আমি কখনও আসিনি। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করতে বলল, এদিকেই নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউস। তবে তারপরে কিছুটা সংশয় নিয়ে বলল,‘সন্ধের পর এখানে আর কেউ যাতায়াত করে না। আপনি যাচ্ছেন...!’ তবে আমি কথা বাড়াইওনি এবং বাড়াতেও দিইনি। ভাবলাম কাজে ফাঁকি দেবার মতলব আঁটছে। গাড়িতে বসেই পাহাড়ের গা বেয়ে পাকদণ্ডীর মতো রাস্তাটা ধরে উঠলাম অনেকটা উপরে। নীচে তখন ঝলমলে শহরের গায়ে আঁচড় কাটছে ঝুরঝুরে তুষার। চারপাশ নিঝুম। গা-ছমছমে পরিবেশ। যতই বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করি না কেন আদতে আমি তো গ্রামবাংলারই মানুষ! ভয় কিছুটা হচ্ছিল। তবে প্রশ্রয় দিইনি। অনেকটা উপরে উঠে ড্রাইভার যেখানে নামাল সেখানটা পাহাড়েরই কোল কেটে বানানো প্রশস্ত একটা জায়গা। সেখান থেকে রাস্তাটা সরু হয়ে উপরে উঠে গিয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে উপরের দিকে তাকাতে গেস্ট হাউসটা চোখে পড়ল। মোটামুটি পায়ে হেঁটে ছোট হতে থাকা পাঁচটা পাক খেতে পারলেই গেস্ট হাউস। তুষারপাতটা তখন অঝোর ধারায়। হাঁটু ঢাকা পশমের জ্যাকেটের পকেটে হাত দুটো ভরে পা বাড়াতে আর দেরি করিনি। আলো আঁধারি, তুষারপাত সবকিছু মিলিয়ে বেশ রহস্যময় পরিবেশ। পাথর কেটে বসানো রাস্তার একটা পাক উপরে উঠতেই আবারও প্রশস্ত জায়গা। এক কোণে একটা বেঞ্চ আর তার পিছনে বোর্ড। বেঞ্চটার দিকে চোখ যেতেই একটা মানুষ। যবুথবু হয়ে বসে, মাথায় টুপি এবং মাথাটা নামানো। হয়তো উপরে উঠতে গিয়ে হাঁপিয়ে পড়েছেন। আমি গুরুত্ব দিইনি। ভেবেছিলাম, উপরে গিয়ে কাউকে পাঠাব। কিন্তু আরও একটা পাক খেতেই আবারও একই দৃশ্য। প্রশস্ত জায়গা, এক কোণে বেঞ্চি, বোর্ড এবং আবারও সেই মানুষ। একইভাবে বসে। চোখের ভুল ভেবে চোখ কচলে ভালো করে দেখলাম। কিন্তু না! উচিত আর অনুচিতের মাঝে তখন হাজার হাজার প্রশ্ন। সবশেষে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলাম না। কী দরকার। দুটো ধাপে দুটো একই পোশাকের মানুষ থাকতেই পারে। কিন্তু ভিতরটা ছ্যাঁত করে উঠল তৃতীয় ধাপে। সেখানেও সেইই। মানুষটা যেন কিছু বলতে চায়। মেরুদণ্ড বেয়ে হিমশীতল হাওয়া বয়ে গেল। কোনওরকমে মন শান্ত করে চুপচাপ উপরে উঠতে থাকলাম। আর মাত্র দুটো পাক পেরলেই গেস্ট হাউস। কিন্তু চতুর্থ ধাপে আবারও...। আর পারলাম না। দৌড়াব ভাবলেও পা দুটো অসাড়। ঘামে ভিজে গিয়েছে শরীর। অগত্যা সামনে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিছু কি বলতে চাইছেন?’ তবে কিছু বললেন না। মৃত যেন। ওঁর শরীরে টোকা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ছুঁতেই পারলাম না। মানুষটা যেন অন্য কোনও মাত্রায়। সবশেষে আবারও বললাম, ‘আপনি কী কিছু বলতে চাইছেন?’ এবারে শরীরটা নড়ল। আমার হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানিটা তখন স্পষ্ট। টুপি পরা মাথাটা তুলছে। আমার চোখ স্থির। সবশেষে মুখটা পুরোপুরি তুলতেই ভিতরটা হালকা হয়ে গেল। বীভৎস বিকৃত একটা মুখ। মুখ থেকে কে যেন খাবলে মাংস তুলে হাড় বের করে দিয়েছে। আর কিছু মনে নেই। শরীরটা মুহূর্তের মধ্যে অসাড় হয়ে গিয়েছিল। পরে গেস্ট হাউসের লোকেরাই তুষারে ঢাকা আমার জ্ঞানহীন শরীরটাকে খুঁজে পেয়ে নিয়ে গিয়েছিল হাসপাতালে।’
ঘটনাটা শুনে বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কী বলতে চাইছিল লোকটা?’ তবে স্যার উত্তর দেননি। বলেছিলেন, ‘জানতে পেরেছিলাম গেস্ট হাউসটা ক্লোস্টারমান বলে একজনের বাড়ি ছিল। বেশ শখ করে পাহাড়ের উপরে একখানা বাড়ি বানিয়েছিলেন। একাই থাকতেন। কিন্তু কোনও এক শীতের সন্ধেতে হার্ট অ্যাটাকের যন্ত্রণাটা আর সামলাতে পারেননি। সেদিন নাকি ভয়ঙ্কর তুষারপাত শুরু হয়। রাস্তাঘাট বন্ধ। টেলিফোনে বারবার ডাকলেও অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছতে পারেনি। সবশেষে নিজেই নেমে আসার চেষ্টা করেছিলেন। পায়ে হাঁটা পাকদণ্ডীর চারটে পাক বেয়ে নীচে নামলেও কোনও লাভ হয়নি। নীচের বেঞ্চিতে বসা অবস্থাতেই ওঁর দেহ উদ্ধার হয়। সেই থেকেই মানুষটা রাতে কাওকে উঠতে দেখলেই বাধা দেন। আর তোমাকে ওঁরা যেখানে থাকতে দেবে, সেটাই এই গেস্ট হাউস। ক্লোস্টারমানের বাড়ি। সুতরাং তুমি যাও ঠিক আছে, তবে রাতে যেও না। আর পিছনের বোর্ডটাতে এই নিষেধাজ্ঞাটাই লেখা ছিল।’
কিন্তু হাইডেলবার্গ পৌঁছেই ভিতরটা হালকা হয়ে গিয়েছিল। শুনলাম, আমার সঙ্গে স্যারও আমন্ত্রিত ছিলেন সেই সেমিনার। এমনকী, আগের দিন পৌঁছেও গিয়েছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, স্যার যখন রাতে ডেকে আমাকে কোস্টারমানের ঘটনাটি বলছেন, ততক্ষণে স্যারের বলা ঘটনাটি ঘটে গিয়েছে। স্যার তখন ওই পাকদণ্ডীর রাস্তাতেই সংজ্ঞাহীন! সব শুনে আমার মাথাতে কিছুই ঢুকছিল না। ভেবেছিলাম, ক্লোস্টারমানের মতোই স্যারও হয়তো আর নেই। গেস্ট হাউসের পরিবর্তে সোজা দৌড়েছিলাম হাসপাতালে। স্যার তখন গভীর কোমায়। তবে ডাক্তার আশ্বাস দিলেন, অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। ঘটনাটা নিয়ে তারপর আমি অনেক ভেবেছিলাম। কিন্তু কোনও কূলকিনারা করে উঠতে পারিনি। পরে স্যারের জ্ঞান ফিরতে যখন প্রথমেই আঁতকে উঠে বলেছিলেন, ‘সোমনাথ ওখানে যায়নি তো?’ তখন আমি বুঝেছিলাম। বুঝতে পারলাম, সংজ্ঞাহীন অবস্থাতেও স্যার প্রাণপণে চাইছিলেন যাতে এরকম দুর্ঘটনা ওঁর প্রিয় ছাত্রের সঙ্গে না ঘটে। আসলে স্যাররা তো এরকমই হন।