বিদ্যার্থীদের উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে মধ্যম ফল আশা করা যায়, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। ব্যবসাতে যুক্ত ... বিশদ
সুচিত্রা সেনের সঙ্গে তাঁদের পরিবারের মধুর সম্পর্কের নানা টুকরো স্মৃতি মনে পড়ে জহর-কন্যা কল্যাণী রায়ের। একদিনের ঘটনা। সুচিত্রা-কন্যা মুনমুনের তখন অ্যাপেনডিক্স অপারেশন হয়েছে। মুনমুন নার্সিংহোমে। এদিকে, জহর ফোন করে সুচিত্রাকে বলে দিয়েছেন যে, দিদিভাই, আজ বিকালে কমলা ও কল্যাণী তোমার বাড়ি যাবে। কল্যাণী বলছিলেন, আমরা পৌঁছনোর আগেই আন্টি বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। বাহাদুর গিয়ে খবর দিয়েছিল যে, আমরা এসেছি। মা আসছেন খবর পেয়েই আন্টি দরজার আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিলেন। দরজার সামনে যেতেই আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে মাকে চমকে দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিলেন। ওই রকম দোর্দণ্ডপ্রতাপ নায়িকা, যাঁর সঙ্গে সহকর্মীরাই সমঝে কথা বলতেন, তাঁর ওই রকম শিশুসুলভ আচরণ আমরা দেখেছি। গোটা বাড়ি আমাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন। মাকে বলতেন, তোমার ছেলেমেয়েগুলো কী মিষ্টি হয়েছে। আমরা প্রণাম করতে গেলেই বাধা দিয়ে বলতেন, অ্যাই, তোদের বাবা বুঝি এই রকম ঢিপ ঢিপ করে প্রণাম করতে শিখিয়েছে।
সুচিত্রা সেনের সঙ্গে জহর রায়ের অন্তরঙ্গতার আর এক সাক্ষী অভিনেতা ধীমান চক্রবর্তী। সেই ধীমান, যাঁকে ‘অনন্যা’ নাটকে জনৈক দর্শক ‘ভাল্লুকের বাচ্চা’ বলে অপমান করায় সংলাপ থামিয়ে গর্জে উঠেছিলেন জহর। এই নাটকটির নাম অবশ্য অন্য। ‘আমি মন্ত্রী হব’। উল্টোডাঙার কাছে থাকতেন মাস্টারমশাই সুনীল চক্রবর্তী। তাঁর লেখা পলিটিক্যাল স্যাটায়ার। সেই সময়কার রাজনৈতিক পটভূমি নিয়ে সাজানো। এক জ্যোতি বসু ছাড়া ডান-বাম কোনও তৎকালীন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বোধ হয় ছিলেন না যিনি ‘আমি মন্ত্রী হব’ দেখেননি। এই নাটকে জহর রায় তাঁর অভিনয়কে স্যাটায়ার কমেডির কোন স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন, তা যাঁরা নাটকটি দেখেছেন, তাঁরা জানেন বিলক্ষণ। শেষদৃশ্যে তাঁর অভিনয় দেখে দর্শকদের চোখে জল চলে আসত। এরকমই একদিন শো দেখতে এসেছিলেন সুচিত্রা সেন। ধীমানবাবু বলছেন, ‘আমার সঙ্গে থাকত জহরদার লাস্ট সিন। আমাদের গ্রিনরুম ছিল দোতলায়। সেদিনও আমরা নাটক শেষ করে সিঁড়ি দিয়ে উঠছি, দেখি সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছেন ম্যাডাম (সুচিত্রা সেন)। জহরদাকে জড়িয়ে ধরে তিনি অভিবাদন জানালেন, প্রশংসা করলেন। ওঁর মতো ব্যত্তিত্বময়ী অভিনেত্রী একজন কমেডিয়ানকে এভাবে অভিনন্দন জানাচ্ছেন, এটা ছিল কল্পনাতীত।’
রংমহলেই প্রথম অভিনীত হয় ‘নহবত’ নাটকটি। এই নাটকের মাধ্যমেই প্রথম অভিনয় জগতে পা রাখেন অভিনেত্রী আরতি ভট্টাচার্য। জামশেদপুর থেকে তাঁকে নিয়ে এসেছিলেন জহর রায়। আর এই নাটকেই জহরের সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় ধীমানের। স্মৃতি হাতড়ে বলছেন, ‘জহরদা কখনও থিয়েটার কামাই করা পছন্দ করতেন না। সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা নাটক, পরিচালকও তিনি। আমার সঙ্গে জহরদার সেই প্রথম অভিনয়। কিন্তু ওঁর সঙ্গে কোনও রিহার্সাল করার উপায় ছিল না। কারণ, জহরদা তখন কোনও একটা ছবির কাজে বাইরে গিয়েছিলেন। ফ্লাইট থেকে নেমে সোজা চলে এলেন রংমহলে। এদিকে, আমি তো জানি জহরদা স্ক্রিপ্ট ছাড়াও নানা কথা বলেন, অঙ্গভঙ্গি করেন। সত্যদা, হরিধনদা (বন্দ্যোপাধ্যায়) ভাবছেন শেষরক্ষা হবে কিনা! চরিত্রটা ছোট্ট হওয়ায় মোটামুটি উতরে গিয়েছিলাম সেই যাত্রা।’ তবে, আভ্যন্তরীণ কারণে ‘নহবত’ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে দক্ষিণ কলকাতার তপন থিয়েটারে সাতের দশকে এই নাটক পুনরায় মঞ্চস্থ হয় এবং দীর্ঘ সাফল্যের সঙ্গে চলে।
‘অনন্যা’ নাটকের সেই দৃশ্যটার কথা এখনও উজ্জ্বল ধীমান চক্রবর্তীর মনে। বলছিলেন, নাটকে যাঁরা টর্চ জ্বেলে আসন দেখিয়ে দিতেন দর্শকদের, তাঁরা তিন-চারটি শো-এর পর সাধারণত নাটক শুরু হয়ে গেলে বাইরে বসেই আড্ডা দিতেন। কিন্তু ‘অনন্যা’র ওই দৃশ্যটার সময় যে যেখানে থাকুন না কেন হলে ফিরে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতেন। কারণ জহরদা একেক দিন একেক কথা বলতেন। আর কোনদিন ঠিক কী হবে তা কেউ আন্দাজ করতে পারতেন না। নিজের মতো সংলাপ বলতেন জহরদা ঠিকই, কিন্তু ‘কিউ’টা সঠিক জায়গায় দিতেন। ফলে সহশিল্পী কোনও রকম অসুবিধায় পড়তেন না। উনি ইচ্ছে করে মজা করলে অবশ্য আলাদা।’
একমাত্রিক কমেডি নয়, নাট্যমঞ্চে জহর রায়ের বৈচিত্র্যপূর্ণ বহুমাত্রিক অভিনয় ছবির তুলনায় একটু বেশিই দেখা গিয়েছে। ছবির পাশাপাশি থিয়েটারের সঙ্গেও তাঁর ছিল আমৃত্যু সম্পর্ক। যেখানে তিনি শুধু একজন অভিনেতা ছিলেন না, তার সঙ্গে সাংগঠনিক ব্যক্তিত্ব, প্রযোজনা, পরিচালনা ও আরও অনেক দায়িত্ব একা হাতে সামলাতেন। ১৯৫৪ সালে বন্ধু অজিত চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে জহরের রংমহলে পদার্পণ। সেই থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই প্রেক্ষাগৃহের সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত হননি কোনওদিন। ’৫৪ সালেই জিতেন বসু ও পি ভি মানসাটা এই প্রেক্ষাগৃহের কর্তৃত্ব নিলেন। পরিচালক হিসাবে এলেন দুই ভাই— নলিন ও হেমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। নতুন করে রংমহলের শ্রীবৃদ্ধি হল। সে বছর ‘দূরভাষিণী’ নাটকে প্রথম পেশাদার মঞ্চে পা রাখলেন জহর। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাননি। প্রায় সব নাটকেই চলল তাঁর কুশলী অভিনয়।
’৬২ সালে এই প্রেক্ষাগৃহ একটা অদ্ভুত সংকটের মধ্যে পড়ল। কর্তৃপক্ষ রংমহলকে সিনেমাহলে পরিণত করার চেষ্টা শুরু করল। তখন জহর রায়ের অন্যদিক উন্মোচিত হল। যাতে হলটি থিয়েটার হলই থাকে সেই বিষয়ে সাহায্য চাইতে নাট্যসম্রাজ্ঞী সরযূবালাদেবী ও বন্ধু অজিত চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে ডঃ প্রতাপচন্দ্র চন্দ্রের সহায়তায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের দ্বারস্থ হলেন জহর। অবশেষে দীর্ঘ আন্দোলনের জেরে ও বিধান রায়ের মধ্যস্থতায় স্থির হয়, রংমহলের পরিচালন ভার শিল্পীদের উপরই থাকবে। সেই মতো হলটি চালানোর যৌথ দায়িত্ব নেন সরযূবালাদেবী ও জহর রায়। তাঁদের নামে কলকাতা পুরসভা থেকে লাইসেন্স বের করা হয়। নাট্য পরিচালনার ভার থাকে বন্দ্যোপাধ্যায় ভাইদের উপরেই। রংমহল চালানোর দায়িত্ব জীবনের অন্তিম দিন পর্যন্ত সরযূবালাদেবীর সঙ্গে পালন করে গিয়েছিলেন জহর রায়।
সুশীল মুখোপাধ্যায় এক জায়গায় লিখেছেন, ১৯৬১ সালে তাঁর ‘অনর্থ’ নাটকে খলনায়কের চরিত্রে কী অভিনয়টাই না করেছিলেন জহর। গোড়ায় তিনি মঞ্চে প্রবেশ করলেই দর্শক হাসতে শুরু করত। পরে তারা বুঝে যায়, এ অন্য জহর। তৃতীয় দৃশ্যে ভিলেনি যখন চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছয়, তার সমতুল্য অভিনয় সে সময়ের মঞ্চে হয়নি।
টালিগঞ্জে সকলেই জানত কারও সঙ্গে ঝঞ্ঝাটে নেই জহর রায়। অথচ, রংমহল বন্ধ হতে বসায় সেই জহরই যখন রুখে দাঁড়ালেন, তখন সকলেই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। বহু অভিনেতা-অভিনেত্রীকে রঙ্গমঞ্চে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। নায়িকা আরতি ভট্টাচার্যের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। ছ’য়ের দশকে জহরের হাত ধরে ‘মায়ামৃগ’ নাটকে অভিনয়ে আসেন বিশ্বজিৎ। পরবর্তীকালে নীহাররঞ্জন গুপ্তর লেখা ‘উল্কা’ নাটকটি জহরের পরিচালনায় বহুদিন মঞ্চস্থ হয়। এছাড়াও ‘বাবা বদল’, ‘সুবর্ণ গোলক’ সহ একাধিক নাটকে তাঁর অভিনয় অমর হয়ে আছে।
অলঙ্করণ: বিশ্বনাথ ঘোষ