বিদ্যার্থীদের উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে মধ্যম ফল আশা করা যায়, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। ব্যবসাতে যুক্ত ... বিশদ
‘কী লাগছে?’
‘না, মানে একটা ব্যথার মতো।’
‘ব্যথার মতো, মানে ব্যথা নয়। তাই তো?’
‘না, ওই আর কি...’
হিতেন্দ্রনাথ সান্যালের কথা শেষ হল না। হয় না। ওঁর সাতচল্লিশ বছরের প্রাচীন জীবনসঙ্গিনী আজ অবধি কোনও বাক্যে সমাপিকা ক্রিয়া ব্যবহার করতে দেননি। একজন সিনিয়র সিটিজেনের বুকে ব্যথার সামান্য আভাসও তাঁকে বিচলিত করল বলে মনে হল না।
শান্তিরানি সান্যাল এক কড়াই ডালের মধ্যে কাঁটা দেন। কঠোর মনোযোগ। অর্জুন এই অখণ্ড মনোনিবেশে লক্ষ্যভেদ করেছিলেন। সেখানে ছিল মাছের চোখ। শান্তিদেবীর চোখে অবশ্য মাছ নেই। কাঁটা আছে। কাঠের। দু’হাতে যত্নে ধরে ঘোরান। কাঠের কাঁটার টানে মিহি ফেনার মতো গলে মিশে মাখন হয়ে ওঠে মুসুর ডাল। কী অপূর্ব রং। আহা! শান্তির মুখের ঝাঁঝ যেমনই হোক, হাতের রান্নার স্বাদই আলাদা। মুসুর ডালে শুকনো লঙ্কা আর রাঁধুনি ফোড়নের গন্ধ পেয়েছেন আজ। বরিশালের এই মুসুর ডাল রান্নার স্পেশাল রেসিপি শান্তিরানির একমাত্র অনুগত স্বামীর ভারী পছন্দ।
রান্নাঘরের সামনে দাঁড়িয়েই এই সময় হালকা কথা আদানপ্রদান। ওই বুকে ব্যথা ইত্যাদি প্রসঙ্গ। শান্তির মতে, এগুলো তাঁর স্বামী বানিয়ে বলেন। বউয়ের সহানুভূতি পাওয়ার আশায়। এই সময় সামান্য মধুর ভাব দেখালেই হিতেনবাবু মাথায় চড়ে বসবেন। হয় দুপুরের মেনুতে বড়াভাজার খোঁজ কিংবা গরম মাছভাজা, তা’ও না জুটলে একটা ডিমসেদ্ধই সই। এটাসেটা আবদার। ভালোমন্দ যা পাওয়া যায়। অথচ শান্তিদেবীর মেনু প্ল্যানিংয়ে এইসব কুখাদ্য প্রায় নেই বললেই চলে। কাজেই তিনি ভ্রুক্ষেপ করেন না। মাইনে-করা রাঁধুনির পরোয়া না করে দু’বেলা নিজের হাতে হাতা-খুন্তি এবং স্বামীর স্বাস্থ্যের দায়িত্ব রেখেছেন। পরম নিন্দুকেও ওঁর এই বিষয়ে খুঁত ধরবে না। ধরতে পারবে না। অসম্ভব।
বেলা সাড়ে এগারোটায় হিতেনবাবু বাজার থেকে ফিরলেন। সকাল থেকে এই নিয়ে তৃতীয় বার। যাওয়া-আসা পর্ব চলেই। খুব স্বাভাবিক। রিটায়ার্ড মানুষ আর কীই বা করবেন। প্রথমেই ভোর ছ’টায় এক কাপ চা করে আরতির ভঙ্গিতে মশারির মধ্যে স্ত্রীর দিকে বাড়িয়ে ধরেন। শান্তিদেবীর বেড-টি ছাড়া ঘুম ভাঙতেই চায় না। বহুকালের অভ্যেস। তারপর সাদা টি-শার্ট, নেভি ব্লু জিনস আর একটি ঘ্যামা স্নিকার পরে হিতেনবাবু বেরিয়ে পড়েন। প্রাতর্ভ্রমণ। মর্নিং ওয়াকার্স অ্যাসোসিয়েশন বলে একটি দল তৈরি হয়েছে সম্প্রতি। তাঁরা বড্ড বুড়োটে। হিতেনবাবুর তেমনই বিশ্বাস। তাঁরা কেবলই শরীরের বিভিন্ন কল-কব্জা বিগড়ে যাওয়ার প্রবণতা নিয়ে আলোচনায় মশগুল। তা না হলে নতুন বউমা’র রন্ধনে অনীহা, পুত্রের পদোন্নতি, কন্যার উচ্চশিক্ষা কিংবা জামাইয়ের কেনা নতুন গাড়ির মডেল নিয়ে অত্যন্ত ব্যতিব্যস্ত। আরেক দল আছেন। যাঁরা এইসব পেটি ইস্যুতে থাকেন না। তাঁরা ভারত-চীন কূটনীতি, আমেরিকায় নয়েজ পলিউশন, পাকিস্তানে তালিবানদের খাদ্যাভ্যাস বা অ্যান্টার্কটিকার ঠান্ডায় ক্রিসমাস উদযাপন বিষয়ে চিন্তিত। হিতেনবাবু দলছুট। নট ইন সেভেন, নট ইন ফাইভ। সাতেও নেই, পাঁচেও নেই। তিনি বটতলার মাঠে পাঁচ পাক হাঁটেন। ধীরে ধীরে। নো তাড়াহুড়ো। ততক্ষণে সূর্য অনেকটাই ঝকঝকে। পাশে মিষ্টির দোকান। শ্রীরাধা মিষ্টান্ন ভান্ডার। ধুলোয় ঝাঁট পড়ে। রাস্তায় জলের ছড়া। অনিলের দোকানে কালো কড়াইতে তেল ফুটছে। পাশে তোলা উনুনে চায়ের কেটলি। অনিল আর তার রাইট হ্যান্ড পঞ্চু অবিশ্বাস্য দ্রুত হাতে কচুরি, জিলিপি আর চায়ের সরঞ্জাম গোছায়। হিতেনবাবু মৃদু পায়ে এগিয়ে আসেন। ভাবখানা এমন, যেন শুধু একটু ডাকখোঁজ করার জন্যই। গলা খাঁকারি দিয়ে ডেকে বলেন, ‘এত সকালেই সব রেডি দেখছি।’
অনিলের কান-এঁটো করা হাসি। সিগনেচার স্টাইল।
‘বাবু, হাঁটলেন? ক’পাক হাঁটা হল?’
‘হ্যাঁ রে। আজ সাড়ে পাঁচ পাক মারলাম। ফিট লাগছে বেশ।’
হাওয়ায় দু’হাত ছড়িয়ে হুসহাস শব্দ করে আরও একটু ফ্রি-হ্যান্ড করে নেন হিতেনবাবু।
‘বাবু, গরম গরম কচুরি দু’পিস দিই তবে। আপনি বউনি করলে দিনটা বড্ড ভালো যায়...’
‘বলছিস? দে তবে। ওই দু’খানাই। গরম তেল, টাটকা ভাজা। কিছু হয় না, বল?’
‘না বাবু। আপনি কি আজ নতুন খাচ্ছেন?’
‘তাহলে সঙ্গে একটা জিলিপিও দিস বরং।’
এই পুরো সংলাপ হুবহু টুকে রোজ সকালের চিত্রনাট্যে বসিয়ে দেওয়া যাবে।
অনিল বা তার সাকরেদ পঞ্চুর টো টো মুখস্থ। হিতেনবাবু রোজই নিজের অপরাধবোধ কাটাতে দু’পিস কচুরি আর একটি জিলিপি খেয়ে আরও এক পাক হাঁটেন। কণিকা ফার্মেসি থেকে একটি হজমের ওষুধ টপ করে গালে ফেলে দেন। তারপর সোজা বাড়ি। সেখানে কাঁচা হলুদ, নিমপাতা, আমলকির রস, হোমমেড ছাতুর সরবত টেবিলের ওপর থরে থরে সাজানো। গিন্নির স্বাস্থ্যসচেতনতার সামান্য নমুনা।
কচুরির ঢেঁকুরের ওপরে একের পর এক ভেষজ গুণের প্রলেপ পড়ে। এই সময় খবরের কাগজে চোখ বোলাতে বোলাতে কানে আসে শান্তিরানি তাঁর দিল্লিবাসিনী কন্যাকে পেঁপে-গাজরের স্যুপের রেসিপি বোঝাচ্ছেন। ওটা জাস্ট জঘন্য খেতে। একটু মাখন আর গোলমরিচের গুঁড়ো ছাড়া... সে গুড়ে, মানে সে স্যুপে বালি। শান্তিদেবীর রান্নাঘরে তেল-ঘি-মাখনের মতো কুখাদ্য প্রায় ঢোকে না বললেই চলে। যত দিন যাচ্ছে শান্তিদেবীর এই বাতিক আরও বাড়ছে। এত শরীর রক্ষা করে যে কী শান্তি পান, কে জানে!
দ্বিতীয় দফায় বেরনো। এবার বাজার। মাছ আর সব্জি। মাছের বাজারে প্রচুর পাক খেয়ে গলদা-বাগদা-ইলিশের দিকে দৃকপাত না করেও জ্যান্ত কই আর টাটকা মৌরলার দিকে নজর পড়ে। পকেট গরম। অথচ গৃহশান্তি...। না, কাতলাই ভালো।
খেতে বসেই মুখ বেজার। পাকা কাতলার পেটি। অথচ পাশে নিরাসক্ত ঝিঙে আর উদাসীন পটল এলিয়ে শুয়ে আছে। বেরঙিন ফ্যাকাশে ঝোল। ইস, কত দরদাম করে উদভ্রান্ত চঞ্চল কইমাছগুলোকে ছেড়ে এসে বড়সড় তেল চকচকে পাকা কাতলাটা কিনলেন।
‘হ্যাঁ গো, আজ মাছটা বেশ টাটকা ছিল না?’
‘হুম।’
‘এটাই সবচেয়ে বড় সাইজ।’
‘ও।’
‘ঝোলটা দিব্যি হয়েছে... মানে, ইয়ে, স্বাস্থ্যকর অথচ অপূর্ব।’
‘হুম।’
‘আজ বাজারে যা ভিড়’।
‘তাই?’
‘আর বোলো না, স্বপনের সঙ্গে প্রচণ্ড তর্কাতর্কি করে শেষে...’
‘তর্কাতর্কি কেন?’
এতক্ষণে গিন্নির দু’শব্দের প্রশ্নে ভরসা জাগে। হিতেনবাবু উৎসাহিত হয়ে মাছের বাজারে তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রসিয়ে বলার প্রস্তুতি নেন।
‘আসলে পাকা কাতলার স্বাদ তো... কালু ডেকে বলল, বাবু এই মাছ গরম গরম ভাজা খাওয়ার মজাই আলাদা...’
‘বিষ।’
‘অ্যাঁ! কী বললে?’
হিতেনবাবু সহধর্মিণীর এককথায় ভাবপ্রকাশের নৈপুণ্যে বিষম খান। শান্তিদেবী তাঁর পতিদেবতার দিকে জলের গ্লাসটা একটু ঠেলে দিয়ে বলেন, ‘একটা মাছভাজা মানে একবাটি বিষ। পারব না। আমি অন্তত প্রাণে ধরে তোমাকে বিষ দিতে পারব না।’
পুরাকাল হলে পুষ্পবৃষ্টি হতো নির্ঘাত। স্বর্গের সব দেবদেবী ঠেলাঠেলি করে এই পুণ্যবতীকে দেখতে আসতেন। আবেগে হিতেনবাবুর দু’চোখ ভিজে ওঠে। আহা! এই জমানায় কোন বউ তাঁর স্বামীর কল্যাণকামনায় এত একাগ্রচিত্ত। জাস্ট নেওয়া যাচ্ছে না। পাকা কাতলার পেটি দিয়ে ট্যালটেলে একবাটি ঝোলের দিকে তাকিয়ে হিতেনবাবু প্রতিজ্ঞা করেন, কাল থেকে আর বাজারে গিয়ে কাতলার দিকে তাকাবেন না। এর চেয়ে চারাপোনার ঝোলে গলায় কলসি বেঁধে ডুবে মরাই ভালো।
খাবার টেবিলে বসলে বাইরের জানালায় প্রতিবেশীর বারান্দা। পাশের বাড়ির বুলুদি স্নান সেরে চুল মুছছেন। রিটায়ার্ড শিবুদার স্ত্রী। নিঃসন্তান দম্পতি। ঝাড়া হাত পা।
‘শান্তি, খাইতে বইলা নাকি?’
‘এই তো বুলুদি। আপনার এতক্ষণে স্নান সারা হল?
‘আর কইয়ো না। তোমার দাদার যা সব কাণ্ড। একরাশ কাঁকড়া, চিংড়ি, কই সব একসাথে আইন্যা থুইল। কাজের মাইয়াটা তো দেইখ্যাই পলায়। সব লইয়া এতক্ষণ সেই বাইছ্যা... এই বুড়ার যত বয়স বাড়ে, তত নোলা বাড়ে... আমার হইসে যত জ্বালা...’
হিতেনবাবু অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে ভাতের প্রতিটি গ্রাস যত্ন করে মুখে তোলেন। তিনি নম্বরে অনেক এগিয়ে। স্বাস্থ্যরক্ষায় তাঁরও প্রচুর সাধনা। কম কথা নাকি?
মাছভাজা হিতেনবাবুর অবসেশন। একটা হালকা নিষিদ্ধ পরকীয়ার মতো চোরাটান। বিভিন্ন বড়ার ক্ষেত্রেও। আর শান্তি বানাতেও পারেন। থুড়ি, পারেন নয়, পারতেন। সাদা তিলের বড়া, পোস্তর বড়া, ধনেপাতার বড়া, ক্যাপসিকামের বড়া, ফুলকপির বড়া...। এগুলো অত্যন্ত পরিচিত। এ তো সকলেই খায়। কিন্তু তাছাড়াও। বিভিন্ন ভ্যারাইটি। যে কোনও ন্যাতানো অপ্রাসঙ্গিক সব্জিকে অবিশ্বাস্য দক্ষতায় মুচমুচে করে তুলতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। বড়াতে তার কোনও শ্রেণীবিভাজন নেই। তবে এক-একদিন এক-একরকম। হিতেনবাবুর দীর্ঘদিনের অভ্যেস। অফিসের ব্যস্ততায় সাতসকালে গরম ভাতের পাতেও দুটি বড়া কোনওদিন বাদ পড়ত না। এই অভ্যেসে ছেদ পড়েছে। সাময়িক নয়। পূর্ণচ্ছেদ। হিতেনবাবুর রিটায়ারমেন্টের পরদিনই শান্তিদেবী ঘোষণা করেছেন, বয়স অনেক হল। এবার সংযম। ফুড হ্যাবিট বদলাতে হবে। দীর্ঘ জীবন আর সুস্থ শরীর দুটোই জরুরি। অতএব, নো ভাজা। সবটাই যে ঘোরতর অস্বাস্থ্যকর। আরে বাবা, শরীরটাকে তো...
বাধ্য হয়ে হিতেনবাবু প্রাতর্ভ্রমণে বেরিয়ে অনিলের দোকানে গরম কচুরি-জিলিপি আর সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়ে স্টেশন রোডে হারুর ঝুপড়িতে টাটকা বেগুনি খেয়ে মেজাজটাকে একটু চনমনে করে রাখেন। কিন্তু দুপুরে আর রাতে ভাতের থালায় তাঁর সাধের সব্জির ম্লান ফ্যাকাশে চেহারায় ক্রমশ বড় মুষড়ে পড়েন। শান্তি অন্তত মাছভাজার ওপর কার্ফু জারি না করলেই পারতেন।
‘বাবা, মেসোমশাই জানতে চাইছেন, মা কী কী খেতে ভালোবাসত। তুমি কিছু বলো।’
কঙ্কনা এসে দাঁড়িয়েছে। হিতেনবাবুর একমাত্র কন্যা। দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে গবেষণারত। এখানে আপাতত অল্প কয়েকদিনের ছুটিতে।
কয়েকদিন মর্নিং ওয়াক হয় না। হিতেনবাবু বারান্দার ইজিচেয়ারে চুপ করে বসে থাকেন। রাস্তায় লোক চলাচল। ব্যস্ততা। মেয়ের প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন হিতেন।
‘আমি? আমি কী বলি বল তো? সেভাবে কিছুই তো...’
‘তার মানেটা কী বাবা? তুমিই তো আগে বলবে। মা কী খেতে ভালোবাসত তুমি জানো না?’
হিতেন্দ্রনাথ সান্যালের চোখের সামনে জানলার পর্দাটা অল্প হাওয়ায় দুলতে থাকে। আচ্ছা, কোনওদিনই কি তিনি শান্তির পছন্দের খাবার জানতে চেয়েছেন? ঠিক মনে পড়ে না। বরং নিজের যাবতীয় পছন্দগুলোই তো নানান ছলছুতো, আবদারে...। নতুন বিয়ের পরে মাঝেসাঝে যখন মান-অভিমান খুনসুটি পর্ব, তখনও মান ভাঙাতে নিজের মনপসন্দ ডিমের ডেভিল বা ভেটকি ফ্রাই এনে হাজির করেছেন। নিজেই তারিয়ে তারিয়ে খেয়েছেন। শান্তি নিজে কী খেতে ভালোবাসে জানা হয়নি তো!
গত কয়েকদিন ধরে বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে তিনি কেবল ভেবেছেন এখন আর কোনও নিয়মকানুন না মানলেও চলবে। শান্তিরানি তাঁকে কঠোর অনুশাসন থেকে এই জীবনের মতো নিষ্কৃতি দিয়েছেন। কিন্তু শেষরাতের সেরিব্রাল স্ট্রোকে অচৈতন্য অবস্থায় শান্তিরানি একবার অস্ফুটে বলেছিলেন, মাছভাজা। সে কি তার নিজের পছন্দ, না স্বামীর সাধ অপূর্ণ রয়ে গেল বলে?