প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। তবে তা বাস্তবায়িত হওয়াতে সমস্যা আছে। ... বিশদ
এইরকম একটা সময়ে বিদ্যাসাগর মশায়কে একটা বাড়তি দায়িত্ব দেওয়াও হয়েছিল—যেসব নতুন স্কুল খুলল— সেগুলোর দেখভাল করার জন্যে তাঁকে ইনস্পেক্টর পদেও বহাল করা হল। চারটে জেলা তাঁর দায়িত্বে এল— হুগলি, বর্ধমান, নদীয়া। আর মেদিনীপুর তো ছিলই। এইসব জেলার দূরবর্তী স্কুলগুলো হেঁটেই তিনি দেখতে যেতেন—এক একদিন হেঁটে যেতে অর্ধেক দিনই কাবার হয়ে যেত। পথে কত গরিব ছেলেকে দান করতেন। বিশেষ করে যে ছেলেটি বলত, ‘আমার মা নেই’, তার কথা শুনে কাঁদতে কাঁদতে তিনি ধুতির খুঁট খুলে পয়সা দিতেন। এটা জেনে ফেলে অনেক ছেলে যাদের মা বেঁচে আছেন, তারাও মিথ্যে করে বলত, ‘আমার মা নেই।’ পরে বিদ্যাসাগরও এই রহস্যের কথা জানতে পারেন— হঠাৎ এত ছেলে মাতৃহীন হল কী করে! আসলে পরোপকার করাটাই তাঁর মনে হয় একটা ‘ব্যাধিতে’ পরিণত হয়েছিল। বিখ্যাত প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারীকে তিনি শিক্ষকতার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। অবশ্য এর একটা অন্য কারণও ছিল। বেশি বয়সেও তিনি এঁর কাছে ইংরেজি শিখতেন। শিক্ষার কোনও বয়স নেই, এর জন্য মান-সম্মানের কথাও যে ভাবতে নেই— বিদ্যাসাগর মশায় নিজের জীবন দিয়ে সেই উদাহরণ রেখে গিয়েছেন।
সে জন্যেই তিনি সংস্কৃত কলেজে ইংরেজি পড়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। তখন সংস্কৃত কলেজে পড়াতেন অথচ ভালো ইংরেজি জানতেন, তাঁদের মধ্যে প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী ছাড়া শ্রীনাথ দাস, তারিণীচরণ চট্টোপাধ্যায়ের মতো উচ্চশিক্ষিত মানুষেরাও ছিলেন। বিদ্যাসাগর এঁদের সবারই ছাত্রের মতো ছিলেন নিজে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হওয়া সত্ত্বেও।
জেলায় জেলায় কত যে স্কুল স্থাপিত হল! মেয়েদের স্কুলও। মেয়েদের স্কুলের জন্যে সরকার কোনও টাকা পয়সা দিচ্ছে না দেখেও নিজে থেকে সব খরচ চালিয়ে গিয়েছেন বিদ্যাসাগর। সাধে কি তাঁর বড় অনুরাগী, ব্রাহ্ম সমাজের এক সময়ের খুব বড় নেতা কবিতায় লিখেছিলেন—‘না জাগিলে ও গো ভারত-ললনা/ ভারত যে আর জাগে না জাগে না।’ এই স্কুল পরিদর্শনের সময় একবার তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন। উত্তরপাড়ায় একটি স্কুল থেকে ফিরে আসার সময় গাড়ি উল্টে আহত হন বিদ্যাসাগর। বিদেশিনী মিস মেরি কার্পেন্টার সেবা করে তাঁকে বাঁচিয়ে নিয়ে ফিরেছিলেন। বিদ্যাসাগর তো কলকাতায় প্রথম পদার্পণের পর জগদ্দুর্লভ সিংহের বাড়িতে রাইমণির স্নেহ পেয়ে সমস্ত নারীজাতি সম্পর্কে শ্রদ্ধান্বিত হয়ে পড়েছিলেন। তাছাড়া মা ভগবতী দেবীর ব্যক্তিত্ব ও উন্নত ভাবনাচিন্তা তাঁকে প্রভাবিত করেছিল। বিদ্যাসাগর মাকে একবার তিনটি গয়না গড়িয়ে পরাতে চেয়েছিলেন। গ্রামের এক নিরক্ষর মহিলা ছেলের কাছে যে তিনটি গয়না চেয়েছিলেন— পৃথিবীতে তার উদাহরণ খুবই কম। স্কুল স্থাপন, দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন এবং স্কুলে যারা পড়াশোনা করবে সেই গরিব ছাত্ররা যাতে থাকতে পায় ও খেতে পায়, তার ব্যবস্থা করা। এই তিনটি গয়নাই ছেলের কাছে যে মা পেতে চান, তিনি যে আর পাঁচজন মায়ের থেকে আলাদা তা আমরা বুঝতেই পারি। তাঁর সন্তানও যে আলাদা হবেন এটাই প্রত্যাশিত। মায়ের এই তিনটে সাধই বিদ্যাসাগর পূরণ করেছিলেন।
এমন মায়ের কাছে একটা ধন্দ মেটাবার জন্যে একদিন হাজির হলেন। সময়টা ছিল মন্বন্তরের কাল। সারা ভারতের সঙ্গে বাংলাতেও দুর্ভিক্ষ— কেউ একমুঠো ভিক্ষা পর্যন্ত দিতে পারছেন না। বিদ্যাসাগর বীরসিংহার লোকের কীভাবে দিন কাটছে তা নিজের চোখেই দেখবার জন্যে গ্রামের মানুষের ঘরে ঘরে খোঁজখবর নিতে লাগলেন। তাঁদের কীভাবে সাহায্য করা উচিত তা জানার জন্যে মাকে জিজ্ঞেস করলেন— ‘মা, একটা কথা বলবে? আমি যদি দু’শো টাকা খরচ করে জগদ্ধাত্রী পুজো করি এ সময়ে—সেটা ঠিক হবে কিনা, অথবা এদের প্রয়োজন বুঝে এদেরকে অনেকদিন ধরে মাসে মাসে নগদ টাকা সাহায্য করা ভালো?’ শুনে ভগবতী জবাব দিলেন, ‘গ্রামের দরিদ্র নিরুপায় লোক প্রতিদিন খেতে পেলে পুজো করার প্রয়োজন নেই। তুমি গ্রামের মানুষদের মাসে মাসে কিছু দিলে, আমি পরম আহ্লাদিত হব।’ এই মহিলা নিরক্ষর না সামাজিক মানুষের গুরু? ইনি গাঁয়ের মেয়ে— না, শহরের এমন মেয়ে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ? আনপড় পুরনো ধ্যান-ধারণার যুগে গেঁয়ো এই মহিলা দুশো বছর আগে জন্মেছিলেন?
সেটা ছিল ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ। এক সাহেব বীরসিংহায় এসেছেন—নাম হ্যারিসন। মাকে গিয়ে বললেন বিদ্যাসাগর—মা, সাহেবটা খুব ভালো, ওকে একদিন নেমন্তন্ন করে খাওয়াবে? ভগবতী ঘাড় কাত করে বললেন, ‘তোর যখন ইচ্ছে, তখন সাহেবকে গিয়ে বল— আমি তাঁকে আমার রান্ধা দুটো খুদ-কুঁড়ো খাবার জন্য ডেকেছি।’ বিদ্যাসাগরের কাছে শুনে সাহেব খুশি হয়ে চলে এলেন ভগবতী দেবীর কাছে। বিদ্যাসাগর চারদিকে দানধ্যান করে চলেছেন— সাহেব তা জেনেছেন। তাই খেতে খেতে ভগবতী দেবীকে জিজ্ঞেস করলেন— আপনার অনেক টাকাকড়ি—সোনাদানা আছে, তাই না? ভগবতী দেবী একমুখ হেসে বললেন— আমার চার ঘড়া ধন আছে। সাহেব আঁতকে উঠলেন—চার ঘড়া? ভগবতী বললেন—এই যে আমার ঈশ্বর, ওই যে আমার পেটের আর তিনটে ছেলে, ওরাই আমার ধন— চারঘড়া ধন।
এঁর গর্ভেই তো সাগরের জন্ম হবে!
এই সময় বিদ্যাসাগরের মনে নারীদের বিশেষত যাঁরা নির্যাতন ভোগ করছেন বৈধব্যের কারণে, তাঁদের জন্যে খুব কষ্ট হতো। এর কারণও তাঁর মা। এমনিতেই যাঁরা বিধবা হন, তাঁদের অনেকেই বালিকা বয়সেই স্বামীহারা হন। তারপর শ্বশুরালয়ে তাঁকে নানা দমন-পীড়ন সইতে হয়। তাই বাল্যবিবাহ কী করে বন্ধ করা যায়, তার সঙ্গে কী করে বিধবাদের আবার নতুন করে বিয়ে দেওয়া যায়— তা তাঁর মনকে একেবারে এলোমেলো করে দিত। সদ্য বিধবা-বালিকাদের বুকফাটা কান্নার সঙ্গে বিদ্যাসাগরের চোখের জল মিশে গিয়ে একটা কান্নার সাগরের জন্ম নিত। কেন তাঁরা লেখাপড়া শিখতে পান না— শিখলে তো কিছু উপার্জন করতে পারতেন স্বাবলম্বী হয়ে। লেখাপড়া না জানায় সেই পথটা একেবারে বন্ধ থাকত।
একদিন বাড়ির কাছেই তাঁদের এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে হঠাৎ করে কান্নার রোল শোনা গেল। সে বাড়ির কর্তা বেশ কিছুদিন ধরে অসুখে ভুগে শয্যাশায়ী ছিলেন। কান্নার আওয়াজ পেয়ে ভগবতী দেবী বুঝলেন সে বাড়ির অল্পবয়সি বউটার কপাল পুড়ল। তিনি সেখানে গেলেন। বিদ্যাসাগর অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগলেন। মা ফিরে আসতেই সবিস্তারে সব শুনে বিদ্যাসাগর কাঁদতে শুরু করলেন।
ছেলেকে প্রবোধ দিয়ে ভগবতী দেবী ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন— ‘হ্যাঁ রে ঈশ্বর, তুই তো অনেক পড়াশোনা করেছিস, এই যে মেয়েটা মাত্র বারো বছর বয়সে বিধবা হয়ে গেল— ওর কি আর বিয়ে দেওয়া যায় না। তোদের শাস্তরে কি এর কোনও বিহিত-বিধান নেই রে? শাস্তর যারা লিখে গিয়েছেন তাদের প্রাণে কি দয়ামায়া বলে কিছু নেই রে?’
প্রশ্ন শুনে বিদ্যাসাগর থ’ হয়ে গেলেন। মা-বাবা দু’জনেই এই কথা বলছেন। তাঁরাও বালিকা বিধবা হলে তাঁদের বিয়ের কথা ভাবছেন! আমার মা-বাবা! তার মানে শাস্ত্রে সমর্থন থাকলে তাঁরাও সমর্থন করবেন?
অতএব, বিধবা-বিবাহ আন্দোলনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা তাঁর মা-বাবাও।