বিদ্যার্থীরা মাঝে মধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
একুশের ভোটের প্রাক্কালে রাজনৈতিক উত্তাপের আঁচ পেতেই উত্তরবঙ্গে আসা। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে আসে কয়েকটি অচেনা গ্রামের কথা। সবক’টি গ্রামই একেবারে সীমান্তপারে। রাজনীতির ওঠাপড়ার খবরের পাশাপাশি মন টানে কাঁটাতার। খোঁজ করতে গিয়ে জানলাম বহু অজানা গল্প। কাজের ফাঁকেই বেরিয়ে পড়লাম সীমান্তপাড়ে ছোট ছোট জনপদের সন্ধানে। জলপাইগুড়ি শহর থেকে হলদিবাড়ি যাওয়ার রাস্তায় পড়ে বেরুবাড়ি গ্রাম। এখানে পৌঁছেই খোঁজ পেলাম সীমান্তের প্রথম অচেনা গ্রামের। এরপর এগিয়ে চললাম অজানার খোঁজে।
যেতে যেতে পথে পড়ল যমুনা সেতু। নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে সরু জলধারা। একে মজে যাওয়া খাল বললেও অত্যুক্তি হয় না। গ্রামবাসীদের কথায়, এর সঙ্গে যমুনা নদীর যোগ রয়েছে। সেখান থেকেই সেতুর এ হেন নামকরণ। এখান থেকে আরও ১০-১২ কিমি এগলে সীমান্ত, সেখানে কাঁটাতার। আমার গন্তব্য সেখানেই। হিন্দুপাড়া, অন্তুপাড়া, খেকিডাঙা, বাঙালপাড়া, সিপাইপাড়া ও খুদিপাড়া— এই ছ’টি গ্রাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কাঁটাতারের গায়ে।
আমি-আপনি যদি নতুন বাইক কিনতে শো-রুমে যাই, তাহলে পছন্দের পর দরদাম রফা হলে ‘বুক’ করে বাড়ি ফিরে আসি। যেদিন ডেলিভারি করা হয়, সেদিন নতুন অতিথিকে এনে বাড়ির গ্যারাজে রাখি। এর অন্যথা খুব একটা হয় না। তবে বেরুবাড়ি সীমান্তের গ্রামগুলিতে গাড়ি আর বাড়ি কিনতে গেলে অন্য গল্প শুনতে হবে। সেখানে বাইক কিনতে গেলে নানা ঝকমারি। যেদিন শো-রুমে গিয়ে বাইক বুক করবেন, সেদিনই আপনাকে সীমান্তবর্তী বিএসএফ ক্যাম্পে গিয়ে বাইকের বিস্তারিত তথ্য জমা দিয়ে আসতে হবে। হাজারো জিজ্ঞাসার পর তারা ছাড়পত্র দিলে তবেই ঘরে তুলতে পারবেন আপনার শখের যানটি।
স্থানীয় বাসিন্দা মহম্মদ আজিমুদ্দিনের কথায়, ‘ভাগ্যের পরিহাস বোধহয় একেই বলে। রাস্তায় বের হলে সবারই আধার কার্ড সঙ্গে রাখা বাধ্যতামূলক। কে ভারতীয়, আর কে বাংলাদেশি দেখে বোঝার উপায় নেই। সমস্যার সূত্রপাত গত শতাব্দীর ন’য়ের দশকে শুরু হলেও নিয়মের কড়াকড়ি গত সাত-আট বছরে খুব বেড়েছে।’ এই জমি ভারতের হলেও কাঁটাতারের বেড়া দিতে গিয়ে আলাদা হয়েছেন তাঁরা। তাঁদের জমি মিশেছে প্রতিবেশী দেশের মাটিতে। ফলে গ্রামে ঢোকা বা বিভিন্ন কাজের সূত্রে দেশের মূল ভূখণ্ডে আসতে হলে আধার কার্ডই একমাত্র রক্ষাকবচ। তা দেখিয়েই নিত্যদিন চলে এপার-ওপার। এখানকার ছ’টি গ্রামের বাসিন্দাদের এই রুটিনই ফলো করতে হয়। দেশের অন্য প্রান্তের বাসিন্দারা যখন নিশ্চিন্তে ব্যাগ বোঝাই করে বাজার থেকে ফেরেন, তখন এখানকার বাসিন্দাদের প্রতিদিন বাজার করে বাড়ি ফেরার পথে ব্যাগ খুলে দেখাতে হয় সীমান্তরক্ষীদের। যন্ত্রণার এখানেই শেষ নয়। আজিমুদ্দিনের মতোই আক্ষেপের কথা শোনালেন আরেক বাসিন্দা মনসুর আলি। বললেন, ‘আত্মীয়-স্বজনরাও এখানে আসতে বেশ বিব্রত বোধ করেন। কারণ তাঁরা তাঁদের ইচ্ছামতো আসতে পারেন না। তাঁরা আসার আগে বিএসএফ ক্যাম্পে গিয়ে আমাদের জানিয়ে আসতে হয়, কারা আসছেন, কী তাঁদের পরিচয়, কোথায় যাবেন, কতক্ষণ বা কতদিন থাকবেন ইত্যাদি। ফলে এত হ্যাপার কারণে অনেকেই কুটুমবাড়ি আসতে চান না। আপনারা করোনাপর্বে ৫০ জনকে নিয়ে বিয়ে বাড়ি চালাতে গিয়ে হাঁফিয়ে উঠছেন, আর আমাদের সারা বছর এই নিয়ম মেনে চলতে হয়। এখানে কারও বিয়ে হলে অনুষ্ঠানে কতজন অতিথি আসবেন, তারমধ্যে কতজন পুরুষ, কতজন মহিলা, তাঁদের নাম-ঠিকুজি— সবই আগাম জানাতে হয় বিএসএফ ক্যাম্পে। এ এক যন্ত্রণার জীবন!’
কেন এমনটা হল? গ্রামবাসীদের কথায়, স্বাধীনতার সময় থেকেই এখানকার সীমানা নিয়ে সমস্যা রয়েছে। ন’য়ের দশকে তা অবশ্য মিটে যায়। সিদ্ধান্ত হয়, ভারত-বাংলাদেশ সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হবে। এরপরই নতুন সমস্যার সূত্রপাত। জমির আকৃতি একটু অন্যরকম হওয়ায়, কাঁটাতার কীভাবে যাবে, তা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত সরকার এই ছ’টি গ্রামকে বাদ রেখেই সোজাসুজি কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে দেয়। ফলে ভারতীয় হয়েও ভারতের মূল ভূখণ্ডে থাকার অধিকার হারান তাঁরা। তাঁদের জমি মিশে রয়েছে বাংলাদেশের মাটির সঙ্গে। স্পষ্টবাদী আজিমুদ্দিন বলেন, ‘এই সমস্যা তৈরি হয়েছে প্রায় ২৫ বছর আগে। জমির অবস্থানগত কারণেই কাঁটাতারের ওপাশে রয়েছি আমরা। তাই আমাদের উপর সব সময় কড়া নজরদারি। এই ছ’টি গ্রামের প্রতিটি বাসিন্দা থেকে শুরু করে কোন বাড়িতে ক’টা গোরু, ক’টা ছাগল, ক’টা ভেড়া, বাড়িতে কী কী আসবাব, সাইকেল না বাইক, সব হিসেবই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে রয়েছে সীমান্তরক্ষীদের খাতায়। আর রয়েছে চোখরাঙানি। পাছে কেউ ভুল করে না বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে, তারজন্য প্রতিনিয়ত শুনতে হয় ধমক। ভারী বুটের আওয়াজে কান সয়ে গিয়েছে আমাদের। সীমান্তরক্ষীদের চোখরাঙানিও এখন গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। তবে পরিচয়পত্র সঙ্গে থাকলে ঝক্কি কিছুটা কমে। এভাবেই দিন কাটে আমাদের। ভারতের নাগরিক হয়েও প্রতিদিন আমাদের প্রমাণ দিতে হয় যে, আমরা ভারতীয়। এই জীবন বড়ই কষ্টের!’
সাত-আট বছর আগের কথা। বাঙালপাড়ায় এক গৃহস্থের বাড়িতে জনাকয়েক অতিথি এসেছিলেন। কিন্তু তাঁরা গ্রামে ঢুকে বাড়ি ভুল করে পা রেখেছিলেন বাংলাদেশের মাটিতে। ব্যস, আর যায় কোথায়! সে দেশের সীমান্ত প্রহরীদের চোখ এড়ায়নি বিষয়টি। ফলে যা হওয়ার তাই হল। অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল সেই অতিথিদের। এ নিয়ে জলঘোলা কম হয়নি সেই সময়ে। তারপর থেকেই বিএসএফ ফতোয়া দিয়ে জানিয়ে দেয়, সব গ্রামবাসীকেই সব সময় সঙ্গে আধার কার্ড নিয়ে ঘুরতে হবে। সিপাইপাড়া গ্রামে থাকেন মহম্মদ নবিউল ইসলাম। তাঁর অভিজ্ঞতার কথা শোনাতে গিয়ে বললেন, ‘একদিন বাজারে গিয়েছিলাম। সঙ্গে আধার কার্ড নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে সীমান্ত চৌকিতে পথ আটকে গ্রামে ঢুকতে বাধা দেন জওয়ানরা। নিরুপায় হয়ে বাড়িতে ফোন করে আধার কার্ড আনার ব্যবস্থা করি। তারপর বাড়ি যাওয়ার অনুমতি পাই। এভাবেই দিন কাটে আমাদের।’ একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা শোনা গেল অন্যদের মুখেও। তাঁদেরই একজন বললেন, কয়েক বছর আগে কাঁটাতারের বেড়ার অবস্থান বদল করে সীমান্তের এই ছ’টি গ্রামকে ভারতের মূল ভূখণ্ডে ঢুকিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সেকারণে মাপজোকও হয়েছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু, ওই পর্যন্তই। কাজ কবে শুরু হবে, সেদিকেই এখন তাকিয়ে ছ’টি গ্রামের কয়েক হাজার বাসিন্দা।
ভোট রাজনীতির খোঁজে এবার গন্তব্য পাশের জেলা কোচবিহার। এখানে ছিটমহলের ইতিহাস অনেকেরই জানা। এখানকার বাসিন্দাদের কষ্টের কথাও কমবেশি শুনেছি অগ্রজদের কাছে। কিন্তু, যে এলাকায় গিয়েছিলাম, সেখানকার গল্প একটু অন্যরকম। দিনহাটা ব্লকের মধ্যেই পড়ে নাজিরহাটের মশালডাঙা ছিটমহল এলাকা। একে টপকে গেলেই নোটাফেলা গ্রাম। কাঁটাতার ঘেঁষা এই গ্রাম প্রথম থেকেই ভারতের অংশ। ছিটমহলের মতো যন্ত্রণা এখানকার মানুষকে ভোগ করতে হয়নি। কিন্তু, এ যন্ত্রণাও কম কীসের? বলছিলেন স্থানীয় কৃষক সুশীল বর্মন। বাড়ির কয়েক হাত দূরেই কাঁটাতারের বেড়া। ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমান্ত। সীমানার এপারে ঘর, আর ওপারে চাষের জমি। কাঁটাতার পেরিয়ে পাঁচ বিঘা জমিতে রোজ চাষ করতে যান সুশীলবাবু। তাঁর কথায়, সীমান্ত ভাগাভাগি হলেও প্রথমে এত কড়াকড়ি ছিল না। ফলে সেখানে গিয়ে নিজের জায়গায় চাষ করতে অসুবিধাও হতো না। কিন্তু, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কড়াকড়ি বেড়েছে সীমান্তে। এখন কাঁটাতার দু’ভাগ করেছে দুই দেশকে। তাই প্রতিদিন সকালে পরিচয়পত্র দেখিয়ে সীমান্ত চৌকির অনুমতি নিয়ে ওপারের জমিতে চাষ করতে যেতে হয়। আবার বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই কাজ সেরে ফিরে আসতে হয়। ইচ্ছা থাকলেও নিজের জমিতে বেশি সময় থাকার উপায় নেই। সীমান্ত পাহারায় যাঁরা থাকেন, তাঁদের সঙ্গে পরিচিতি হয়ে যাওয়ায় কিছুটা সুবিধা হয় বটে, তবে সেই সুযোগ রোজ মেলে না। অফিসাররা মাঝেমধ্যে বদলি হয়ে গেলে আবার যে কে সেই অবস্থা। নতুন অফিসারের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় না হওয়া পর্যন্ত চলে এ যন্ত্রণা। চলতেই থাকে।
নোটাফেলা গ্রামেই থাকেন রাজবালা অধিকারী। বয়স চার কুড়ি ছুঁই ছুঁই। স্মৃতি হাতড়ে বলছিলেন সেকালের কথা। তাঁর কথায়, ‘অবিভক্ত বাংলাদেশে জন্মেছি। দেশভাগ হওয়ার পরেও তখন সীমান্তে এত কড়াকড়ি ছিল না। কাঁটাতার তো এ যুগের বেড়া। আমার বয়স যখন ১৫ বছর, তখন স্বামীর সংসার করতে চলে আসি এপারে। তারপর থেকে এখানেই কেটেছে বাকি জীবন। সাংসারিক চাপে একবারের জন্যও আর বাপের বাড়ি যাওয়া হয়নি। এখন সেখানে কেউ বেঁচে আছে কি না, তাও জানি না।’ কাঁটাতার নিয়ে কথা উঠতেই রাজবালাদেবী বলে উঠলেন, ‘তার দিয়ে কখনওই মানুষের মনে বিভেদ তৈরি করা যায় না। বরং ছেদ টানে যোগাযোগ ব্যবস্থায়। আর সেকারণেই মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের দূরত্ব বেড়ে যায়।’
কথায় কথায় উঠে এল ছিটমহল প্রসঙ্গ। ছিটমহলের বাসিন্দারা কোন দেশের নাগরিক তা নিয়ে বহুদিন থেকেই ধন্দ রয়েছে। তাঁদের নাগরিকত্ব পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে তুফান উঠেছে রাজনৈতিক মহলে। হয়েছে কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ। দু’দেশের সহাবস্থানের ফলে অবশ্য শেষ পর্যন্ত নাগরিকত্ব পেয়েছেন ছিটমহলের মানুষ। কিন্তু হলে কী হবে, সমস্যা রয়ে গিয়েছে সেই তিমিরেই। তাঁদেরই একজন সফিকুল ইসলাম। কয়েক বছর আগে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে চাকরির পরীক্ষা দিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু দেশরক্ষার কাজে তাঁকে নেওয়া হয়নি শুধু ছিটমহলের জটের কারণে। কিন্তু, কেন এমনটা হল?
একরাশ যন্ত্রণাকে বুকে চেপে সফিকুল বলছিলেন সেই কথাই। ছিটমহলে থাকাকালীন এখানকার বাসিন্দাদের নিজস্ব কোনও পরিচয়পত্র ছিল না। স্কুলে ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে, মোবাইলের সিম কেনা— সবেতেই দরকার হয় পরিচয়পত্র। আর তা না থাকায় সফিকুলকেও আর পাঁচজনের মতো ভাড়া করতে হয়েছিল ‘বাবা’। অনেকেই ‘ভাড়া করা’ বাবা-মায়ের নামে নিজেদের পরিচয়পত্রও বানিয়েছিলেন সেই সময়। এই গেরোতেই আটকে গিয়েছে চাকরি। সফিকুল দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়কে (যিনি ছিটমহলবাসী ছিলেন না) বাবা বলে পরিচয় দিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন স্কুলে। পরবর্তী সময়ে রেশন কার্ড যখন তৈরি হয়, তখন স্কুলের কার্ডই হয়ে উঠেছিল প্রমাণপত্র। ফলে সেই ভাড়াটে বাবার নামই উঠে আসে রেশন কার্ডে। ২০১৫ সালে ছিটমহল জট কাটাতে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত হয়। ফলে এদিকে থাকা বাংলাদেশের ছিটমহল ভারতের জমি হিসেবে চিহ্নিত হয়। একই পরিণতি হয় ওপারের ছিটমহলবাসীদের। এপারের লোক পেয়ে যান ভারতীয় নাগরিকত্ব। একে একে হাতে পান ভারতীয় পরিচয়পত্র অর্থাৎ ভোটার কার্ড, আধার কার্ড। এই পর্বে এসে সফিকুলদের জটিলতা আরও বেড়ে যায়। স্কুলের সার্টিফিকেট আর সরকারি পরিচয়পত্রে দেখা যায় বাবার নাম আলাদা। সফিকুলের দাবি, সেনাবাহিনীতে যখন নির্বাচন হয়েছিল, তখন বলা হয়েছিল, ছিটমহলবাসী হওয়ায় তাঁর ক্ষেত্রে নিয়ম কিছুটা শিথিল করা হবে। কিন্তু, শর্ত একটাই। যাঁকে তিনি বাবা বানিয়ে এতদিন স্কুলে পড়েছেন কিংবা অন্যান্য পরিচয়পত্র তৈরি করেছেন, তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে আনতে হবে বাস্তব ঘটনা। এখানেই বেঁকে বসেন ভাড়াটে বাবা। তিনি ওই স্বীকারোক্তি লিখিতভাবে দিতে অস্বীকার করায় সেনাবাহিনীতে চাকরির সুযোগ হাতছাড়া হয় সফিকুলের। যুবকের আক্ষেপ সেখানেই।
সফিকুল একা নন, তাঁর মতো সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন আরও ন’-দশজন যুবক। এখন নথিপত্রে সঠিক তথ্য লিপিবদ্ধ করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছেন তাঁরা। যদি সেই আর্জি ধোপে না টেকে, তাহলে চাকরি পাওয়ার স্বাদ অধরাই থেকে যাবে সফিকুলদের মতো যুবকদের। এই জটিলতা থেকে দ্রুত মুক্তি চান তাঁরা। তাঁদের কথায়, সীমান্তের জীবনযাত্রা এমনিতেই কঠিন। তার উপর রয়েছে ছিটমহলের কালো ইতিহাস। এই অবস্থায় সরকার এখানকার মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যবস্থা না নিলে তাঁদের পক্ষে সুষ্ঠভাবে বেঁচে থাকাই মুশকিল।
ছিটমহলের আরেক যন্ত্রণার ছবি ধরা পড়ল মধ্য মশালডাঙায়। যাকে বলে ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে’। স্থানীয় বাসিন্দা জয়নাল আবেদিন বললেন, তাঁদের জমি-জায়গা ভারতের মধ্যে থাকলেও তা একদা বাংলাদেশের বলেই চিহ্নিত ছিল। তাই রাস্তার ধারে জায়গায় জায়গায় বা চাষের জমির মাঝে বাংলাদেশের পিলার লাগানো হয়েছিল। ছিটমহল হস্তান্তর হলেও, সেই পিলার এখনও সরানো হয়নি। ফলে ভারতের বুকেই জ্বলজ্বল করছে বাংলাদেশের পিলার। বাইরে থেকে যাঁরা আসেন, তাঁরা এসবের ছবি তুলে নিয়ে যান। স্থানীয় মানুষের কাছে এই পিলার এখনও ছিটমহলের যন্ত্রণাকে মনে করিয়ে দেয়। তাই ছিটমহল থেকে মুক্তি মিললেও সেই জীবনযাত্রা এখনও রয়ে গিয়েছে পরতে পরতে।
কোচবিহারের আরেক প্রান্তে মেখলিগঞ্জ। ভোটের খবর করতে যখন এখানে পৌঁছলাম, তখন মন টানল সেই তিনবিঘা করিডর। এই বিতর্কিত জমি নিয়ে কম রক্ত ঝরেনি এক সময়ে। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যবর্তী অংশে এ এক অদ্ভুত জায়গা। বাংলাদেশের মানুষকে প্রতিদিন ভারতের জমির উপর দিয়েই যেতে হয় নিজের দেশের অন্য প্রান্তে। এই সীমান্তের মানুষের কাছে তিনবিঘা করিডরের স্মৃতি বেশ কষ্টদায়ক। এর একদিকে বাংলাদেশের লালমণিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলা। অন্যদিকে, তিস্তার চরে বাংলাদেশের দহগ্রাম ও আঙ্গারপোতা গ্রাম। আর ভারতের দু’দিকে ১০৪ নং ফুলকাডাবরি গ্রাম ও দক্ষিণ বেরুবাড়ির ১১৫ নং উপচৌকি কুচলিবাড়ি গ্রাম। এই গ্রামগুলির একেবারে মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছে তিনবিঘা করিডর। স্বাধীনতার সময় থেকেই এ সব গ্রামের কোনটা কোনদিকে থাকবে, তা নিয়ে জোর বিতর্ক চলেছে। শেষ পর্যন্ত পাটগ্রাম, দহগ্রাম ও আঙারপোতা বাংলাদেশে এবং বাগডোগরা ফুলকাবাড়ি ও কুচলিবাড়ি (দক্ষিণ বেরুবাড়ির অংশ) ভারতের অংশ হিসেবে চিহ্নিত হয়। সমস্যার সূত্রপাত এখানেই । কারণ পাটগ্রাম থেকে দহগ্রাম যেতে হলে ভারতের মাটি পেরতেই হবে। গত শতাব্দীর আটের দশকে এনিয়ে দু’দেশের মধ্যে রফাচুক্তি হয়। কিন্তু, তা কার্যকর করতে আরও সময় গড়িয়ে যায়। এরপরে ন’য়ের দশকে এনিয়ে প্রতিবাদে শামিল হন ভারতীয় গ্রামের বাসিন্দারা। শুরু হয় আন্দোলন। শেষ পর্যন্ত ন’য়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে পাটগ্রাম থেকে দহগ্রাম বা আঙ্গারপোতা যাওয়ার জন্য তিনবিঘা করিডরকে বাংলাদেশিদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। যদিও সেই সময় সারাদিনে কয়েক ঘণ্টার জন্য এই করিডর ব্যবহার করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালে বাংলাদেশিদের স্বার্থে এই করিডোর ২৪ ঘণ্টার জন্য খুলে দেওয়া হয়। লালমণিরহাটের বাসিন্দা বছর ত্রিশের শেখ সালাউদ্দিন অপু বলছিলেন, ‘আমার দিদির বাড়ি আঙ্গারপোতায়। ছোটবেলা থেকে বাবা-মায়ের কাছে শুনেছি সেসব কথা। কিন্তু, কোনওদিন আসার সুযোগ পাইনি। কারণ ভারতের মাটি টপকে আঙ্গারপোতা যাওয়াটা খুব সহজ ছিল না সেই সময়। তাই এতদিন আসা হয়নি। শেষ কয়েক বছরে অবশ্য চিত্রটা অনেকটাই বদলেছে। তাই এখন যখন-তখন দিদির বাড়ি আসা কিংবা দিদির বাপের বাড়ি যাওয়ার সুযোগ হয়েছে।’ অন্যদিকে, ভারতের দক্ষিণ বেরুবাড়ির এক বাসিন্দার কথায়, ‘এই করিডর যদি বাংলাদেশের হতো, তাহলে আমাদের পক্ষে যাতায়াত করা মুশকিল হয়ে যেত। তবে এখন কোনও সমস্যা নেই। দু’দেশের মানুষ অনায়াসেই যাতায়াত করতে পারেন তিনবিঘা করিডর দিয়ে।’ বাংলাদেশের দহগ্রামের এক বাসিন্দা বললেন, দীর্ঘদিন বন্দিদশা কাটিয়ে এখন মুক্তির আনন্দ পেয়েছি। আর আমরা বন্দিদশায় ফিরতে চাই না।
বাংলাদেশ সীমান্তের অচেনা গ্রামের অজানা কথার টুকরো ছবি দিয়ে সাজানো এই ক্যানভাস অপূর্ণ থেকে যায় ভুটান সীমান্তের চামুর্চির কথা না বললে। জলপাইগুড়ি-ভুটান সীমান্তের ছোট্ট জনপদ চামুর্চি। এখানে ভুটানে প্রবেশদ্বারের মুখেই রয়েছে নিউ চামুর্চি বাজার। এই গল্পটা একটু অন্যরকম। সীমান্তের ভাগাভাগি, উচ্ছেদ, কাঁটাতার— এসব এখানকার মানুষকে আলাদা করেনি। এখানে সীমান্তকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগই করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। চামুর্চি-ভুটান সীমানার ‘শেষ বাড়ি’র বাসিন্দা রেখা ভুটিয়ার কথায়, সীমান্ত খোলা থাকলেও তাঁদের কোনও দুঃখ নেই। কারণ তাঁদের গ্রামের গোটা অর্থনীতি ও মানুষের জীবনযাত্রা পুরোটাই দাঁড়িয়ে আছে সীমান্ত বাণিজ্যের দৌলতে। করোনা আবহে সেই বাণিজ্য এখন বন্ধ। তাই কষ্টেই দিন কাটছে তাঁদের। তাঁদের কাছাকাছি শহর বলতে বানারহাট। কিন্তু, চামুর্চির সিংহভাগ মানুষই নির্ভরশীল ভুটানের সামচি জেলার উপর। ভারতীয় ভূখণ্ডে যোগাযোগ ব্যবস্থা মসৃণ না হওয়ায় এখানকার মানুষকে ভুটানের উপরেই ভরসা করতে হয়। স্থানীয় স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক সুশীল শর্মা জানালেন, প্রায় একশো বছর আগে তাঁর বাবা কর্মসূত্রে এখানে এসেছিলেন। সেই থেকেই এখানে বাস এই পরিবারের। তাঁর জন্মও এখানে। কিন্তু, এত বছরেও বিশেষ বদল হয়নি চামুর্চির। প্রয়োজনে বা বিপদে আপদে বানারহাট বা জলপাইগুড়ি কিংবা শিলিগুড়ি যাওয়ার বদলে এখানকার মানুষ ভুটানকেই বেশি পছন্দ করেন।
করোনা সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে নতুন নতুন সংগ্রামের সম্মুখীন হচ্ছি আমরা। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এই লড়াই চালাতে গিয়ে ক্লান্ত সকলেই। একইভাবে ক্লান্ত সীমান্তের প্রত্যন্ত গ্রামের সেই মানুষজন, যাঁরা নিত্যদিন আরও কঠিন লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছেন উজানের পথে। নতুন সকালের অপেক্ষায় আমরা সকলেই।
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : অভিষেক গোস্বামী