দীর্ঘদিনের আটকে থাকা কর্মে সফলতা। ব্যবসায় বাড়তি বিনিয়োগের প্রচেষ্টায় সফলতা। ভ্রমণ যোগ আছে। ... বিশদ
নবাবের শহর লখনউ গিয়েছিলাম এলাহাবাদ থেকে ট্রেনে চড়ে। অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল, নবাবের এই শহরের বিখ্যাত ভুলভুলাইয়া ঘুরে দেখার। লখনউ জংশন স্টেশন থেকে হোটেলে চেক-ইন করার পর ব্রেকফাস্ট করেই আমরা রওনা দিয়েছিলাম লখনউয়ের বড়া ইমামবাড়া দেখতে। এখানেই রয়েছে আমাদের অত্যন্ত আগ্রহের ভুলভুলাইয়া। বইতে ছোটবেলা থেকেই পড়ে জেনেছিলাম, শত্রুপক্ষকে বিভ্রান্ত করতেই এই ভুলভুলাইয়া বানানো হয়েছিল। একই রকম দেখতে চারটি রাস্তা চার দিকে গিয়েছে, তার মধ্যে তিনটি রাস্তা ভুল, একটি ঠিক! ভাবছিলাম গাইডের সাহায্য ছাড়া নিজেরাই কি পারব সেই সঠিক রাস্তা ধরে বাইরে বেরতে? যাচাই করে দেখার কোনও পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আগেই বড়া ইমামবাড়ার সামনে থেকে আমাদের ছেঁকে ধরল গাইডের দল। তার মধ্যে একজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে ঠিক করে ঢুকলাম ইমামবাড়ার ভিতরে। সামনেই বিশাল সুন্দর মাঠ বেশ ভালোভাবে সাজানো। আমাদের গাইডের নাম ছিল মহম্মদ আশিক। তরতাজা যুবক। আমাকে পরিচয়ের পরেই জিজ্ঞাসা করে বসলেন, আমরা লখনউয়ের বিরিয়ানি খেয়েছি কি না! বাঙালি টুরিস্টরা বিরিয়ানি খেতে ভীষণ ভালোবাসে বলেই আশিকের এমন প্রশ্ন। কিছুক্ষণ আগে লখনউ পৌঁছেছি, লাঞ্চ সারা বাকি, তাই তাঁর পরিচিত এক বিরিয়ানি আর কাবাবের দোকানের সন্ধান দিতেও ভোলেননি আশিক। এইসব কথা বলতে বলতেই প্রথম বিশাল দরজা পেরিয়ে গেলাম। সে যেখানে নিয়ে গেল, দেখে মন ভীষণ খারাপ হল। এই ভুলভুলাইয়া! কোথায় সেই গোলকধাঁধা? আশিককে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি জানালেন এর ভিতরেই রয়েছে আমাদের কৌতূহলের ভুলভুলাইয়া। তবে সেটা দোতলায়। কয়েকটি বড় সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে উপরে উঠে প্রথমে ঢুকলাম ইমামবাড়ার ভিতরে। বিশাল একটা ঘর। যার মধ্যে কোনও পিলার নেই, যা আমাদের আশ্চর্য করেছিল। এরপর আমরা এসে পৌঁছলাম বিখ্যাত সেই ভুলভুলাইয়াতে। প্রথমেই আশিক আমাদের নিয়ে গেল ভুলভুলাইয়ার ছাদে। সেখান থেকে সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে নীচে নামতে হবে। যেখানে চারটি রাস্তা রয়েছে। এই সুড়ঙ্গের ছাদের আকৃতি ইংরেজি অক্ষর ‘ভি’-এর মতো। আশিক সাবধান করে দিল, যত নীচে নামব ততই নাকি গোলকধাঁধায় ফেঁসে যাব। এমনভাবে গাইড কথাগুলো বলছিল, যে আমরা এমনিতেই বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আমরা তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, গোলকধাঁধার পথে সে আমাদের সঙ্গে যাবে কি না! উত্তরে আশিক জানাল, অবশ্যই যাবে। তবে একটা নির্দিষ্ট এলাকা পর্যন্ত। এরপরে আমাদের নিজেদের রাস্তা খুঁজে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা আরও ঘাবড়ে গেলাম। নিজেরা যদি গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাই! আমাদের আশ্বস্ত করে গাইড জানাল, আমাদের ঠিক সে খুঁজে নেবে। একথা শুনে ঠিক রহস্যটা বুঝতে পারছিলাম না। আমরা নীচে যাওয়ার আগে ভুলভুলাইয়ার ইতিহাস সংক্ষেপে জানালেন গাইড মহম্মদ আশিক প্রায় মুখস্থের ঢঙে।
বললেন, নবাব হোসেন আলিম শাহদাতের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এই ভবনটি তৈরি করেছিলেন। কারাবালার যুদ্ধে হোসেন আলি শাহদাতের স্মরণে এখানকার তৎকালীন নবাব আসাফ-উদ-দৌল্লা এই বিশাল ইমামবাড়াটি তৈরি করেন। তার আগে আরও একটা কারণ ছিল, সেসময়, মানে ১৭৭৩ সালের গরমকালে লখনউতে প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। সেই সময় এলাকার প্রজাদের আর্থিক সাহায্য করতেই এই বড়া ইমামবাড়া বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নবাব। প্রবাদ আছে, এই ইমামবাড়া দিনের বেলা যতটা তৈরি হতো, আবার রাতের অন্ধকারে সেটা আবার ভেঙে দেওয়া হতো। আসলে কারণটা নাকি এরকম ছিল, সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষরা দিনের আলোয় সবার সামনে কাজ করে পারিশ্রমিক নিতে ইতস্তত করতেন। অথচ, দুর্ভিক্ষে তাঁরাও ভুগছিলেন। অন্য সাধারণ প্রজারা দিনে ইমামবাড়া তৈরি করে পারিশ্রমিক পেতেন, আর সমাজের গণ্যমান্যরা রাতের অন্ধকারে ইমামবাড়ার তৈরি হওয়া অংশ ভেঙে নবাবের কাছ থেকে পারিশ্রমিক নিতেন। এভাবেই সমাজের সব মানুষের একটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন নবাব আসাফ-উদ-দৌল্লা। এভাবেই প্রায় এগারো বছর ধরে অর্থাৎ ১৭৮৪ সালে তৈরি হয়েছিল এই ইমামবাড়া ও তার মধ্যে তৈরি ভুলভুলাইয়া।
গাইড আরও জানলেন, এই ৩৩০ মিটার লম্বা ভুলভুলাইয়ায় রয়েছে মোট ১০২৪টি করিডোর এবং ৪৪৯টি একরকম দেখতে ঢোকার রাস্তা। এই ভুলভুলাইয়া থেকে বাইরে বের হওয়ার রাস্তা রয়েছে মাত্র দুটো। তবে আশ্চর্যের একটা বিষয় হল, কোনও সিমেন্টের ব্যবহার করা হয়নি এখানে। নানারকম ডাল, সব্জি, তেল আর চুন দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এই ইমামবাড়া তথা ভুলভুলাইয়া।
গাইড দেখলাম, আমাদের সকলকে ভুলভুলাইয়ার দেওয়ালে কান রাখতে বলছেন। আমরাও সেটা করলাম। এবার আরও একবার আশ্চর্য হওয়ার পালা! দেখলাম, আমাদের গাইড আশিক, অন্যদিকে চলে যাচ্ছেন! ভেবে আঁতকে উঠলাম, আমাদের এখানেই ছেড়ে চলে যাবে নাকি আশিক! এরপর আমাদের নিজেদের চেষ্টায় বাইরে বের হতে হবে! দেখলাম, না! আশিক দেওয়ালের অন্যদিকে দিয়ে ভুলভুলাইয়ার দেওয়ালে মুখ নিয়ে খুব ফিসফিস করে আমাদের নাম ডাকছেন! আমরা নিজেদের নামগুলো দেওয়ালে কান রেখে পরিষ্কারভাবে শুনতে পাচ্ছিলাম। এবার আশিক আমাদের কাছে এসে বললেন, ‘এটাই এখানকার রহস্য। কথা আছে না, দেওয়ালেরও কান আছে! দেখলেন তো! কথাটা মিথ্যা নয়।’ পরে অবশ্য জানাল, বাইরের শত্রুরা কখনও ইমামবাড়ায় আক্রমণ করতে এলে এভাবেই পাহারায় থাকা সৈন্যরা অন্য সৈন্যদের শত্রুদের সম্পর্কে সচেতন করে দিত। তার আসল কারণ হল, এখানকার দেওয়ালগুলোর ভিতরের অংশ ফাঁপা। তাই শব্দ সহজেই এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে যায়।
এখান থেকেই দেখলাম ‘চোর দরওয়াজা’। ইমামবাড়ার ভিতরে এমন এক জানালা রয়েছে, যা দিয়ে বাইরে থেকে কে ইমামবাড়া বা ভুলভুলাইয়ায় ঢুকছে সহজেই সেটা দেখা যায়। অথচ প্রবেশকারী বুঝতেই পারতেন না, তার উপর লক্ষ রাখছেন এখানকার সৈন্যরা। আশিক বললেন, ‘সেকালের সিসি ক্যামেরার কাজ করত এই চোর দরওয়াজা।’
ভুলভুলাইয়ার পাশেই রয়েছে ‘শাহি বাউলি’ চারপাশে একটা বড় কুয়ো ঘেরা জায়গা। ইমামবাড়া তৈরির সময় জলের জোগান দিতেই এই কুয়ো নাকি তৈরি করা হয়েছিল। গাইড জানালেন, দূর থেকে বয়ে চলা গোমতী নদীর সঙ্গে এক নবাবের আমলে এই কুয়োর যোগাযোগ ছিল। গোমতী নদী থেকেই এই কুয়োয় নিয়মিত জল আসত। দেখছিলাম, আর ভাবছিলাম, কী অপূর্ব নির্মাণ কৌশল ছিল অত বছর আগেও!
এবার আমাদের গাইড জানালেন, তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন বাইরে। আমাদের এই গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমরা সবাই আপত্তি করলাম। না! এটা করা যাবে না! এভাবে আমাদের ভুলভুলাইয়ার ভিতরে একা ছেড়ে যাওয়ার জন্য আমরা গাইড নিয়েছি নাকি! তিনি আমাদের আশ্বস্ত করলেন আবার, ‘কোনও ভয় নেই। আপনারা যে পথেই যান না কেন, আমি ঠিক আপনাদের খুঁজে নেব!’ এটা আবার হয় নাকি! আমরাও অবাক! যাই হোক, মজা না করলে আর এত দূরে এই অ্যাডভেঞ্চার করতে এলাম কেন? দেখাই যাক না কী হয়! ভুলভুলাইয়ার চাপা ছোট সুড়ঙ্গের ভিতরের ভিড়ের চিৎকার চেঁচামেচির মধ্যেও আমাদের মাথায় ছিল, গাইডের প্রথম দিকের একটা কথা। ‘যত নীচে নামা যাবে, তত রাস্তা গুলিয়ে যাবে।’ সুতরাং আমাদের লক্ষ্য হবে উপরের দিকের সিঁড়ির সুড়ঙ্গ ধরে এগিয়ে চলা। ভেবে সবাই মিলে এগতে শুরু করলাম। অবশেষে একটি চার-সুড়ঙ্গের শেষে এসে দেখি আমাদের গাইড আশিক আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছেন! তাঁকে দেখতে পেয়ে আমরাও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কত গল্প শুনেছিলাম এই ভুলভুলাইয়া নিয়ে। ইংরেজ আমলে নাকি কত ব্রিটিশ সৈন্য এখানে পথ হারিয়ে আর বাইরে বের হতে পারেননি। তবে কি তাঁরা জানতেন না, নীচে নয়, উপরেই রয়েছে ভুলভুলাইয়ার গোলকধাঁধা থেকে বাইরে বের হওয়ার আসল রহস্য। এই প্রশ্নের উত্তর এখন আর পাওয়া যাবে না। বাইরের ছাদে এসে আমরা দেখলাম, উন্মুক্ত রোদ ঝকমকে ছাদ থেকে লখনউ শহরের একাংশকে। এবার রওনা দেব লখনউয়ের আর এক বিখ্যাত দর্শনীয় জায়গা, রেসিডেন্সি দেখতে।
কীভাবে যাবেন: ট্রেন পথে হাওড়া থেকে লখনউ পৌঁছনোর একাধিক ট্রেন রয়েছে। আকাশ পথেও কলকাতা থেকে লখনউ পৌঁছানো যায়।