পড়ে গিয়ে বা পথ দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্তির যোগ থাকায় সতর্ক হন। কর্মে উন্নতি ও সাফল্যের যোগ। ... বিশদ
ঠাম্মা ভবসুন্দরী দেবী ওরফে ভবির মনে বড় সাধ তাঁর একমাত্র নাতনির বিয়ে হবে তাঁদের দেশের বাড়ি পুরুলিয়ায়। অঢেল জায়গা সেখানে। গাঁয়ের লোকরা সব আসবে, পাত পেড়ে খাবে। কোনও কিছুতেই অসুবিধে নেই। অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে বাগান বাড়িটাকে রংটং করিয়ে ফুল দিয়ে কেয়ারি করে সাজাবেন, আলো দেবেন— এই সবই মনে মনে ভেবেছেন ভবসুন্দরী। এদিকে নাতনি মশগুল হয়ে আছে আগ্রায় ডেস্টিনেশন ওয়েডিং নিয়ে। তাজমহলের ব্যাকড্রপ থাকলে তো আরও ভালো। একটা ‘এপিক’ ব্যাপার হবে তবে।
—ওরে আনন্দনাড়ু, শ্রী-বরণডালা, হলুদ কোটা, হাই-আমলা বাটা, মোনামুনি ভাসানো, জল সইতে যাওয়া... এসব স্ত্রী আচার কি আর ভিন রাজ্যে সম্ভব রে? বলেন ভবি।
তিনি আবার নাতনিকে আদর করে ডাকেন ‘ভাবনা’ বলে। তা সে অযোধ্যা বা আগ্রা যেখানেই বিয়ে হোক, ভাবনা বিয়ের পর বরের সঙ্গে আমেরিকা পাড়ি দেবে। ফলে বিয়েটা তার কাছে একটা ‘রিচুয়াল’ বই তো নয়। ভাবনা এবার বাঁড়ুজ্জে থেকে ভট্চাজ (ভট্টাচার্য) হচ্ছে।
ভবি ভাবলেন, আহা জব্বর হবে নামখানা ভাবনা ভট্টাচার্য!
ভাবনার ভাবী বর আবার ভট্চাজকে ছেঁটেকেটে ‘ভট’ করে নিয়েছে। বিদেশে নাকি তাতেই সুবিধে! বিয়ের কার্ডে তা দেখে ভবির প্রায় হার্ট অ্যাটাক হওয়ার জোগাড়। তার উপর আবার ভাবনা আগুনে ঘি ছিটিয়ে ঠাম্মাকে জানিয়েছে, আরে বাবা! বিয়ে করছি বলে কি আর আমি তার পদবি নেব নাকি? তুমিও যেমন।
—নিবিনে? কী জানি বাপু! আমরা এমন বিয়ে তো দেখিনি জন্মেও। বিয়ের আগের দিন আমাদের এলাহি আইবুড়ো ভাত হয়েছে। বন্ধুদের সঙ্গে পঙক্তিভোজে বসে ভাত খেয়েছি পছন্দের সব পদ দিয়ে। আর তোরা কী করলি? না, সন্ধেবেলা চললি কীসব ব্যাচেলর পার্টি করতে! বলি বিয়ের আগের দিন কি পার্টি টাইম? কোথায় বাড়ির লোকের সঙ্গে একটু সময় কাটাবি তা না!
—উফফ! তুমি পারোও গো ঠাম্মা, এতদিন তো তোমাদের সঙ্গেই ছিলাম। আগের দিন হল লেডিজ নাইট। সঙ্গীত! ডিজের সঙ্গে ‘আজ বসন্তের গায়ে হলুদ, কাল বসন্তের বিয়া গো...’ এইসব গানে একটু কোমর না দোলালে চলে? অঙ্গে জ্বলে সব নারঙ্গি লেহেঙ্গা।
—দুপুর থেকে তারা আবার দু’হাতে গোবরের সুচারু আলপনা মেখে বসে আছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তোর বন্ধুদের কেউ বা নাকে নোলক পরে নাচছে সাউন্ড বক্স ফাটিয়ে।
—উফফ! ঠাম্মা চুপ করবে একটু? এই জন্যেই তোমার মা তোমার ভবি নাম দিয়েছিল। ওটা গোবর নয় মেহেন্দি। ওটা লাগায় বরের মঙ্গলের জন্য।
—মঙ্গলটঙ্গল না হাতি! বিয়ের আগেই তুই বলেছিস বরের পদবি নিবি না। বিয়ের পরে বর থাকবে মিসিসিপির এপারে আর তুই ওপারে, মাঝখানে নদী ওই বয়ে চলে যায়...। শাঁখা, পলা, নোয়া, সিঁদুর কিস্যুটি তো পরবি না। বর, বিয়ে সব নামেই। আইন মেনে করতে হয় তাই করা।
—হল তো? আরও বলো কী বলবে। এ শুধু শোনার দিন, এ লগন শুনেই যাওয়ার...।
—আমরা তো বিয়ের আগে বরকেই চোখে দেখিনি। এক্কেবারে চারচোখের মিলন হল সেই শুভদৃষ্টিতে ছাদনাতলায়। আর তোরা তো বিয়ের আগে কত্তবার ঘুরলি, বেড়ালি, হোটেলে খেলিদেলি।
আরও কত কিছু করেছি আমরা তা যদি জানত ঠাম্মা... তাহলে বোধহয় হার্টটা বন্ধই হয়ে যেত। এই ভেবেই ভাবনা নিজের মোবাইলে সেদিনের পার্টিতে ফুর্তির ছবিটায় ঝটিতি চোখ বুলিয়ে নিল একবার টুক করে। আরও আছে। ভাগ্যিস ঠাম্মা সেদিন ঘুমিয়ে পড়েছিল। মধ্যরাতে বাড়ি ফিরেছিল হবু বরের সঙ্গে একটা স্পোর্টস পাব থেকে। আমেরিকা থেকে আনা দামি সিগারের গন্ধটাও পরখ হয়েছে অল্পবিস্তর। ছোট্ট এই জীবন, যদ্দিন আছ ‘লিভ লাইফ কুইন সাইজ!’, বুঝেছ ঠাম্মা? সেদিনের ছবিগুলো স্ক্রোল করতে করতে নিজের মনেই হাসছিল ভাবনা।
—কী হল রে? নাতজামাইয়ের মেসেজ? কী বলল আমায় বল?
—বলল, তোমার ঠাম্মা ইজ সো কিউট হানি!
—হানি? বাহ! বিয়ের আগেই মধুমতী? মধুচন্দ্রিমার পরে এই মধুপিরিতির চাঁদে যেন গ্রহণ না লাগে।
—আরে না গো। মধুমতী, মালতী কিছুই নয়। আমেরিকায় অমন আকছার হানি বলে লোকে। এই যেমন তোমায় আমি বলি সুইট হার্ট।
—থাক বাপু, আমায় ওসব মিষ্টি হৃদয়, ফুসফুস কিছুই বলতে হবে না। তুমি মন দিয়ে সংসারটা করো আর নাতজামাই নিয়ে যত তাড়াতাড়ি পারো দেশে ফেরত এসো দিকিনি। ঠাম্মা আর কদ্দিন?
যথাসময়ে তত্ত্বতালাশ, গায়ে হলুদ, সপ্তপদী, ছাদনাতলা, কুসুমডিঙে, সিঁদুরদান, আগুনে খই ফেলা... সব পর্বের সুচারু সমাধা করে, গাঁটছড়া বেঁধে চারহাত এক হল। ভাবনা চলল শ্বশুরবাড়ি। ভবি খুব কাঁদলেন। ভাবনা হেসে বলল,
—সি ইউ টুমরো ঠাম্মা!
বউভাতে ভবি একখানা দুধসাদা পৈঠানি সিল্কের শাড়ি পরে সেই সন্ধে থেকে বসে আছেন তো আছেনই। প্রীতিভোজের সিংহাসনে ভাবনা আর আসে না। দুই বাড়ির আত্মীয় বন্ধুরা এসে খেয়েদেয়ে চলেও গেল অনেকেই। ভবি ভেবে আকুল। কোথায় যে গেল সব! বর পেয়ে সব ভুলে গেল নাকি ভাবনা? কত অতিথি ঠাম্মার পাশে উপহারের বাক্স রেখে গিয়েছে। তবু বর-কনের দেখা নাই!
তারপর রিসেপশন হলের বাইরে দুমদাম বাজি ফাটছে। আলোর ঝলকানি দেখে ঝলমল করে উঠল ভবির চিত্ত। বাজনা বাজছে। গানও হচ্ছে...‘পিরিতি কাঁঠালের আঠা লাগলে পরে ছাড়ে না...।’
কিন্তু কই নতুন বর-বউ? তাদের দেখা নেই যে। নিজের আসন ছেড়ে উঠতেও পারেন না ভবি। পায়ের জোর কম। কাউকে যে বলবেন, কেউ নেই আশপাশে। সবাই বাইরে। কিন্তু বাইরে কী এমন হচ্ছে? জানতে বড় ইচ্ছে করলেও নিরুপায় অশীতিপর ভবি। অতঃপর বর-কনের স্বস্থানে আগমন ও সিংহাসনে উপবেশন।
—কী করছিলি তোরা? ঠাম্মা শুধালেন।
—আরে ফোটোশ্যুট ঠাম্মা! ফোটোশ্যুট!
—সেটা আবার কী রে?
—ছবি, ভিডিও তুলব না? বিয়ে কি বারবার হবে? ভাবনা বলল।
ভবির বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল। তাই তো। বিয়ে তো একবারই হয়। আরও আনুষঙ্গিক অনেক কিছুই একবার হয় রে। ঠিক যেমন আমাদের হয়েছিল। মনে মনে বলে উঠলেন।
তাঁদের গাঁয়ের ঘরের সামনে মাঠের উপর বিয়ের শামিয়ানা হয়েছিল। ভাবনার দাদুর মুখোমুখি ভবি তখন পিঁড়িতে বসেছেন সবেমাত্র। কনের বাবা বসবেন সম্প্রদানে। পাশেই গুছিয়ে রাখা বরের দানসামগ্রী। কাঁসার বাসনকোসন, দামি জুতো, নাগরাই চটি, ছাতা, ঘড়া, পানের ডাবর... হঠাৎ একটা কুকুর এসে সেই নাগরাই চটির একপাটি মুখে করে নিয়ে পালাল। পঞ্চদশী ভবিও আর স্থির থাকতে পারল না। বেনারসি শাড়ি অর্ধেক বগলে, বাকি অর্ধেক কোঁচড়ে গুঁজে, পায়ের নূপুর বাজিয়ে, হাতের চুড়ি ঝনঝনিয়ে ছুটল সে কুকুরের পিছুপিছু!
আর ওদিকে ভবির মা, বাবা চেঁচাচ্ছেন। আত্মীয়স্বজন সরব। মা বলছেন ভবি দাঁড়া, বাবা বলছেন ভবি যাস না... কিন্তু ভবির প্রাণে তা সইবে কেমনে? ভবির একটা মাত্র বরের একটা জুতো যে কুকুরের মুখে। তা আদায় না করলে হয়? সেদিন ওই বিয়ের আসরেই সবাই বুঝে গিয়েছিল ভবির সঙ্গে ভবির বর ভবানীবাবুর বিয়েটা ‘মধুপিরিতি’ই হবে বটে!