পড়ে গিয়ে বা পথ দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্তির যোগ থাকায় সতর্ক হন। কর্মে উন্নতি ও সাফল্যের যোগ। ... বিশদ
একুশ শতকে ভারতের উত্তরণের প্রধান স্থপতি ছিলেন অটলজি। সেই কারণে তাঁর প্রতি সদা কৃতজ্ঞ থাকবে আমাদের দেশ। ১৯৯৮ সালে তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন, তখন আমাদের দেশ রাজনৈতিকভাবে অস্থির এক পর্বের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। প্রায় ন’বছরের মধ্যে আমরা চারটি লোকসভা নির্বাচনের সাক্ষী হয়েছিলাম। ভারতের জনগণ অধৈর্য এবং সরকারের প্রতি অবিশ্বাসী হয়ে পড়ছিলেন। এই পরিস্থিতিতে একটি স্থিতিশীল এবং কার্যকর প্রশাসন গড়ে তুলেছিলেন অটলজিই। তিনি ছিলেন নিরহঙ্কারী একজন মানুষ। সাধারণ নাগরিকদের জীবন সংগ্রামকে উপলব্ধি করতে তাঁর দেরি হয়নি। বুঝতে পেরেছিলেন সুশাসনের জন্য চাই ক্ষমতার আমূল সংস্কার।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে অটলজির নেতৃত্বের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আজও আমরা দেখতে পাই। তাঁর শাসনকালে তথ্য-প্রযুক্তি, টেলিকম এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতির পথে এগিয়েছে ভারত। আমাদের মতো প্রগতিশীল যুব শক্তির আশীর্বাদধন্য দেশের কাছে এটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তিকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে প্রথম উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছিল অটলজির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারই। একইসঙ্গে ভারতের সব প্রান্তের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের দূরদর্শিতা দেখিয়েছিলেন তিনি। আজও অধিকাংশ মানুষ তাঁর সোনালী চতুর্ভুজ প্রকল্পের কথা সগর্বে উল্লেখ করে থাকেন। একইভাবে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার মতো উদ্যোগের মাধ্যমে স্থানীয় স্তরে যোগাযোগের বিস্তারের উদ্যোগ নিয়েছিল বাজপেয়ি সরকার। মেট্রোরেলের নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি করতে তাঁর সরকার ছিল বিশেষ উদ্যোগী। দিল্লি মেট্রো প্রকল্পের জন্য ব্যাপক কাজও করেছিল, যা আজ একটি বিশ্বমানের পরিকাঠামোয় পরিণত হয়েছে। এভাবে শুধুমাত্র দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকেই ত্বরান্বিত করা হয়নি, দূরবর্তী অঞ্চলগুলির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে দেশের ঐক্য ও সংহতিকেও মজবুত করেছে বাজপেয়ি সরকার।
আবার সামাজিক ক্ষেত্রে সর্বশিক্ষা অভিযানের মতো উদ্যোগ নিয়েছিলেন অটলজি। এর মাধ্যমে তিনি এমন এক ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে দেশের সব মানুষ, বিশেষত গরিব ও প্রান্তিক শ্রেণির কাছে পৌঁছে দেওয়া যাবে আধুনিক শিক্ষার আলো। একইসঙ্গে বহু আর্থিক সংস্কার করেছিল তাঁর নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার। সেই পদক্ষেপগুলিই পরবর্তী কয়েক দশকে অচলাবস্থা কাটিয়ে ভারতের অর্থনৈতিক দর্শনের পথ প্রশস্ত করেছিল।
অটলজির নেতৃত্ব এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিল ১৯৯৮’এর গ্রীষ্মে। এনডিএ সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই, ১১ মে পরীক্ষামূলক পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল পোখরানে, যা ‘অপারেশন শক্তি’ নামে বিখ্যাত। এই পরীক্ষা ছিল ভারতের বিজ্ঞানীদের দক্ষতার আত্মপ্রকাশ, যা গোটা বিশ্বকে বিস্ময়ে হতবাক করে দেয়। বিষয়টি নিয়ে তারা ক্ষোভ পর্যন্ত প্রকাশ করেছিল। সাধারণ কোনও নেতা হলে এই পরিস্থিতিতে গুটিয়ে যেতেন, কিন্তু অটলজি ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। তারপর কী ঘটে? ভারত একটি দৃঢ় অবস্থান নেয় এবং দু’দিনের মধ্যে, ১৩ মে আরও একটি পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটায়। প্রথমটি যদি বৈজ্ঞানিক দক্ষতার সাক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে দ্বিতীয়টি ছিল তাঁর সাহসী নেতৃত্বের প্রদর্শন। গোটা বিশ্বের কাছে তিনি বার্তা দিয়েছিলেন যে, হুমকি বা চাপের কাছে ভারত নতিস্বীকার করবে, সেই দিন আর নেই। আন্তর্জাতিক অবরোধ সত্ত্বেও বাজপেয়িজির এনডিএ সরকার ছিল নিজেদের অবস্থানে অটল। সার্বভৌমত্ব রক্ষার পাশাপাশি ভারতকে বিশ্ব শান্তির এক শক্তিশালী প্রবক্তা হিসেবে তুলে ধরেছিলেন তিনি।
ভারতের গণতন্ত্রকে তাঁর মতো ভালো কেউ বুঝতেন না। সেই গণতন্ত্রকে আরও মজবুত করার প্রয়োজনীয়তাও উপলব্ধি করেছিলেন অটলজি। তাঁর সভাপতিত্বে তৈরি হয়েছিল এনডিএ, যা ভারতের জোট রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে। সবাইকে এক ছাতার তলায় এনে দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও আঞ্চলিক আশা-আকাঙ্ক্ষার শক্তি হিসেবে তুলে ধরেছিলেন এনডিএ-কে। নিজের দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রাপথে সংসদীয় দক্ষতার স্বাক্ষরও রেখে গিয়েছেন তিনি। অটলজি এমন এক দলের নেতা ছিলেন, যাদের সংসদে সদস্য সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। তা সত্ত্বেও সেই সময় প্রবল শক্তিধর কংগ্রেসের মোকাবিলায় তাঁর কথাই ছিল যথেষ্ট। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিরোধীদের সমস্ত সমালোচনা ভোঁতা করে দিতেন নিজস্ব কায়দায়। রাজনৈতিক জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি বিরোধী আসনে বসেছেন, কিন্তু কখনও কারও বিরুদ্ধে কোনও বিরূপ মন্তব্য করেননি। এমনকী কংগ্রেস তাঁকে বিশ্বাসঘাতক আখ্যা দিলেও, তিনি নিজে কখনও শালীনতার সীমারেখা অতিক্রম করেননি।
অটলজি কখনও সুবিধাবাদী পথে ক্ষমতা দখল করেননি। ১৯৯৬ সালে ঘোড়া কেনা-বেচার মতো নোংরা পথ অবলম্বন না করে ইস্তফা দেওয়াকেই শ্রেয় মনে করেছিলেন। ১৯৯৯ সালে মাত্র ১ ভোটে পরাস্ত হয়েছিল তাঁর সরকার। এই অনৈতিক রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন অনেকে। কিন্তু, তিনি ছিলেন নিয়মের পথে অবিচল। ঘটনাচক্রে পরবর্তীতে আবার জনতার বিপুল রায় নিয়ে ফিরেছিলেন ক্ষমতায়।
আমাদের সংবিধানের অঙ্গীকার রক্ষার কথা যখন আসে, তখনও অটলজির অবস্থান ছিল সুদৃঢ়। ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের শহিদ হওয়ার ঘটনা তাঁকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। কয়েক বছর পরে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনে মূল স্তম্ভ হয়ে উঠেন তিনি। জরুরি অবস্থা শেষে, ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে জনতা পার্টির সঙ্গে নিজের দলকে (জনসঙ্ঘ) মিশিয়ে দিতেও সম্মত হন। এই সিদ্ধান্ত তাঁকে এবং অন্যদের যে ব্যথিত করেছিল, সেব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কিন্তু, তাঁর কাছে সংবিধানকে সুরক্ষিত রাখাই ছিল সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গেও ছিল অটলজির নিবিড় যোগ। কতটা? সেটা এখানে উল্লেখ করা বিশেষ প্রয়োজন। বিদেশমন্ত্রী হওয়ার পর ভারতের প্রথম নেতা হিসেবে রাষ্ট্রসঙ্ঘে হিন্দিতে ভাষণ দেন তিনি। এতেই স্পষ্ট যে, ভারতের ঐতিহ্য ও সত্তা সম্পর্কে তিনি কতটা গর্বিত ছিলেন! বিশ্বমঞ্চে তার ছাপও রেখে গিয়েছেন।
অটলজির ব্যক্তিত্ব ছিল চুম্বকের মতো আকর্ষণীয়। সাহিত্যের প্রতি ছিল তাঁর প্রভূত ভালোবাসা। একজন সুলেখক ও কবি হিসেবে প্রেরণা ও ভাবনা-চিন্তার খোরাক জোগাতেন তিনি। তাঁর কবিতার মধ্যে সন্নিহিত ছিল নিজের অন্তরের লড়াইয়ের প্রতিফলন এবং দেশের জন্য আশার বার্তা।
অটলজির মতো ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আলাপচারিতা এবং তাঁর থেকে শেখার সুযোগ পেয়েছি—আমার মতো ভারতীয় জনতা পার্টির অনেক কার্যকর্তার কাছেই এটা পরম সৌভাগ্যের। বিজেপির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাঁর ভূমিকা অপরিসীম। সেই সময় প্রবল প্রভাবশালী কংগ্রেসের বিকল্প শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া বুঝিয়ে দেয় যে অটলজির মহত্ব! এল কে আদবানিজি, ডঃ মুরলী মনোহর যোশিজির মতো নেতাদের সঙ্গে তিনিও গোড়া থেকে দলকে লালনপালন করেছিলেন। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ, উত্থান-পতনের সময় পথ দেখিয়েছিলেন। যখনই আদর্শ এবং ক্ষমতার মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে, তিনি বরাবর প্রথমটিকেই বেছে নিয়েছেন। কংগ্রেসের বিকল্প যে সম্ভব, দেশবাসীকে সেকথা বোঝাতেও পেরেছিলেন।
আসুন, এই ১০০তম জয়ন্তীতে আমরা অটলজির আদর্শে অনুপ্রাণিত হই। ভারতের প্রতি তাঁর ভাবনা-চিন্তার বাস্তবায়নে নিজেদের উৎসর্গ করি। সেই
ভারত গড়ার চেষ্টা করি, যেখানে সুশাসন, ঐক্য ও অগ্রগতির নীতি প্রাধান্য পাবে। আমাদের দেশের প্রভূত সম্ভাবনা নিয়ে অটলজির অবিচল বিশ্বাস আমাদের আরও উচ্চতায় পৌঁছতে এবং কঠোর পরিশ্রম করতে প্রেরণা জোগাবে।