পড়ে গিয়ে বা পথ দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্তির যোগ থাকায় সতর্ক হন। কর্মে উন্নতি ও সাফল্যের যোগ। ... বিশদ
গ্রামীণ এলাকার গরিব মানুষের মাথার উপর পাকা ছাদ নির্মাণই হল আবাস প্রকল্প। কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সহায়তায় গোটা দেশে গরিব গৃহহীন মানুষ পাকা বাড়ি পেয়ে থাকে। তিন বছর ধরে বাংলায় সেই প্রকল্পের টাকা দিচ্ছে না কেন্দ্রীয় সরকার। প্রথমে প্রকল্পের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে, এই অজুহাতে টাকা আটকে দিয়েছিল। এই প্রকল্পের ৪০ শতাংশ টাকা রাজ্য সরকার দিলেও গরিব মানুষের স্বার্থে কেন্দ্রের দাবি মেনে নিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাতেও টাকা দেয়নি। কেন্দ্রের নির্দেশ মেনে তৈরি হয়েছিল ১১ লক্ষের তালিকা। তারপরেও টাকা না মেলায় আন্দোলন মঞ্চেই কেন্দ্রীয় সরকারকে ‘ডেডলাইন’ বেঁধে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। জানিয়েছিলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে গরিব মানুষের ঘর তৈরির টাকা কেন্দ্র না দিলে দেবে রাজ্যই।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেদিন এই ঘোষণা করেছিলেন সেদিন অনেকেই ভেবেছিলেন, সবটাই ফাঁকা আওয়াজ। এই বিপুল পরিমাণ টাকা জোগাড় করা অসম্ভব। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিলেন, ইচ্ছা থাকলে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়। আবাস তালিকায় থাকা ১১ লক্ষকে তো টাকা দিচ্ছেনই। তার সঙ্গে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত আরও ১ লক্ষ পরিবার পেতে চলেছে মাথার উপর পাকা ছাদ। কারণ তাঁরাও যে আশ্রয়হীন! মুখ্যমন্ত্রীর এই অভাবনীয় সিদ্ধান্তে গ্রামের বুকে জন্ম নিয়েছে এক নতুন স্লোগান, ‘যার নেই কোনও ক্ষমতা/ তার জন্য আছেন স্বয়ং মমতা’।
কথা দিলে কথা রাখেন মমতা। একুশের নির্বাচনের পর সেটা তিনি বিরোধীদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। নির্বাচনের আগে দেওয়া প্রতিটি প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। আরও একবার প্রমাণ করলেন। শুধু ১২ লক্ষই নয়, তাঁর তালিকায় রয়েছে আরও ১৬ লক্ষ পরিবারের নাম। দু’দফায় আট লক্ষ করে দু’বারে ‘বাংলার বাড়ি’ প্রকল্পের টাকা দেওয়া হবে। টাকা দেওয়া হবে ছাব্বিশ সাল পর্যন্ত। ওই বছরই রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। তাই ‘ছাব্বিশের ভূত’ বিরোধীদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। বিরোধীরাও বুঝতে পারছে, গরিবের বাড়ির ছাদ যত পাকা হবে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পায়ের তলার মাটি ততই মজবুত হবে।
বিরোধীদের এই আশঙ্কা একেবারে অমূলক বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এ রাজ্যে সামগ্রিকভাবে শাসক দলের নেতাদের উপর সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট, এমন দাবি সম্ভবত অতি বড় তৃণমূল সমর্থকও করার সাহস পাবেন না। তা সত্ত্বেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা যে অটুট, প্রতিটি নির্বাচনে তার প্রমাণ মিলেছে। ২০১৯ সাল ছাড়া তৃণমূলের আমলে অ্যান্টি ইনকামবেন্সির কোনও প্রভাব ভোটে পড়েনি। তার কারণ অবশ্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চালু করা একগুচ্ছ সামাজিক প্রকল্প। রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ এখনও বিশ্বাস করে, ক্ষমতায় থাকার সুবাদে তৃণমূল দলটায় অনেক আগাছা জন্মালেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গরিব মানুষের জন্যই কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলার বাড়ি প্রকল্পের টাকা দেওয়ায় সেই বিশ্বাসের ভিত আরও দৃঢ় হল।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা, প্রতিহিংসার রাজনীতির কারণেই বাংলার গরিব মানুষ বিজেপির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, আঁকড়ে ধরছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। একুশের নির্বাচনের পরাজয়ের বদলা নিতে বন্ধ করে দেয় ১০০ দিনের কাজ। তারপরই দুর্নীতি হয়েছে, এই অভিযোগ তুলে আটকে দেয় আবাসের টাকা। তিন বছরে ৬৯টি কেন্দ্রীয় টিম পাঠিয়ে তদন্ত করার পরেও টাকা দেয়নি। তাতে লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষ অসহায় অবস্থার মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। বিজেপি বাংলার অসহায় মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটানোর জন্য ২৪ হাজার কোটি টাকা দিতে না পারলেও ২০২৩-’২৪ সালে বন্ধু শিল্পপতিদের প্রায় পৌনে দু’লক্ষ কোটি টাকার ঋণ অনায়াসেই মকুব করে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাকে যত বঞ্চিত করবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছাব্বিশের লড়াইটা ততই সহজ হয়ে যাবে।
সিপিএমের মুখপত্র ‘গণশক্তি’ পত্রিকায় লেখা হয়েছে, আবাস তালিকার ১২ লক্ষের নাম ছাঁটল রাজ্য। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘২০২৬ সালে বিধানসভা ভোটের আগে অনুদান খাতে টাকা খরচকেই টার্গেট করেছে নবান্ন।’ এই সিপিএমের তাত্ত্বিক নেতারাই বাম আমলে দিতেন সাংবাদিকতার পাঠ। বলতেন, ‘গঠনমূলক সমালোচনা করুন। গ্লাসে অর্ধেকটা জল থাকলে আপনারা খালি অংশটাই তুলে ধরেন। জল যে আছে, সেটা বলেন না। মানুষের, সমাজের মঙ্গল চাইলে ভালো দিকটা তুলে ধরতে হয়।’ শূন্যে পৌঁছে সিপিএম সেই নীতিবাক্য বেমালুম
ভুলে গিয়েছে।
একথা ঠিক, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রকল্প ঘোষণা ও কর্মসূচির পিছনে থাকে সরকারে টিকে থাকার অথবা ক্ষমতায় ফেরার লক্ষ্য। বাংলার বাড়ি প্রকল্পের সমস্ত আর্থিক ব্যয়ভার নেওয়ার পিছনে শাসক দলের রাজনৈতিক ফায়দা অবশ্যই আছে। কিন্তু, কাজ করে ভোট নিলে অসুবিধে কোথায়?
মানুষ তো সেই দলকেই ভোট দেয় যে জিতলে
তাদের উপকার হয়। এই অঙ্ক কষার জন্য স্কুলে যাওয়ার দরকার হয় না। জীবনের পাঠাশালায় অভিজ্ঞতার আলোয় সেই শিক্ষা লাভ হয়। তারজন্যই একুশে সর্বশক্তি নিয়োগ করেও বিজেপি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারাতে পারেনি। চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনেও বঙ্গ বিজেপি ঠেকাতে পারেনি তাদের রক্তক্ষরণ।
কেতুগ্রামের বিল্বেশ্বর পঞ্চায়েতের বারান্দা গ্রামের শ্যামল মাঝির অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে ‘বাংলার বাড়ি’ প্রকল্পের টাকা। মাটির দেওয়ালের উপর চাপানো কিছু খড়ই তাঁদের বাড়ি। দু’টি ঘরে এতদিন ছিল আটটি প্রাণীর বাস। এখন কমে সাত। খড়ের চাল বেয়ে বৃষ্টির জল যত না বাইরে যায়, তারচেয়েও বেশি পড়ে ভিতরে। এবারের অতিবৃষ্টিতে অবস্থা একটু বেশিই করুণ হয়েছিল। শ্যামলবাবুর বৃদ্ধা মা পুষ্পাদেবী নেতাদের দেখলেই বলতেন, ‘হ্যাঁ গো, আমার ব্যাটাটার একটা ইটের ঘর হবে না।’ শুধু এইটুকুই। কাউকে কোনওদিন দোষারোপ করেননি। নেতারা শুধু বলতেন, টাকা ঢুকবে। কিন্তু দিন যায়, মাস যায়, বছরও ঘোরে। বাড়ির টাকা আসে না। ‘ব্যাটার ইটের ঘর হবে না?’ এই প্রশ্ন এড়াতে নেতারা নিতান্ত বাধ্য না হলে শ্যামলবাবুর বাড়ির সামনে যেতেন না।
সেই পুষ্পাদেবীর ছেলের অ্যাকাউন্টে বুধবার ‘বাংলার বাড়ি’ প্রকল্পের ৬০ হাজার টাকা ঢুকেছে। মাটির বাড়ি ভেঙে তৈরি হবে ইটের দেওয়াল। জীর্ণ খড়ের চালার জায়গায় তৈরি হবে ঢালাই ছাদ। আকাশে মেঘ করলে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ আর মনে ভিড় করবে না। তবুও বাড়ির লোকজনের মনে আনন্দ নেই। কারণ সাতদিন আগেই পুষ্পাদেবী সকলকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন। শ্যামলবাবুর স্ত্রী বুধু মাঝি বলেন, শাশুড়ির খুব ইচ্ছা ছিল, বেটার একটা ইটের ঘর হোক। এবার সেই ঘর হবে। শাশুড়ির শ্রাদ্ধের কাজ মিটলেই ঘর তৈরির কাজে হাত দেব। মমতাদির কৃপায় স্বপ্নপূরণ হবে আমার শাশুড়িমায়ের।
রাজার নীতি রাজনীতি, নাকি নীতির রাজা, সেটা আজও বুঝে ওঠা সম্ভব হল না। রাজনীতির জাঁতাকলে পড়ে গরিব, খেটে খাওয়া মানুষগুলোর ছোট ছোট স্বপ্নগুলো প্রতিনিয়ত পেষাই হয়। কিন্তু বাংলার গরিব মানুষ বুঝে গিয়েছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যতদিন মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন ততদিন পুষ্পাদেবীদের স্বপ্নগুলোকে পিষে মারার ক্ষমতা কারও নেই। বাস্তবের মাটিতে একদিন না একদিন মাথা তুলবেই।