পড়ে গিয়ে বা পথ দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্তির যোগ থাকায় সতর্ক হন। কর্মে উন্নতি ও সাফল্যের যোগ। ... বিশদ
জেনারেশন আলফা আগামী দিনে বিশ্বের বৃহত্তম জনগোষ্ঠী হবে। ২০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। এই জেনারেশনের সঙ্গে তাবৎ পূর্বজদের প্রধান পার্থক্য হল, একমাত্র এই আলফা জেনারেশন সম্পূর্ণ ডিজিটাল যুগে জন্মগ্রহণ করেছে এবং সেই যুগেই বসবাস করবে আজীবন। অর্থাৎ মোবাইল, ইন্টারনেট, আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স—মানবসভ্যতার প্রধান তিন ডিজিটাল চালিকাশক্তির মধ্যেই আবর্তিত এদের জীবন।
এই যে দুই জেনারেশনের সিংহভাগ নাগরিকের মধ্যে শিক্ষিত অংশের সন্তান গ্রহণ না করার এমন নীতি ভারত এবং বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রের সরকারগুলির কাছে এখন অন্যতম প্রধান সঙ্কট। এই জেনারেশনের একাংশ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন? একাধিক কারণ। প্রধানত তারা সন্তান পালনের দায়িত্ব পূর্ণাঙ্গ পালন করতে পারবে না বলে নিজেরাই মনে করছে। অর্থাৎ সেই ক্ষমতা ও যোগ্যতা তাদের নেই। সেই সময় ও প্যাশনও নেই। নিজেদের আয় ও পেশাকে বিপদ অথবা অনিশ্চয়তায় ফেলতে চায় না তারা। দায়িত্ব পালন করতে না পারলে কেন একটি জীবনকে নষ্ট করবে? তাই এই সিদ্ধান্ত। কিন্তু অন্যতম একটি কারণ হল, চাকরি বা আয়ের অনিশ্চয়তা। আজকাল বেসরকারি সেক্টরে কতদিন কার চাকরি থাকবে এবং থাকবে না, সেটা কেউ জানে না। তাই ওই অনিশ্চয়তায় তারা সন্তানকে আনতে চায় না।
বিশ্বের কাছে এই প্রবণতা অবশ্যই উদ্বেগজনক বার্তা। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিপজ্জনকভাবে জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে। জাপানের জনসংখ্যা বিগত ১৫ বছর ধরে নেগেটিভ গ্রোথ। অর্থাৎ কমে যাচ্ছে। ২০১৭ সালে তাদের জনসংখ্যা ছিল ১২ কোটি ৮০ লক্ষ। ২০২৩ সালে জাপানের জনসংখ্যা ১২ কোটি ৪৫ লক্ষ। মাত্র একটি বছরে, ২০২২ সালে জাপানের জনসংখ্যা ৫ লক্ষ কমে গিয়েছে।
২০১৭ সালে ইতালির জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৬ কোটি। এই শতাব্দীর শেষে ইতালির জনসংখ্যা ২ কোটি ৮০ লক্ষ হয়ে যাবে। চীনের জনসংখ্যা আর পাঁচ বছর পর হবে ১৪০ কোটি। কিন্তু ২১০০ সালে চীনের জনসংখ্যা হবে ৭৩ কোটি। ল্যানসেট স্টাডি থেকে জনসংখ্যার বিশ্লেষণ ও পূর্বাভাস পাওয়া যায়। আর পাওয়া যায় রাষ্ট্রসঙ্ঘের জনসংখ্যা বিভাগ থেকে।
ইরান থেকে ব্রাজিল। জার্মানি থেকে ব্রিটেন। এবং আমেরিকা। বিশ্বের সর্বত্র কমছে জনসংখ্যা। আমরা ভারতের বাসিন্দা। আমাদের উদ্বেগ তো হওয়ার কথা প্রবল জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়েই। একেবারেই ঠিক। কিন্তু এখানেই সম্পূর্ণ বিপরীত পরিস্থিতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে ভারতও। কারণ, ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও নাটকীয়ভাবে কমতে শুরু করেছে।
স্বাধীনতার পর প্রথম ৩০ বছরে ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিস্ফোরণ ঘটেছিল। দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল জনসংখ্যা। কিন্তু ১৯৮০ সাল থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমতে থাকে। সেটাও মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু ২০২০ সালের বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সর্বকালীন রেকর্ড হারে কম। অর্থাৎ জনসংখ্যা বাড়ছে বটে, কিন্তু বেড়ে যাওয়ার যে হার, সেটা সর্বনিম্ন। এই নিম্নতম হওয়ার রেকর্ড ক্রমেই আগামী দিনে আরও ভেঙে যাবে। আর তার পরিণতি কী? রাষ্ট্রসঙ্ঘের পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, ২০৬০ সালে ভারতের জনসংখ্যা হবে ১৭৩ কোটি। এবং সেই দশক থেকে ভারতের জনসংখ্যা কমতে থাকবে। অর্থাৎ নেগেটিভ গ্রোথে ঢুকে পড়বে ভারতও।
কেন কমে যায় জনসংখ্যা? প্রধান কারণ টিএফআর কমে যাওয়া। অর্থাৎ টোটাল ফার্টিলিটি রেট ক্রমশই কম হওয়া। কাকে বলে টোটাল ফার্টিলিটি রেট? একজন মহিলার সারাজীবনে যতগুলি সন্তান হয় এবং জীবিত থাকে, সেটাই টিএফআর। এভাবেই তৈরি হয় দেশ অথবা রাজ্যের গড় টিএফআর। বিশ্বের সব দেশের মতোই ভারতের টিএফআর দ্রুত কমছে। সিকিম অথবা আন্দামানের মতো কিছু রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বাদ দিলে বৃহৎ রাজ্যগুলির মধ্যে সবথেকে কম টিএফআর কোন রাজ্যের? অর্থাৎ কোন রাজ্যের জনসংখ্যা বৃদ্ধিহার সবথেকে কম? পশ্চিমবঙ্গ! মাত্র ১.৬০।
জনসংখ্যার ভারসাম্য বজায় থাকে যদি টিএফআর ২.১ পয়েন্টের উপরে থাকে। একে বলা হয় রিপ্লেসমেন্ট ফার্টিলিটি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, দক্ষিণ ভারতের তাবৎ রাজ্য এবং পশ্চিম ভারতেও কিছু রাজ্যের টিএফআর ২ পয়েন্টের নীচে। গড়ে ভারতের জনসংখ্যা রিপ্লেসমেন্ট ফার্টিলিটির নীচে চলে গিয়েছে। অর্থাৎ প্রতি বছর যত সন্তান ভারতে জন্মগ্রহণ করছে সেই সংখ্যা ক্রমেই কমছে। ২১০০ সালেও ভারত থেকে যাবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জনসংখ্যার দেশ। কিন্তু ভারতের জনসংখ্যা সেই সময় হবে ১১০ কোটি। এরকমই পূর্বাভাস।
ইংরাজিতে একটি টার্ম রয়েছে। শ্রিংকিং সিটিজ (shrinking cities)। অর্থাৎ যে সব শহরের জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে। বিশ্বের বহু জনপদ আছে যেখানে সামান্য কিছু বাসিন্দা আছে। মাইগ্রেশন অন্যতম কারণ। অর্থাৎ অন্যত্র চলে যাওয়া এবং জন্মহার কমে যাওয়া। এই তালিকার প্রথম নামটি কী? নাগাসাকি। আমেরিকা বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী। তার বহু আগেই এই শহরে আণবিক বোমা ফেলে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে এই শহর থাকার দরকার নেই। নাগাসাকি সেই চরম দুঃসহ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। অথচ তাদের ভাগ্যেই রয়েছে শূন্য শহর হয়ে যাওয়া ক্রমে। ভারতে উল্লেখযোগ্য শ্রিংকিং সিটির তালিকায় অনেক পিছনে হলেও রয়েছে কলকাতা, মুম্বই, কোচি, বেঙ্গালুরু, দিল্লি, চেন্নাই। সবথেকে বেশি জনসংখ্যা কমছে মাদুরাইতে।
আর ঠিক এই সময়কালে একটি তথ্য ও পরিসংখ্যান এসে সব হিসেব গুলিয়ে দিয়েছে। শিশুমৃত্যুর হিসেব। শিশুজন্মের হার যেখানে ক্রমশই কমছে, সেখানে ভারত নামক রাষ্ট্র এখনও অপুষ্টিতে শিশুমৃত্যুর রেকর্ড করছে বিশ্বে। ২০২১ সালে শুধু এক বছরে ভারতে ৭০ হাজার শিশুর প্রত্যক্ষ মৃত্যু হয়েছে অপুষ্টির কারণে। প্রত্যক্ষ মৃত্যু মানে কী? মানে হল, অপুষ্টিতেই মৃত্যু। ওজন কম, পর্যাপ্ত খাবার না পাওয়া, সব রকম ভিটামিন ও জিঙ্কের অভাব এবং মায়ের দুধ না পাওয়া ইত্যাদি। গোটা বিশ্বে ওই বছরে ২০ লক্ষ শিশুর মৃত্যু হয়েছিল অপুষ্টিতে। সেখানে ভারতে ৭০ হাজারের বেশি অপুষ্টিমৃত্যু চরম বিপদসংকেত!
সবথেকে বেশি শিশুমৃত্যু কী কারণে হয়? আন্ডারওয়েট। অর্থাৎ কম ওজন। কেন? মায়ের শরীরে পুষ্টি না থাকা। মা পুষ্টিকর খাদ্য পায় না। তাই সন্তানের মৃত্যু হয়। এবং সংক্রমণ। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মের সময়ই কম থাকা। সেটাও মায়ের অপুষ্টির কারণে।
আমরা যে যেখানেই থাকি, আমাদের আশপাশে শেষ কবে দেখেছি সম্পূর্ণ নতুন একটি সরকারি হাসপাতাল তৈরি হয়েছে? শিক্ষা ও স্বাস্থ্য তো কেন্দ্র ও রাজ্য যৌথ তালিকাভুক্ত। তাহলে যে কোনও রাজ্যে কেন্দ্রীয় হাসপাতাল কিংবা কেন্দ্রীয় স্কুল এত কম কেন? বাংলায় ক’টা কেন্দ্রীয় হাসপাতাল আছে? শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ শ্বাসকষ্ট। করোনাকালে বলা হয়েছিল রাজ্যে রাজ্যে অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসানো হচ্ছে। কতগুলো অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসানো হয়েছে?
ভারতে ১ হাজার শিশুর জন্ম হলে ২৬ জনের গড়ে মৃত্যু হয়। সবথেকে বেশি শিশুমৃত্যুর হার গ্রামীণ ভারতে। জন্মহার কমছে। সরকার জনসংখ্যা নীতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি যাতে কমে যায় সেই কঠোর নীতি কি নেওয়া দরকার? নাকি জনসংখ্যা নীতির প্রয়োজন নেই? এই বিতর্ক ও জল্পনা এখন সরকারের অন্দরে অন্যতম প্রধান একটি বিতর্ক। সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না।
কিন্তু যে রাষ্ট্র আর কিছু বছরের মধ্যে নাকি তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হবে সেখানে এত শিশুমৃত্যু কেন? এত অপুষ্টি কেন?