কর্মসূত্রে বিদেশ যাত্রার প্রচেষ্টায় সফল হবেন। আয় খারাপ হবে না। বিদ্যা ও দাম্পত্য ক্ষেত্র শুভ। ... বিশদ
একটা বাইক বদলে দিচ্ছে যৌবনের দর্শন। সেই বাইক তাঁর মধ্যে শুধু হিরোইজমের ভ্রান্ত বীজই বুনে দিচ্ছে না, তাঁকে পারিপার্শ্বিক জগৎ সম্পর্কে সবকিছু ভুলিয়ে দিচ্ছে। তখন সেই মোহের আবরণে তাঁর মনে হয়, আমি ছাড়া পারিপার্শ্বিক সবকিছুই যেন মিথ্যে, মায়া। তাই বেপরোয়া গতির কারণে যেমন বারবার দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন তাঁরা, তেমনই অন্যেরও মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠছেন। তাঁদের মধ্যে গড়ে উঠছে একটা অবাধ্য মন। যে মন কোনও নিয়মের পরোয়া করে না। না ট্রাফিক আইনের, না গতি নিয়ন্ত্রণের, না হেলমেট পরার। একটা গা জোয়ারি ভাব দেখা যায় অনেক বাইক চালকের মধ্যেই। অনেকে সাইলেন্সার খুলে বিকট শব্দে বাইক চালিয়ে মানুষের বিরক্তি ও দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যানজটেও দেখা যায়, অল্প জায়গার মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে আগে বেরিয়ে যাওয়ার প্রবণতা। এর সঙ্গে সম্প্রতি যোগ হয়েছেন খাদ্য সরবরাহকারী এজেন্টরা। তাঁদের দায়বদ্ধতা সময়ের কাছে। সময়ে খাবার মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে না পারলে তাঁদের কমিশনে কোপ পড়বে। তাই জীবনধারণের জন্য হাতের মুঠোয় জীবনকে নিয়ে তাঁরাও ছুটছেন। সব মিলিয়ে আজ যেন আমাদের জীবন যন্ত্রণার মধ্যে নতুনতর উপসর্গ হয়ে দেখা দিয়েছে বাইক। বাইকের দৌরাত্ম্য ঘিরে ভুক্তভোগী কমবেশি আমরা সবাই। এই যন্ত্রণা শুধু শহরের নয়, এই যন্ত্রণার শিকার জেলার মফস্সল শহর কিংবা গ্রামও।
কলকাতা শহরে রাস্তার যা পরিসর, সেই তুলনায় গাড়ি বেড়েছে প্রচুর। সেই সাহেবদের আমল থেকে এই শহরে যতটা বাড়ি, ঘর বেড়েছে, সেই তুলনায় রাস্তা তেমন বাড়েনি। তাই চলাচলের ক্ষেত্রে যতটা নিয়ন্ত্রণ দরকার, ততটা নিয়ন্ত্রণ বাইক চালকদের মধ্যে দেখা যায় না। এদিকে রাতের শহরে বেড়ে যায় জয় রাইডের আকর্ষণ। রাত বাড়লে কলকাতা শহরের রাস্তা হয়ে ওঠে যেন গ্রাঁ পি প্রতিযোগিতার ট্র্যাক। চালকরা নিজেদের মনে করেন পৃথিবী বিখ্যাত সব বাইকার— লুকা মারিনি, দানি পেদ্রোসা বা মার্ক মারকোয়েজ। নিউটাউন, বাইপাস, রেড রোড, মা উড়ালপুল, সম্প্রীতি উড়ালপুল, ভিআইপি রোড, টালিগঞ্জ, বেহালা, আলিপুর হয়ে ওঠে জয় রাইডের অবাধ ক্ষেত্র। বাইকের চাকার তীব্র গতিতে যেন জেগে ওঠে যৌবনের জলতরঙ্গ। যৌবনের অবিরাম গতির নেশা তাঁকে যেন তাড়িয়ে মারে। ‘শুধু ধাও শুধু ধাও উদ্দাম উধাও’। কিন্তু সেখানে মুহূর্ত স্খলনের মধ্যে লেখা হয়ে যায় মৃত্যুর পরোয়ানা।
জেলার বিভিন্ন হাইওয়েতে রাত হলেই বাইক কম্পিটিশন শুরু হয়। মাঝেমাঝেই তার সমাপ্তি রেখায় অপেক্ষা করে মৃত্যুর অভিঘাত। কলকাতা পুলিসের ট্রাফিক বিভাগ এবং জেলা পুলিসের তরফ থেকে এই বেপরোয়া ভাব কাটানোর আবেদন করা হয়। কিন্তু তা যে অনেকের কান পর্যন্ত পৌঁছয় না, সেটা বোঝা যায় নিত্যদিনের বাইক দুর্ঘটনার বহর দেখে। কিন্তু এই অত্যাচার বন্ধ করা পুলিসের পক্ষে সহজ নয়, সচেতনতা না ফিরলে, নায়ক হয়ে ওঠার মানসিকতা না কাটলে এই দৌরাত্ম্য বন্ধ হবে না। মনে রাখা দরকার, জীবন একটাই, সেটাকে নিয়ে এভাবে বিপজ্জনক খেলা উচিত নয়।
শুধু তো দু’চাকা নয়, চার চাকার গাড়ি নিয়েও বিত্তশীল পরিবারের উড়নচণ্ডী যুবকরা গতির নেশায় মেতে ওঠেন। এদের মধ্যে অনেকে আবার নাবালকও থাকে। এই উন্মার্গগামিতার কারণে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে। দেশের সড়ক পরিবহণ মন্ত্রকের রিপোর্ট বলছে, প্রতি বছর আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে কম করে দশ শতাংশ হারে। ২০২২ সালের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, সারা দেশে পথ দুর্ঘটনার সংখ্যা প্রায় ৪ লক্ষ ৬২ হাজার। আর এই দুর্ঘটনায় প্রাণ গিয়েছে ১ লক্ষ ৬৮ হাজার ৪৯১ জনের। জখম প্রায় সাড়ে চার লক্ষ মানুষ। এইসব দুর্ঘটনায় দেখা গিয়েছে চালকদের বয়স মূলত ১৫ থেকে ৪৯ বছর। বাইক দুর্ঘটনার সংখ্যা ৫২ হাজারেরও বেশি, চার চাকার ছোট গাড়ির দুর্ঘটনার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ২৫ হাজার। প্রতি তিন মিনিটে একজনের মৃত্যু ঘটছে পথ দুর্ঘটনায়। এই পরিসংখ্যানটুকু আমাদের খানিকটা হলেও বুঝিয়ে দেয় পথ দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্রটা। করোনায় দেশে মৃত্যুর যে হার ছিল, তার থেকে এই মৃত্যুর হার আরও ভয়ঙ্কর। অথচ আমরা সেভাবে সচেতন হই না।
একদিকে যেমন চালকদের ভুলত্রুটিতে পথ দুর্ঘটনা হচ্ছে, তেমনই পথচলতি মানুষের ভুলেও মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। পশ্চিমের দেশগুলি নানাভাবে উদ্যোগ নিয়ে পথ দুর্ঘটনার সংখ্যা কিছুটা কমাতে সক্ষম হলেও আমরা তা পারিনি। এর কারণ আমাদের অজ্ঞতা, দুর্বিনীত মনোভাব, নিয়ম না মানার প্রবণতা ইত্যাদি। এছাড়াও বলা যায় গত দশ বছরে রাস্তায় গাড়ির ঘনত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছে। অর্থাৎ গত দশ বছরে রাস্তায় যত গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে, যত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, সেই তুলনায় সড়কের পরিমাণ বাড়েনি। আমাদের দেশে ২০০১ সালে প্রতি হাজার জনসংখ্যায় নথিভুক্ত গাড়ির সংখ্যা ছিল ৫৩.৪৬। ২০১০ সালে ছিল প্রতি হাজারে তা হয় ৯৯.০৩ এবং ২০২০ সালে সেই সংখ্যা হল প্রতি হাজারে ২৪৬.০৫। এর মধ্যে স্কুটার ও বাইকের বিক্রি সবথেকে বেশি। চলতি বছরে আর্থিক বছরে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর এই ছয় মাসে বাইক ও স্কুটার বিক্রি বেড়েছে ১৬ শতাংশেরও বেশি।
রাস্তা যেমন বাড়েনি, তেমনই হকার দখলের কারণে রাস্তাও হয়েছে সংকীর্ণ। সেই কারণেও দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে। পশ্চিমবঙ্গে প্রতি বছর নিয়ম করে পথ নিরাপত্তা সপ্তাহ পালন করা হয়, সেফ ড্রাইভ, সেভ লাইফের প্রচার করা হয়, কিন্তু কিছুতেই চালক বা পথচারীদের চৈতন্যোদয় হয় না। তারই মূল্য দিতে হয় প্রাণের বিনিময়ে। নিমেষের ভুলে প্রতিনিয়ত মানুষের রক্তে ভিজে যাচ্ছে পথ। কত সম্ভাবনার অপমৃত্যু ঘটছে। আসলে এটা একটা সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে উচ্চবিত্তই হোক বা একেবারে নিম্ন মধ্যবিত্তই হোক। বহু নিম্নবিত্ত পরিবারের যুবক বারবার তাঁর বাবাকে চাপ দিয়ে বাইক কিনতে বাধ্য করেন অথবা তিনি নিজে কোনওভাবে টাকা সংগ্রহ করে বাইক কেনেন। তারপর রাজপথে জয় রাইডের মাধ্যমে আনন্দের সন্ধান করেন। সেই জয় রাইড যে কত ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে তা প্রতিদিন সংবাদপত্র খুললেই বোঝা যায়। পথ দুর্ঘটনার অজস্র সংবাদে ভরে যায় সংবাদপত্রের পাতা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ফরাসি দার্শনিক অঁরি বার্গসঁর গতিবাদতত্ত্বে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন তাঁর ‘বলাকা’ কাব্যগ্রন্থটি। সেখানে তিনি বলাকার উড়ন্ত ডানায়, ঝড়ের মাতনে কিংবা নদীর বেগধারায় গতির উল্লাস দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। সেই গতির উদ্দামতা আমাদের পূর্ণতার দিকে, আনন্দের দিকে নিয়ে যায়। জীবনের নিবিড় বহমানতার কথা, চরৈবেতির কথা বলে। কিন্তু বর্তমানে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে যে গতির নেশা, তা এক অস্থির উল্লাসের মতোই। এর পিছনে রয়েছে এক ধরনের সুপ্ত মানসিক অবস্থা। যেটাকে ‘বিকার’ বলে মনে করছেন মনোবিদরা। তাঁদের সমীক্ষা বলছে, প্রায় ৪৭ শতাংশ চালক গতিবিধি আইন লঙ্ঘন করেন। এর মধ্যে অনেকের যেমন ব্যস্ততা বা তাড়া থাকে, তেমনই অনেকে এই গতিকে পছন্দ করেন। অর্থাৎ বিনা কারণেই তাঁরা বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে আনন্দ পান। অনেকেই বন্ধুদের কাছে নিজেদের দক্ষতা প্রকাশ করে বাহবা কুড়োতে চান। তাই ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা একটা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। নিজের দক্ষতাকে প্রকাশ করার তীব্র আকুতি তাঁদের ক্রমেই অ্যাক্সিলেটরে চাপ দিতে বাধ্য করে। তখন তাঁরা এক ইল্যুউশনের জগতে বাস করতে থাকেন। মুহূর্তের জন্য ভুলে যান বাস্তব পরিণতির কথা। বহুক্ষেত্রে আবেগ চালকের দক্ষতাকেও অতিক্রম করে যায়। তখন তিনি যন্ত্রকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা তাঁকে গ্রাস করে। সেই দুর্ঘটনার চিত্র দেখে আমরা শিউরে উঠি। দোমড়ানো মোচড়ানো গাড়ি, চাপ চাপ রক্ত, পরিবার ও আত্মীয় স্বজনের কান্না— এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা থেকেও আমরা শিক্ষা নিই না। হাতে স্টিয়ারিং পড়লেই যেন নিশির ডাক শোনেন অনেকে— জোরে, আরও জোরে! কিন্তু আত্মনিয়ন্ত্রণের শক্তি দুর্বল হলে স্টিয়ারিংয়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়তির হাতে চলে যেতে বাধ্য। ড্রাইভিংকে উপভোগ করুন, তার পরিণতি যেন বিয়োগান্তক না হয়।