উত্তম বিদ্যালাভের যোগ আছে। কাজকর্মে উন্নতি ও কাজে আনন্দলাভ। অর্থাগমের উত্তম যোগ। ... বিশদ
অমিত শাহ সরকারি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলায় এলেও আসল উদ্দেশ্য ছিল, বিজেপির সদস্য সংগ্রহ অভিযানের সূচনা করা। তিনি সাধারণত নির্বাচনের মুখেই বাংলায় আসেন। আর এলেই টার্গেট বেঁধে দিয়ে চলে যান। একুশের বিধানসভা ভোটের আগে দিয়েছিলেন ২০০ আসনের টার্গেট। বঙ্গ বিজেপি অর্ধেকের ধারেকাছে যেতে পারেনি। চব্বিশের লোকসভার আগে দিয়েছিলেন ৩৫ আসনের টার্গেট। জুটেছে তিন ভাগের একভাগ। এবার এসেও সেই টার্গেটই বেঁধে দিলেন। দলের সদস্য সংগ্রহের টার্গেট।
বঙ্গ বিজেপিকে এক কোটি সদস্য সংগ্রহের টার্গেট দিয়েছেন। এক কোটি সদস্য সংগ্রহ করতে পারলেই নাকি ছাব্বিশে রাজ্যের ক্ষমতায় আসবে বিজেপি। সদস্য হওয়ার জন্য একটি নম্বর চালু করা হয়েছে। সেই নম্বরে মিস কল দিলেই হওয়া যাবে সদস্য। অনেকে বলছেন, যদি একটি নম্বর থেকে একজনই সদস্য হতে পারেন তাহলে এরাজ্যে মোবাইলের সিম বিক্রি হু-হু করে বাড়বে। কিছু নেতা পদ বাঁচানোর জন্য পাইকারি হারে সিম কিনে মিস কল দেবেন। তাতেও লোকসভা ভোটে আসন প্রাপ্তির মতোই হাল হবে সদস্য সংগ্রহের। লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছে পৌঁছতে পারবে না।
প্রতিবার অমিত শাহ ঘুরে যাওয়ার পর তাঁর দেওয়া টার্গেটই চর্চার বিষয় হয়। কিন্তু এবার অমিতজির বেঁধে দেওয়া টার্গেট নয়, আলোচ্য বিষয় আর জি করের ঘটনার প্রতি তাঁর উদাসীনতা। অভয়ার জাস্টিসের দিকে তাকিয়ে আছে গোটা দেশ। তাই অনেকে ভেবেছিলেন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কলকাতায় এসে আর জি কর কাণ্ডের ব্যাপারে বিশেষ আলোকপাত করবেন। দোষীদের চরম শাস্তির আশ্বাস তাঁর মুখ থেকে সবাই শুনতে চেয়েছিলেন। বিশেষ করে অভয়ার অভাগা বাবা, মা।
অনেক আশা নিয়ে অভয়ার বাবা, মা মেয়ের খুনের তদন্ত সিবিআইকে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিলেন। তাঁরা মনে করেছিলেন, কলকাতা পুলিস অপরাধীদের আড়াল করবে। কিন্তু সিবিআই নিরপেক্ষ তদন্ত করবে। তাই তাঁরা আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য অভয়ার জাস্টিস। সেই দাবি জানানোর জন্যই তাঁরা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। সন্তানহারা বাবা, মায়ের ক্ষতিপূরণ করার ক্ষমতা কারও নেই। অভয়াকে তাঁরা ফিরে পাবেন না। তবুও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে যন্ত্রণার কথা বলে কিছুটা হালকা হতেন। কিন্তু, সেই সুযোগটুকুও তাঁরা পেলেন না।
এতদিন বারবার ‘ঘাড়ধাক্কা’ খেয়েও বিজেপি নেতারা জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছেন। বিজেপি সব সময় পাশে আছে বলে জানিয়েছে। এমনকী কেউ কেউ একবার ডাকলেই যাইব, এমন কথাও বলেছেন। কিন্তু অমিত শাহ কলকাতা ছাড়তে না ছাড়তেই বিজেপি নেতারা ডাক্তারদের আন্দোলন নিয়ে ‘বেসুরো’ হতে শুরু করেছেন। কেউ কেউ গণআন্দোলনের ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ ইস্যু করে দিয়েছেন।
বাংলায় সরকার বিরোধী কোনও ইস্যু পেলেই বিজেপি ঝাঁপিয়ে পড়ে। তিন বছর ধরে বাংলায় ১০০ দিনের কাজ বন্ধ। আবাস যোজনার টাকাও কেন্দ্র দিচ্ছে না। কেবল রাজ্যের প্রাপ্য আটকানোর ফন্দি আঁটছে। দফায় দফায় কেন্দ্রীয় টিম পাঠিয়ে রাজ্য সরকারকে নাজেহাল করে দিচ্ছে। বাংলার গায়ে কালি লাগানোর কোনও সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। সন্দেশখালি ফ্লপ হওয়ার জ্বালা আর জি করের ঘটনায় মিটিয়ে নেওয়ার একটা জবরদস্ত সুযোগ ছিল। তাকে পুরোমাত্রায় কাজে লাগানোর জন্য অগ্নিমিত্রা পল ‘গোব্যাক’ স্লোগানের অপমান পর্যন্ত গায়ে মাখেননি। অমিত শাহের সঙ্গে অভয়ার বাবা, মায়ের সাক্ষাতের তদ্বির করেছিলেন অগ্নিমিত্রাই। কিন্তু দক্ষ ব্যাটসম্যানের মতোই বলের উপর চোখ রেখে একেবারে শেষমূহূর্তে ব্যাটটা সরিয়ে নিলেন অমিত শাহ।
অমিতজির এহেন আচরণ দেখে এখন বঙ্গ বিজেপির অনেকে বলছেন, বিষয়টি বিচারাধীন। তার উপর সিবিআই অভয়া খুনের তদন্ত করছে। তাই অমিত শাহ এবার দেখা করেননি। পরে তিনি অভয়ার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে পারেন। এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটি হল, বিচারাধীন বিষয়ে আলোচনায় আপত্তি থাকলে অগ্নিমিত্রা কেন অভয়ার বাবা, মায়ের সাক্ষাতের আর্জি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন? কেন অভয়ার বাবা-মায়ের মনে আশার আলো জ্বালিয়েও নামিয়ে আনলেন অমাবস্যার অন্ধকার?
একথা ঠিক, আর জি কর ইস্যুতেও ফের বাজার গরম করার একটা সুযোগ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনে এসেছিল। কিন্তু সেই সুযোগ তিনি কাজে লাগালেন না। উল্টে তিনি আর জি করের ঘটনাকে কার্যত উপেক্ষা করলেন। কলকাতায় এসেও অভয়াদের বাড়ি গেলেন না। এমনকী, রাজভবনে ডেকে পাঠিয়েও তাঁদের কথা শুনলেন না। এখন প্রশ্নটা হচ্ছে, আর জি করের ঘটনার মতো স্পর্শকাতর বিষয়েও কেন তিনি এমন উদাসীনতা দেখালেন? বামেরা অবশ্য এরজন্য ফাটা রেকর্ডের মতো সেই ‘সেটিং তত্ত্ব’ই আওড়াচ্ছে। অবশ্য অনিল বিশ্বাসহীন সিপিএমের কাছ থেকে এর বেশি কিছু আশা করা অন্যায়।
আর জি কর কাণ্ডের পর অমিত শাহ এই প্রথম কলকাতায় এলেও দিল্লি থেকেই পুরো ঘটনার উপর তীক্ষ্ণ নজর ছিল বিজেপির চাণক্যের। প্রথমে দলীয় সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এবং পরে অগ্নিমিত্রা পলকে গোব্যাক স্লোগান দেওয়ায় তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, জুনিয়র ডাক্তারদের এই আন্দোলন থেকে বিজেপির কোনও ফায়দা নেই। কারণ আন্দোলনের রাশ চলে গিয়েছে বাম এবং অতিবামেদের হাতে। এই আন্দোলনে অক্সিজেন জোগালে ক্ষতি হবে বিজেপিরই। তৃণমূল বিরোধী ভোট ভাগ হয়ে যাবে। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অপদস্থ করতে বঙ্গ বিজেপির একাংশ উঠেপড়ে লাগলেও অমিত শাহ ‘কালিদাসী’ পদক্ষেপ থেকে সরে দাঁড়ালেন।
জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের পাশে যে দিল্লি বিজেপি নেই, তার ঈঙ্গিত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আগেই দিয়ে রেখেছিলেন। কী ভাবে? সরকার বিরোধী কোনও ঘটনার গন্ধ পেলেই মহামহিম সঙ্গে সঙ্গে সেখানে পৌঁছে যান। কিন্তু রাজভবনে যাওয়া জুনিয়র ডাক্তারদের তিনি কার্যত পাত্তাই দিলেন না। ডেপুটেশন নিলেন, কথা বললেন না। অনেকে বলছেন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজ্যপালের মাধ্যমে দিল্লি কী চাইছে সেই ঈঙ্গিতটা দিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গ বিজেপি তাঁর ইশারা ধরতে পারেনি। বোঝা যাচ্ছে, ইশারা বোঝার মতো ‘সেয়ানা’ এখনও বঙ্গ বিজেপি হতে পারেনি।
আর জি কর ইস্যুতে ‘গণআন্দোলনে’র লাভ ক্ষতির হিসেব হবে সময়ের দাঁড়িপাল্লায়। তার বিচার করবে ভবিষ্যৎ। তবে, আপাতদৃষ্টিতে এই আন্দোলনের জেরে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অন্দরের কিছু দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ সামনে এসেছে। এই সব অভিযোগের সত্যাসত্য বিচার করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করলে শুধু রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল ফিরবে না, পোক্ত হবে সরকারের ভিত। তবে ক্ষতিও হয়েছে বিস্তর। চিকিৎসক পড়ুয়াদের মধ্যে বিভাজনের যে পাঁচিল তৈরি হয়েছে, তা চীনের প্রাচীরকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। তাকে ভাঙা প্রায় অসম্ভব। এরপর মেডিক্যাল কলেজগুলিতে চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে যত চর্চা হবে তার চেয়ে ‘থ্রেট সিন্ডিকেট’ প্রতিষ্ঠা নিয়ে লড়াই চলবে অনেক বেশি। আর কাদা ছোড়াছুড়িতে রোগীদের কাছে সাক্ষাৎ ভগবান, এমন চিকিৎসকের গায়েও লাগিয়ে দেওয়া হল কালি।
তবে, আর জি কর কাণ্ড চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য একজন কারও ডাকের অপেক্ষা করেন না। আর একজন রাজনৈতিক ফায়দা না থাকলে সন্তান হারানোর যন্ত্রণায় কাতর বাবা-মায়ের আর্জিতেও মুখ ফিরিয়ে নিতে কুণ্ঠিত হন না। ‘মানবিক’ আর ‘অমানবিকে’র ফারাকটা এখানেই।