একাধিক সূত্রে অর্থপ্রাপ্তি ও ঋণশোধে মানসিক ভাব মুক্তি। নিজ বুদ্ধি ও দক্ষতায় কর্মোন্নতি ও সুনাম। ... বিশদ
‘নব সংকল্প অর্থনৈতিক নীতি’ তৈরি করা হয়েছিল উদয়পুরে। গরিব শ্রেণির পাশে দাঁড়ানোর নীতি রায়পুরে ভেবেচিন্তেই নেওয়া হয়েছিল। কংগ্রেসের ইস্তাহারটি প্রকাশিত হয় ৫ এপ্রিল। এটির নাম দেওয়া হয় ‘ন্যায়পাত্র’। সেখানে ৪৬ পৃষ্ঠা জুড়ে বর্ণিত হয়েছে জনগণের বিশাল অংশের জন্য নস্যাৎ হয়ে যাওয়া ‘ন্যায়বিচার’ প্রদানের নানাদিক। ‘ন্যায়বিচার’ শব্দটি সেখানে গৃহীত হয়েছে বিবিধ অর্থে। তার মধ্যে রয়েছে সামাজিক ন্যায়বিচার, যুবদের জন্য ন্যায়বিচার, মহিলাদের জন্য ন্যায়বিচার, কৃষকদের জন্য ন্যায়বিচার এবং শ্রমিকদের জন্য ন্যায়বিচার।
জনগণের বৃহৎ অংশ বৈষম্যের শিকার। দেশের শ্রীবৃদ্ধির কাহিনি, সেটি দ্রুত বা মন্থর যেমনই হোক না কেন, তাতে অংশগ্রহণের ন্যায্য সুযোগ থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। মোদি সরকারের ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’-এর পর্দা ফাঁস করে দিয়েছে কংগ্রেসের এই ইস্তাহার। এই ইস্তাহার ওই সঙ্গে আর যে মারাত্মক কাজটি করেছে তা হল, দেশের শাসকের সামনে একটি আয়না ধরেছে। এটি পদক্ষেপের উপযুক্ততা এবং ন্যায়বিচারের (ইকুইটি অ্যান্ড জাস্টিস) সঙ্গে শ্রীবৃদ্ধি ও উন্নয়নের একটি বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গিও উপস্থাপন করেছে। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন কংগ্রেসের ইস্তাহারটিকে ২০২৪-এর নির্বাচনের হিরো বা নায়ক হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপি গোড়ার দিকে কংগ্রেসের ইস্তাহারটিকে উপেক্ষা করারই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এমন একটি নথিকে সংবাদ মাধ্যমও তেমন পাত্তা দেয়নি। এই ইস্তাহারের অনূদিত সংস্করণগুলি পৌঁছে গিয়েছে রাজ্যে রাজ্যে।
কংগ্রেসের প্রার্থী এবং প্রচারকরাও গ্রাম, শহর নির্বিশেষে এই নথির নিহিত বার্তা মানুষকে জানাচ্ছেন। তার ফলে কংগ্রেসের ইস্তাহারটি মানুষের মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে।৫ এপ্রিল থেকে ন’দিন অতিবাহিত হওয়ার পর বিজেপি তাদের ইস্তাহার প্রকাশ করে। কেউ তা খেয়ালই করেনি। ‘মোদি কি গ্যারান্টি’ শিরোনামের নথির মাধ্যমে মোদি-পূজার যেসব উপকরণ সাজানো হয়েছে, স্বয়ং নরেন্দ্র মোদিও তার প্রশংসা করেননি। বিজেপির ইস্তাহার প্রকাশের মাত্র একসপ্তাহ বাদে, ২১ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হয় ১০২টি আসনের ভোট। ইন্টেলিজেন্সের খবর বিজেপির জন্য স্পষ্টতই খারাপ ছিল। এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে, যেসব ভোটার কংগ্রেস এবং তার মিত্রদের সমর্থন করেছেন, তাঁরা ভোট দিয়েছেন ইস্তাহারে দেওয়া ‘প্রতিশ্রুতি’র পক্ষে, ঠিক যেমন তাঁরা কর্ণাটক এবং তেলেঙ্গানায় ‘গ্যারান্টি’র প্রশ্নে ছিলেন। নরেন্দ্র মোদির ‘গ্রেটেস্ট অফ অল টাইম’ (সংক্ষেপে ‘জিওএটি’ বা ‘গোট’) স্লোগান ফেল করার কারণে ২১ এপ্রিল তিনি সুর পাল্টে ফেলেছেন।
বিজেপি তার সমস্ত নেতা এবং সদস্যদের জন্য যে চিত্রনাট্য তৈরি করেছে তা গোয়েবলসকে গর্বিত করবে: মিথ্যা, আরও মিথ্যা এবং আরও মিথ্যা; সত্য যদি মিথ্যাকে খণ্ডন করে, সত্যকে উপেক্ষা কর। গত দু’সপ্তাহ যাবৎ চালানো মিথ্যার একটি নমুনা এখানে রইল: মিথ্যা: কংগ্রেসের ইস্তাহারে মুসলিম লিগের ছাপ রয়েছে।
সত্য: অথচ, ৪৬ পৃষ্ঠার একটিতেও ‘মুসলিম’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। ইস্তাহারে ‘সংখ্যালঘু’ বলতে ধর্মীয় ও ভাষাগত উভয় সংখ্যালঘুকেই বোঝানো হয়েছে। কংগ্রেসের বক্তব্য, ‘ভারতের সংবিধানে ভাষাগত এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মানবিক ও নাগরিক অধিকারগুলি দেওয়া হয়েছে। কংগ্রেস এই অধিকারগুলি প্রদানের এবং রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।’ ইস্তাহারে এসসি, এসটি এবং ওবিসিদের কল্যাণের অনেক কথারই উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু কোথাও কোনও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উল্লেখ নেই।
মিথ্যা: কংগ্রেস নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় ফিরলে শরিয়ত আইন চালু করে দেবে।
সত্য: কিন্তু ইস্তাহারে বলা হয়েছে, ‘আমরা পার্সোনাল ল বা ব্যক্তিগত আইনের সংস্কারে উৎসাহ দেব। তবে এই ধরনের সংস্কার অবশ্যই করা হবে সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে এবং সম্মতিতে।’
মিথ্যা: কংগ্রেসের ইস্তাহারে মার্কসবাদী এবং মাওবাদী অর্থনৈতিক তত্ত্বের কথা বলা হয়েছে।
সত্য: ১০ পৃষ্ঠা জুড়ে আলোচিত হয়েছে অর্থনৈতিক প্রসঙ্গগুলি। তার ভূমিকায় কংগ্রেস বলেছে যে, কংগ্রেসের আর্থিক নীতির বিকাশ ঘটেছে বহু বছরের চেষ্টায়। দেশে উদারীকরণের যুগের সূচনা ১৯৯১ সালে এবং কংগ্রেসের হাতে। সেই সুবাদে দেশ পা বাড়িয়েছে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাযুক্ত একটি মুক্ত, স্বাধীন এবং প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির দিকে। তার ফলে দেশ উপকৃত হয়েছে নানাভাবে। যেমন—বিপুল পরিমাণ সম্পদ সৃষ্টি হয়েছে। তৈরি হয়েছে নতুন নতুন ব্যবসা এবং উদ্যোপতি। মাথা তুলেছে একটি সমৃদ্ধ মধ্যবিত্ত শ্রেণি। লক্ষ লক্ষ চাকরির দরজা খুলে গিয়েছে যুবদের সামনে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে বহু গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবনও দেখেছি আমরা। লক্ষ লক্ষ মানুষকে দারিদ্র্যের গণ্ডি থেকে বের করে আনা সম্ভব হয়েছে। একটি মুক্ত অর্থনীতির প্রতিই আমাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করছি। প্রাইভেট সেক্টর বা বেসরকারি ক্ষেত্র অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতে নেতত্ব দেবে, তবে তা হয়ে উঠবে একটি শক্তিশালী এবং কার্যকরী পাবলিক সেক্টর বা সরকারি ক্ষেত্রের পরিপূরক।’
মিথ্যা: নির্বাচিত হলে কংগ্রেস এসসি, এসটি এবং ওবিসিদের জন্য সংরক্ষণ তুলে দেবে।
সত্য: অথচ, এই নির্বাচনী ইস্তাহারে বলা হয়েছে, ‘কংগ্রেস গ্যারান্টি দেয় যে এসসি, এসটি এবং ওবিসিদের জন্য সংরক্ষণের ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বসীমা বৃদ্ধির জন্য তারা একটি সাংবিধানিক সংশোধনী পাস করবে। চাকরি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, আর্থিক দিক থেকে দুর্বল শ্রেণির (ইডব্লুএস) জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণ কার্যকর করা হবে কোনওরকম বৈষম্য ছাড়াই, সেখানে সমস্ত জাতি ও সম্প্রদায় অন্তর্ভুক্ত হবে। এসসি, এসটি এবং ওবিসিদের জন্য সংরক্ষিত শূন্যপদগুলি সমস্ত ‘ব্যাকলগ’ ধরেই আমরা এক বছরের মধ্যে পূরণ করব।’ এসসি, এসটি এবং ওবিসিদের উন্নয়নে আরও অনেক প্রতিশ্রুতি রয়েছে কংগ্রেসের ইস্তাহারে।
মিথ্যা: কংগ্রেস উত্তরাধিকার কর আরোপ করবে।
সত্য: কর ব্যবস্থা এবং কর সংস্কারের ব্যাপারে ইস্তাহারে ১২ দফা আলোচনা রয়েছে। সেখানে কংগ্রেস একটি ‘ডাইরেক্ট ট্যাক্স কোড’ চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আর প্রতিশ্রুতি রয়েছে—পাঁচ বছরের জন্য স্থিতিশীল ব্যক্তিগত আয়কর হার এবং ক্যাপ সেস ও সারচার্জের হার ৫ শতাংশ বজায় রাখা। পাস করা হবে জিএসটি ২.০। এছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এমএসএমই) এবং ছোট খুচরো ব্যবসার উপর থেকেও করের বোঝা কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কংগ্রেস। উত্তরাধিকার কর নিয়ে কোনও কানাঘুষোও তাদের ইস্তাহারে নেই।
নরেন্দ্র মোদি মিথ্যা প্রচার করে চলেছেন। কংগ্রেসের ইস্তাহারের সত্যকে নির্বাচনী বিতর্কে এনে দিতে পেরেছেন তিনিই। পাশাপাশি, বিজেপির ইস্তাহারের কোনও উল্লেখ তাঁর কথায় পাওয়া যায়নি। সব মিলিয়ে, কংগ্রেসের ইস্তাহার নিয়ে এম কে স্ট্যালিনের বক্তব্যকেই সমর্থন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন যে, কংগ্রেসের ইস্তাহারই হল চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনের আসল নায়ক।