সম্মানরক্ষায় বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। শত্রুর সঙ্গে সম্মানজনক সমঝোতা। বাড়ি ঘর বাহন কেনার যোগ। কর্মে সংস্থাগত ... বিশদ
এ কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দেশের কোনায় কোনায়, প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শহরে গত দু’সপ্তাহে দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় এরকমই হাজার হাজার মর্মান্তিক হৃদয় বিদীর্ণ করা কাহিনি উঁকি মারছে আজ। চারদিকে শুধু স্বজন হারানোর হাহাকার। সকাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজে ভারী হয়ে উঠছে চারপাশের পরিবেশ। মিলছে না বেড। অনেক যুদ্ধ করে বেড মিললেও ডাক্তার অমিল। আবার ডাক্তার পাওয়া গেলেও নেই অক্সিজেন। সুযোগ বুঝে চলছে জীবনদায়ী ওষুধ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীদের কালোবাজারি। চাইলে ভগবান মেলে, কিন্তু অক্সিজেন, রেমডিসিভির মেলে না, এ কোন মৃত্যু উপত্যকায় আজ বাস আমাদের! সবমিলিয়ে চারদিক থেকে মানুষের আত্মবিশ্বাসকে ভেঙে চুরমার করে দেওয়ার কী প্রকাণ্ড আয়োজন! আর কেন্দ্রের সরকার সব দেখেও কেমন নির্বিকার, স্থবির!
দেশ চুলোয় যাক, সরকারের দুই স্থপতি কয়েকমাস যাবৎ শুধু নিয়ম করে হাওয়াই জাহাজে এসেছেন আর ঘুরেছেন। আর বাংলা দখলের দু’শো ফিরিস্তি হাজির করেছেন। এই সেদিনও ভিড় জমিয়েছেন উত্তর থেকে দক্ষিণ। ‘জয় শ্রীরাম’ আর ‘দিদি ও দিদি’ বাক্যবাণ নিক্ষেপ করেছেন গোটা বাঙালি সমাজের দিকে। চোখে সব দখলের আগুন। হিটলারকে চাক্ষুষ করিনি। কিন্তু এই নির্বাচন নিশ্চিতভাবে এক মেগালোম্যানিয়াকের সন্ধান দিয়েছে, যিনি কৃপাণ হাতে বাংলার অস্মিতাকে
ধ্বংস করতে উদ্যত। বারবার এসে দূরত্ববিধি ভেঙেছেন, কিন্তু ওষুধ পথ্য অক্সিজেন নিয়ে একটি কথাও বলেননি। দুঃসময়ে বাংলাকে দু’হাজার ভেন্টিলেটর দিলাম, রেমডিসিভিরের বরাত দ্বিগুণ করে দিলাম, এমন আশ্বাসবাণী দিতে শুনেছেন কেউ! গরিবের ঘরে পাত পেড়ে খেয়েছেন, অনেক নাটক করেছেন, তারপর তার সংসার চলছে কি না সে খোঁজ আর নেওয়া হয়ে ওঠেনি হাজার কাজের ভিড়ে। শুধু ‘সুনার বাংলা’ গড়ব বলেই ফিরে গিয়েছেন দিল্লির কোলে।
প্রশ্ন উঠছে, বিশেষজ্ঞরা করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে চলতি বছরের শুরু থেকে সতর্ক করার পরও মোদি সরকার কি সতর্ক হয়েছিল? আগাম ভ্যাকসিন নীতি, অক্সিজেন সরবরাহের প্ল্যান কিংবা দ্বিতীয় ঢেউয়ের জন্য হাসপাতালে বেড বাড়ানোর কোনও ব্লুপ্রিন্ট কেন আগে থেকেই তৈরি করা হয়নি? কেন সুপ্রিম কোর্টকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আজ এই কঠিন সময়ে ভর্ৎসনা করতে হবে সরকারকে? বলতে হবে, সরকার বাহাদুর আপনাদের প্ল্যানটা কী জানান। এই কাজটা কি একটা দায়িত্বশীল সরকারের অনেক আগে থেকেই করা উচিত ছিল না? বিশেষ করে সেই সরকার, যার একটাই ব্রত, সবকা সাথ, সবকা বিকাশ। তার বদলে এ তো দেখছি সবকা বিনাশ নিশ্চিত হতে চলেছে!
এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি হতে পারে জেনেও ভ্যাকসিন বাজারে আসার পর তা সবার মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে দিতে মোদি সরকার ব্যবস্থা নেয়নি, কেন? গোটা বিশ্ব জানে, করোনা ভ্যাকসিনের বৃহত্তম প্রস্তুতকারক দেশের নাম ভারত। সেই হিসেবে ভারতে টিকাকরণের সামনে কোনও সঙ্কট থাকার কথা নয়। তাহলে টিকা নিয়ে এই পরিকল্পনার অভাব কেন? নতুন করে মারণ ভাইরাস চেপে বসতেই পলেস্তারা খসে আমাদের ভগ্ন স্বাস্থ্যব্যবস্থার কঙ্কালসার চেহারাটা বেরিয়ে পড়েছে। রাজ্যে রাজ্যে দেখা দিয়েছে আকাল। তার একটা বড় কারণ দেশের প্রয়োজন মেটানোয় অগ্রাধিকার দেননি মোদি। জানুয়ারিতে দেশজুড়ে শুরু হয় প্রথম দফার টিকাকরণ। অগ্রাধিকার দেওয়া হয় হেলথ ওয়ার্কার, প্রবীণ নাগরিক, কোমরবিডযুক্ত ৪৫ বছরের ঊর্ধ্বের নাগরিককে। এখন চলছে দ্বিতীয় দফার টিকাকরণ। ভ্যাকসিনের আকাল নিয়ে ক্ষোভের আঁচ দ্বিতীয় দফাতেই চরমে উঠেছে। সরকারি, বেসরকারি সব হাসপাতালেই ভ্যাকসিন নেওয়ার লাইন, প্রতীক্ষা ও দুর্ভোগ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। ১ মে থেকে শুরু হবে তৃতীয় দফার টিকাকরণ। ১৮ বছরের ঊর্ধ্বের সকলকেই ভ্যাকসিন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কিন্তু তার আগে ভ্যাকসিনের জোগান পর্যাপ্ত করা জরুরি। তার চেয়েও বড় সঙ্কট আসছে টিকার দাম নিয়ে। সরকার কেন হঠাৎ দামের উপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করল তা বোঝা গেল না। ফলে বাজারে নানান দামে নানা কিসিমের টিকা মিলবে। এবং তা নিয়ে একটা বড় দুর্নীতির খেলা শুরু হতে চলেছে। এখনই সতর্ক না-হলে এই সঙ্কট কিন্তু আরও বড় বিপদ ডেকে আনবে।
ইতিমধ্যেই সংক্রমণের বিপদ মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে শিখর স্পর্শ করবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রথম দু’দফায় কিছু মানুষ বিনামূল্যে ভ্যাকসিন পেয়েছেন। কিছু মানুষ আবার বেসরকারি হাসপাতাল থেকে নিজ খরচেও ভ্যাকসিন নিয়েছেন। এই ব্যবস্থা বদলে টিকাকরণের নীতিটাই পাল্টেছেন মোদি। নয়া নীতিতে রাজ্য সরকার এবং সাধারণ মানুষের ঘাড়েই চাপছে ভালোরকম খরচের বোঝা। তুলে নেওয়া হয়েছে দামের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ। বেসরকারি হাসপাতাল থেকে প্রথম ডোজ ২৫০ টাকায় মিলেছিল। সেটাই এবার কিনতে হবে অনেক চড়া দামে। কারণ ভ্যাকসিন জোগানের দায় কেন্দ্র আর নেবে না। রাজ্যের মাধ্যমেও ভ্যাকসিন দেবে না। কেন্দ্রকে যে দামে বেচবে সেই দামে আর দেবে না, রাজ্যগুলিকে কিনতে হবে বাড়তি দামে। খেয়াল করার মতো বিষয় হল, পশ্চিমবঙ্গসহ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভার ভোটের লড়াইতে বিজেপির জয়ের আশা ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসতেই কি এবার মোদি সরকার কার্যত হাত তুলে নিয়েছে! এই কঠিন সময়ে সহায়তা ও সাহায্যের বদলে মোদি সরকারের এই ভূমিকা অত্যন্ত নিন্দনীয়। অস্বীকার করলে চলবে না, এই গরিব দেশে বিনামূল্যে সকলের টিকাকরণের দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত সরকারকেই নিতে হবে। এবং তা করতে হবে দ্রুত এবং সুস্পষ্ট নীতি মেনে। গত জানুয়ারি-মার্চে ভারত ৬ কোটি ডোজ করোনা ভ্যাকসিন রপ্তানি করেছে। একই সময়ে দেশবাসীকে দেওয়া হয়েছে মাত্র তিন-চার কোটি ডোজ। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, মোদি সরকারের এই আশ্চর্যরকম উদাসীনতার পিছনে প্রকৃত কারণটা কী?
সরকারের উদাসীনতারই উল্টো পিঠে আমরা কী দেখলাম? গত দেওয়ালির পর থেকে যেই প্রথম ঢেউয়ের প্রকোপ একটু কমল অমনি যেন সরকারের চোখে মুখে যুদ্ধ জয়ের আমেজ। যাবতীয় সতর্কতা উধাও। সরকার সবকিছুতে ঢিলে দিতেই লাটে উঠল কোভিড বিধিও। সব ভুলে সেই ডিসেম্বর থেকে গোটা কেন্দ্রীয় সরকারটা ঝাঁপিয়ে পড়ল বাংলা দখলে। আর যেন কোনও কাজ নেই। এমনও
বলা হল, ওই একটা স্বপ্নই অধরা থেকে গিয়েছে। তাই ঝাঁপাও বাংলা দখলে। এ পর্যন্ত গত
চার-পাঁচ মাসে বাংলা দখলের নেশায় যে বিপুল পরিমাণ টাকা মোদিজি খরচ করেছেন, তার সামান্য অংশও যদি অসহায় কাজ হারানো পরিযায়ী শ্রমিকদের দিতেন। নেতা কিনতে আর বিমানে-কপ্টারে আকাশ-বাতাস কাঁপানো প্রচারে যে হাজার হাজার কোটি ব্যয় হয়েছে, তার একটুও যদি গ্রামবাংলার গরিব কৃষক-শ্রমিক পেতেন তাহলে তাঁদের একটু উপকার হতো।
ঠিক করেছিলাম, ২ মে পর্যন্ত ভোট-রাজনীতি ছাড়া আর কোনও কিছু নিয়ে লিখব না। কিন্তু হঠাৎই দেশজুড়ে মৃত্যু মিছিল শনিবার সকালে সিদ্ধান্তটা বদলে দিল। প্রতিদিন ৩ লক্ষের বেশি আক্রান্ত আর ২ হাজার মৃত্যু যে-দেশের নিয়তি, সেখানে সুনার দেশটাই যে অবিরাম কাঁদছে। ‘সুনার বাংলা’ আর হবে কী করে? মহামারীর মধ্যে রাজার গলায় একটা অঙ্গরাজ্য দখলের এই নষ্টামি মানায়?