সম্মানরক্ষায় বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। শত্রুর সঙ্গে সম্মানজনক সমঝোতা। বাড়ি ঘর বাহন কেনার যোগ। কর্মে সংস্থাগত ... বিশদ
ঘুরে ফিরে সেই শীতলকুচিই এসে যাচ্ছে। আসার কারণও আছে। পশ্চিমবঙ্গে এমন ঘটনা ঘটেনি কোনওদিন। শুধু চারজনের মৃত্যুই নয়, কমিশন ও পুলিস কর্তাদের ভূমিকাও নজিরবিহীন। কোচবিহারের এসপি দেবাশিস ধরের বক্তব্যের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। তাতে তিনি বাহিনীর গুলি চালানোর জন্য গ্রামবাসীদের আক্রমণের তত্ত্ব সামনে এনেছেন। দাবি করেছেন, গ্রামের মহিলারা কাটারি, খুন্তি নিয়ে আক্রমণ করেছিলেন। তাই কেন্দ্রীয় বাহিনী গুলি চালিয়েছে। কিন্তু আক্রমণের সপক্ষে কোনও প্রমাণ এখনও কমিশন বা পুলিস জনসমক্ষে আনতে পারেনি।
বিজেপি নেতৃত্ব এসপির এই বক্তব্যকে হাতিয়ার করেই বলছে, ‘বাহিনী আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিস তেমনই রিপোর্ট দিয়েছে।’ বিজেপি নেতৃত্ব দেবাশিস ধরকে ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিস’ বলে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবটা হল, দেবাশিসবাবুকে নির্বাচন কমিশনই এসপি করেছিল।
২৪ মার্চ বিজেপির দিনহাটা শহর মণ্ডলের সভাপতি অমিত সরকারের ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার হতেই শুরু হয়ে গিয়েছিল গেরুয়া বাহিনীর তাণ্ডব। বিজেপির অভিযোগ ছিল, অমিতবাবুকে তৃণমূলের লোকজন খুন করে ঝুলিয়ে দিয়েছে। সেই রাতেই কমিশন দেবাশিসবাবুকে এসপির দায়িত্ব দিয়েছিল। কমিশনের বিশেষ পুলিস পর্যবেক্ষক বিবেক দুবেও সরেজমিনে গিয়ে অমিতবাবুর রহস্যমৃত্যুর তদন্ত করেছেন। তিনিও ‘সুইসাইড’ তত্ত্বেই সিলমোহর দিয়েছেন বলে সূত্রের খবর।
তারপরেও কেন এসপি পদে কে কান্ননকে ফিরিয়ে আনা হল না? অনেকে বলছেন, পায়ের মাপে জুতো কেনা নয়, জুতোর মাপে পা তৈরিই উদ্দেশ্য। সেই কারণেই নাকি এমনটা!
সুপ্রিম কোর্ট সিবিআইকে ‘খাঁচায় বন্দি তোতাপাখি’ বললেও মানুষ স্বশাসিত সংস্থার কাছে নিরপেক্ষতাই আশা করে। নির্বাচন কমিশনও স্বশাসিত সংস্থা। কিন্তু, এবার বঙ্গের নির্বাচনে কমিশনের ভূমিকা নিয়ে এত অভিযোগ উঠছে, যা এর আগে কখনও ওঠেনি। নির্বাচনের সময় কমিশনের অফিসার বদল রুটিন ঘটনা। আগে ঘটনা ঘটলে অফিসারকে সরিয়ে দিত কমিশন। কিন্তু এবার প্রথম থেকেই খড়্গহস্ত। ডিজি অপসারণ দিয়ে শুরু। তারপর একে একে এডিজি আইন শৃঙ্খলা, বিভিন্ন জেলার এসপি এবং ডিএম, এসডিপিও-কে সরানোর প্রক্রিয়া রয়েছে অব্যাহত।
ঘটনাক্রম বলছে, এবার প্রশাসনের মাথাকেই টার্গেট করা হচ্ছে। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব হয়তো মনে করছে, মাথাকে জখম করলেই শরীর অকেজো হয়ে যাবে। তাই প্রথম থেকেই কর্তাদের বিরুদ্ধে নালিশ। কখনও কখনও আবার অভিযোগও করতে হচ্ছে না। বিজেপি নেতারা হাঁ করলেই হাওড়া দেখে ফেলছে।
বিজেপি নেতারা একবার বিষোদ্গার করলেই বদলি হয়ে যাচ্ছেন অফিসার। হয়তো সেই বদলির পিছনে বিজেপির হাত নেই। হয়তো সবটাই কমিশনের একান্ত নিজস্ব সিদ্ধান্ত। কিন্তু মানুষের ওই একটাই দোষ, সব সময় দুই আর দুইয়ে চার করে। ভাবছে, কমিশন চলছে বিজেপি নেতাদের অঙ্গুলিহেলনে!
বীরভূমের পুলিস সুপার বদলের এমনই ‘যোগ’ কাজ করেছে বলে তৃণমূলের অভিযোগ। বিজেপি নাকি বুঝতে পেরেছে, পুলিস পাশে না থাকলে অনুব্রত মণ্ডলের গড় দখল তো দূরের কথা, দাঁত ফোটানোই মুশকিল। তাই তাঁরা দেবাশিস ধরের মতো ‘দক্ষ অফিসার’ চাইছিলেন। তার খোঁজ করতে গিয়েই মিলেছে নগেন্দ্রনাথ ত্রিপাঠীর সন্ধান। ‘নন্দীগ্রামখ্যাত’ ত্রিপাঠী সাহেবকে বিজেপিরও বেশ মনে ধরেছে।
বিজেপির কাছে বোলপুর আসনটা খুব জরুরি। তাই নাকি একই সঙ্গে বীরভূমের এসপি এবং বোলপুরের এসডিপিও বদল। নতুন অফিসাররা দায়িত্ব নিতে না নিতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে গেরুয়া বাহিনী। খোদ বিজেপি প্রার্থীর উপস্থিতিতে তৃণমূলের লোকজনকে পেটানোর একটা ছবি ভাইরালও হয়েছে।
ভোটের দফা যত এগচ্ছে সিবিআই কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়ছে। বেশ কিছুদিন হল কয়লা কাণ্ড, গোরু পাচার কাণ্ডের কথা আর শোনা যাচ্ছে না। অথচ নির্বাচনের আগে রোজ বলা হচ্ছিল, সিবিআই শতাধিক পুলিস অফিসারের তালিকা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ৪ এপ্রিল বাঁকুড়া থানার আইসি অশোক মিশ্র গ্রেপ্তার হওয়ার পর বিজেপি নেতারা দ্বিগুণ উৎসাহে বলতে লাগলেন, ‘অফিসারদের রাতের ঘুম চলে গিয়েছে। এবার কালীঘাট।’
১ এপ্রিল বাঁকুড়া থানার আইসি অশোক মিশ্রকে সামনে রেখে ভোট করানোর তিনদিন পর সিবিআই তাঁকে গ্রেপ্তার করল। কয়েকদিন পর বাঁকুড়ার পুলিস সুপারকেও ডেকে পাঠাল। কিন্তু তারপর সব চুপচাপ। সেটিং? নাকি কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটের সন্ধান?
কয়লা পাচার নিয়ে সিবিআই দীর্ঘদিন তদন্ত করছে। তাই অশোক মিশ্রের মতো অফিসারদের নাম তাঁদের অজানা নয়। তবুও তাঁকে চেয়ারে রেখে কমিশন কেন নির্বাচন করাল? একই প্রশ্ন উঠছে বাঁকুড়ার পুলিস সুপারকে ঘিরেও। পাশাপাশি আরও একটা প্রশ্ন উঠছে, আসানসোল ও মুর্শিদাবাদের সূতিকাগারে ‘অশোক মিশ্র’রা কোন জাদুবলে রয়ে গেলেন? নাকি এখানেও জুতোর মাপে পা তৈরি করা হল?
২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে রাজ্য প্রশাসন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে। তখন থেকেই কমিশনের কর্তাদের যাতায়াত শুরু। একমাস বা তারও বেশি সময় একসঙ্গে কাজ করার পর একেবারে নির্বাচনের মুখে কমিশনের বোধোদয়, অফিসার নিরপেক্ষ নন। তাই তাঁকে সরিয়ে দিতে হবে। পূর্ব মেদিনীপুরের এসপিকে ছাড়া কাউকেই নাকি সরানোর কারণ জানানো হয়নি।
বীরভূম ও পূর্ব বর্ধমানের এসপি সহ চারজন অফিসারকে একই দিনে সরিয়ে দিয়েছে কমিশন। এর মধ্যে পূর্ব বর্ধমানের এসপি ভাস্কর মুখোপাধ্যায়কে সরানো নিয়ে সাধারণ মানুষও বিস্মিত। তাঁরই নেতৃত্বে জেলার আটটি বিধানসভা কেন্দ্রে ভোট হয়েছে। ভোটে বোমাবাজি বা গুলি চালানোর মতো কোনও ঘটনাও ঘটেনি। তা সত্ত্বেও তিনি অপসারিত। কিন্তু অপসারণে কারণ জানানো হল না। এসব দেখে একটা কথাই মনে আসে, ‘অপরাধী জানিল না কিবা অপরাধ তাহার, বিচার হইয়া গেল।’
যে কোনও অফিসারকে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা কমিশনকে দিয়েছে সংবিধান। আবার সেই সংবিধানই অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়ার কথাও বলেছে। তাহলে পদচ্যুত অফিসার কেন তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার কারণ জানতে পারবেন না? কেন পদচ্যুত অফিসার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবেন না, সেই প্রশ্ন তোলার সময় বোধোহয় এসে গিয়েছে।
কমিশন ব্যবস্থা নিলে সেই অফিসারের গায়ে ‘দাগ’ লেগে যায়। পক্ষপাতিত্বের দাগ। দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে কাজ করা অফিসারকে সরিয়ে দিলে তিনি যে শুধু মানসিকভাবেই বিপর্যস্ত হন তা নয়, সমাজের কাছেও হেয় প্রতিপন্ন হন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের জায়গায় এমন অফিসারকে পাঠানো হয়, যাঁদের কর্মজীবনের বেশির ভাগ সময়টাই কেটেছে ‘সাইড লাইনে’। অফিসার বাছার সময় দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতার চেয়েও প্রাধান্য পায় রাজ্য সরকারের প্রতি তাঁদের ক্ষোভ কতটা তীব্র। এর ফলে জেলার ইতিহাস, ভূগোল না জানা অফিসারও এসপির দায়িত্ব পান। জনপ্রতিনিধিত্ব আইনবলে কমিশন অফিসার পরিবর্তন করতে পারে, কিন্তু তাতে বাংলার মানুষের রায় বদলাবে না।
কমিশন ‘নিরপেক্ষ’ নির্বাচনের স্বার্থে যাঁদের দায়িত্ব দিচ্ছে, তাঁদের মধ্যে নগেন্দ্রনাথ ত্রিপাঠিকে নিয়েই সবচেয়ে বেশি চর্চা। শোনা যাচ্ছে, তাঁকে পছন্দ করার পিছনে রয়েছে নন্দীগ্রামের ব্যাকগ্রাউন্ড। বয়ালে তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে উর্দি দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘এতে দাগ লাগতে দেব না।’ সেই ভিডিও ভাইরাল হতেই বিজেপি শিবিরে তাঁর চাহিদা তুঙ্গে।
শুধু বিজেপি নয়, কমিশনও বীরভূমে শান্তিপূর্ণ ভোট করানোর জন্য নগেন্দ্র ত্রিপাঠিকেই যোগ্য মনে করেছে। নগেন্দ্রজি, আপনি বড় মুখ করে বলেছেন, আপনার উর্দিকে কোনও দাগ ছুঁতে পারবে না। আপনার জন্য রইল শুভকামনা। নির্বাচন রক্তপাতহীন এবং শান্তিপূর্ণ হোক। তবে ‘ফ্রি হিট’ ভেবে ক্রিজ ছেড়ে বেরলেই বিপদ। মনে রাখবেন, রক্তের দাগ মারাত্মক। একবার লাগলে সহজে ওঠে না।