শিক্ষার জন্য দূরে কোথাও যেতে পারেন। প্রেম-প্রণয়ে নতুন যোগাযোগ হবে। বিবাহের কথাবার্তাও পাকা হতে পারে। ... বিশদ
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বহুদিন ধরেই কংগ্রেসকে সিপিএমের ‘বি টিম’ বলতেন। তিনি বুঝেছিলেন, কংগ্রেসের মধ্যে থাকলে কিছুতেই সিপিএমকে হটানো যাবে না। সিপিএম বিরোধী আন্দোলন তীব্র হলেই হয় দিল্লির হাইকমান্ড তাতে জল ঢালত, অথবা প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব নানা ছলাকলা করে তাঁকে দমিয়ে দিত। তাই তিনি কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল গড়েছেন এবং লক্ষ্যভেদও করেছেন। ২০১৬ সালে সেই কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করল সিপিএম। কিন্তু, কংগ্রেস ও সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্বের বোঝাপড়া যে অনেক আগে থেকেই, তার প্রমাণ মিলেছে স্বয়ং সীতারাম ইয়েচুরির লেখায়। প্রণববাবুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বোঝাতে গিয়ে ইয়েচুরি সাহেব ‘গোপন বোঝাপড়া’র বিষয়টি ফাঁস করে ফেলেছেন।
প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর ইয়েচুরি সাহেব লিখেছেন, ‘২০০৪ সালে এনডিএ সরকারকে হারাতে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ দলকে এককাট্টা করার সূত্রে প্রণববাবুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলার সুযোগ হয়েছিল।… একটা বৈঠকের সময় একদিন হঠাৎ এক পাশে টেনে নিয়ে গিয়ে ওঁর লোকসভা ভোটে লড়া ঠিক হবে কি না, তা নিয়ে আমার মতামত চাইলেন। তার আগে উনি কখনও লোকসভায় সাংসদ হিসেবে জিতে আসেননি। মনে আছে, প্রথমটায় কিছু বলতে চাইনি। ওঁর মতো কাউকে এ বিষয়ে উপদেশ দেওয়াটা ঠিক হবে না বলে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। উনি কিন্তু জোর করলেন। বললাম, জেতার ব্যাপারে নিশ্চিত হলে তবেই লড়ুন। সেবারের ভোট খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিজেপিকে হারাতে আমরা সবাই মিলে কাজ করেছিলাম। প্রণবদা হারলে ভুল বার্তা যেত। শেষ পর্যন্ত প্রণবদা জঙ্গিপুর থেকে লড়লেন এবং জিতলেনও।’
এখানে দু’টি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেবার জঙ্গিপুরে সিপিএমের প্রার্থী হেরেছিলেন। আর মুর্শিদাবাদ লোকসভা আসনে কংগ্রেসের মান্নান হোসেন হেরেছিলেন। জিতেছিল সিপিএম। হতে পারে কাকতালীয়, কিন্তু নিন্দুকে বলে, ‘বোঝাপড়া’।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছুদিন ধরে কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপির ‘রামধনু জোটে’র কথা বলছেন। বিজেপির সঙ্গে সিপিএমের মতো তথাকথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দলের আঁতাত? নৈব নৈব চ। এসব করা তো দূরের কথা, ভাবাও মহাপাতকের কাজ। দলের নিচুতলার কর্মী-সমর্থকরা তৃণমূলকে হারানোর জন্য ‘ভুল করে’ বিজেপিকে ভোট দিতেই পারেন, তা বলে সিপিএম নেতারা তলে তলে ধর্মীয় শক্তির সঙ্গে হাত মেলাবেন? অসম্ভব। কিছুতেই হতে পারে না। কারণ মহামতি লেনিন বলেছেন, ‘ধর্ম হল আফিমের মতো।’ তাই ধর্ম থেকে শতহস্ত দূরে। সিপিএমের একটাই মন্ত্র, শ্রেণি সংগ্রাম। ধনীর বিরুদ্ধে গরিবের লড়াই। এখানে ধর্ম বা ভাববাদের কোনও জায়গা নেই। সেই কারণেই তো হেগেল সাহেবকে বাদ দিয়ে কাল মার্কস ও মহামতি লেনিনকেই তাঁরা ‘গুরু’ মেনেছেন।
মার্কসবাদ সম্পর্কে যাঁদের ন্যূনতম জ্ঞানগম্যি আছে তাঁরা জানেন, এই মতবাদের ভিত্তি হল লড়াই এবং সংগ্রাম। প্রলেতারিয়েতের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠাই মূল উদ্দেশ্য। সবটাই মেহনতি মানুষের স্বার্থে। আন্দোলনই বামেদের ঘুরে দাঁড়ানোর একমাত্র রাস্তা। সেই রাস্তাতেই হাঁটতে শুরু করেছিল বাম নেতৃত্ব। নয়া কৃষি আইনের প্রতিবাদে রাস্তায় নামতেই মৃতপ্রায় বাম শিবিরে জেগেছে প্রাণের স্পন্দন। যুব সমাজ কাজের দাবিকে সামনে রেখে লাল ঝান্ডাকেই আঁকড়ে ধরতে চাইছে। এমনই এক সন্ধিক্ষণে আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে জোটের চেষ্টা? এটা কি ‘গেম প্ল্যান’?
সিপিএম নেতারা বলেন, বিজেপি এবং তৃণমূলকে হটাতে তাঁরা যে কোনও ধর্মনিরপেক্ষ, বাম গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে জোট করতে প্রস্তুত। তাঁদের মতে, বিজেপি হিন্দুদের পার্টি। আর তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংখ্যালঘু তোষণকারী। অতএব ‘সাচ্চা ধর্মনিরপেক্ষ’ হল বামেরা। আর সঙ্গী হওয়ার সুবাদে কংগ্রেসও। সম্প্রতি সিপিএম আরও একটি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শক্তির সন্ধান পেয়েছে। আইএসএফ, যার নেতা আব্বাস সিদ্দিকি। কয়েকটি আসন বেশি পাওয়ার লোভে আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে সমঝোতা করতে মরিয়া সিপিএম। একে সমঝোতা না বলে ‘আত্মসমর্পণ’ বলাই ভালো।
কে এই আব্বাস সিদ্দিকি? না, কোনও শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস তাঁর নেই। তাঁর পরিচয়, তিনি ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা। তিনি জলসায় ভাষণ দেন। তাঁর নাকি অনেক অনুগামী। তাঁর জ্বালাময়ী ভাষণ সোশ্যাল সাইটে ঘোরে। তেমনই এক জলসার ভিডিওতে তৃণমূলের অভিনেত্রী সাংসদ সম্পর্কে আব্বাস সিদ্দিকি বলছেন, ‘মন্দিরেও যাব, মসজিদেও যাব, আমার ইচ্ছা। তোর বাপের সম্পত্তি নাকি? ইসলাম কারও বাবাশালী সম্পত্তি নয়। ভালো না লাগে বেরিয়ে যা। ঘোষ হয়ে যা, দুলে হয়ে যা। হিন্দু হয়ে যা, খ্রিস্টান হয়ে যা। আমরা কোনও আপত্তি করব না। ইসলামকে নিয়ে নাটক করবি না। আব্বাস সিদ্দিকি যদি কোনও দিন পাওয়ারে আসে তোদের রাস্তায় গাছে বেঁধে পিটবে।’
এরপরেও সিপিএম নেতাদের চোখে আব্বাস সিদ্দিকির নেতৃত্বাধীন দল সেকুলার! জানতে ইচ্ছা করছে, সিপিএম নেতারা কি নিজেদের ‘গঙ্গাজল’ ভাবেন? নাকি তাঁরাও বিজেপির দুর্নীতি পরিষ্কারের ‘ওয়াশিং মেশিন’ এর মতো ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ করার মেশিন বের করেছেন? তাঁদের সঙ্গে হাত মেলালেই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’? সেকুলার, সেকুলার বলে ঢাক পেটালেই ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া যায় না। আচারে-আচরণে, কাজে-কর্মে প্রমাণ হয়, কে ধর্মনিরপেক্ষ, আর কে সাম্প্রদায়িক।
সিপিএম মুখে বিজেপিকে যতই আক্রমণ করুক, এখনও তাদের মূল শত্রু সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার জ্বালা সেলিম সাহেবরা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। তাই তৃণমূলের সরকার গঠনের রাস্তায় কাঁটা ছড়িয়ে দিতে মরিয়া। সেই কারণে তাঁরা আব্বাস সিদ্দিকির হাত ধরছেন। মহাজোটপন্থী নেতারা ভাবছেন, মুসলিম ভোটের কিছুটা কব্জা করতে পারলেই তৃণমূলের ‘ক্লিন স্যুইপ’ আটকে যাবে। আর কোনও রকমে ত্রিশঙ্কু হলে তো কথাই নেই। খুলে যাবে ‘নেপোর’ দই খাওয়ার দরজা।
যাঁকে সামনে রেখে দই খাওয়ার স্বপ্নে বিভোর ‘মহাজোটপন্থী’ সিপিএম নেতাদের আব্বাস সিদ্দিকির একটি ভিডিও দেখার জন্য অনুরোধ রইল। সেখানে আব্বাস সিদ্দিকি বলছেন, ‘আমি এই মুহূর্তে বাম-কংগ্রেসের সঙ্গে একুশের জন্য সিট সমঝোতা করতে চাইছি। শুধু মাত্র একুশের জন্য। একুশের পরে ওদেরও প্রতিশোধ নেব আমরা। কারণ ওরাও তো অনেক জ্বালিয়েছে। আমি একথা ওপেন বলছি ভাই। তাতে ওরা আসবে কি আসবে না, ওদের ব্যাপার।’
ডুবতে বসা মানুষ খড়কুটো আঁকড়ে ধরেও বাঁচতে চায়। সিপিএমও বাঁচতে চাইছে। কিন্তু লড়াইয়ের ধকল নিতে চাইছে না। তাই সহজ রাস্তার সন্ধান। সংখ্যালঘু ভোটের আশায় ‘ধর্মীয় নেতা’র হাত ধরতে চাইছে। বাঁচার চেষ্টা সবাই করে। আপনারাও করছেন। ভালো কথা। তবে, এরপর আর ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ আলখাল্লাটা গায়ে জড়াবেন না। দয়া করে আব্দুল্লাহ রসুল, মহবুব জাহেদি আর আব্বাস সিদ্দিকিকে এক করে ফেলবেন না।
সিপিএমের উদ্দেশ্য না হয় বোঝা গিয়েছে। কিন্তু, আব্বাস সিদ্দিকির দল গঠন নিয়ে দিলীপ ঘোষরা এত আগ্রহী কেন?
‘রথযাত্রা’ ফ্লপ। সিবিআইও তেমন মাইলেজ দিতে পারছে না। তূণ থেকে একের পর এক তির বেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু প্রতিপক্ষ ঘায়েল হচ্ছে না। সামনে রয়েছে বিহারের উদাহরণ। মিম এর সৌজন্যে ক্ষমতা দখল। তাই জোট বাঁধো, তৈরি হও। কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপির পথ ভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য এক। মমতাকে ঠেকানো। কথায় আছে, ‘সবে মিলে করি কাজ/হারি জিতি নাহি লাজ।’ অতএব ‘রামধনু জোট’। তবে, সবটাই ঘোমটার আড়ালে।