উচ্চতর বিদ্যায় সফলতা আসবে। সরকারি ক্ষেত্রে কর্মলাভের সম্ভাবনা। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে মানসিক অস্থিরতা ... বিশদ
নির্বাচনটাকে আমি ‘অনেকাংশে অবাধ ও নিরপেক্ষ’ বলেছি। কারণ, গোড়ার দিকের ভোট প্রক্রিয়ায় ছন্দপতন ঘটানোর কিছু অপচেষ্টা হয়েছিল। প্রথম দিকের কিছু ভোট (ড্রাইভ-ইন ভোটিং) গণনা না-করার আর্জি জানিয়ে মামলা করা হয়। গণনায় রাশ টানার জন্য আদালত এই ধরনের কিছু মামলা গ্রহণও করেছে। এবং, শেষকালে ‘ট্রাম্প ক্যাম্পেন’ মরিয়া হয়ে তিনটি রাজ্যের বিরুদ্ধে মামলা করে বসেছে।
একটি অ্যাজেন্ডা পূরণ
মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং কংগ্রেসের নির্বাচন এমন একটা বিষয় যাতে সারা দুনিয়া মজে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, সামরিক এবং প্রযুক্তির মিলিত শক্তিই এর কারণ। ইউএস হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভরা (৪৩৫ জন) দু’বছর অন্তর নতুন করে নির্বাচিত হন এবং আর্থিক ক্ষমতাটা থাকে তাঁদেরই হাতে। সিনেটের এক তৃতীয়াংশ (১০০ জন) নির্বাচিত হন প্রতি দু’বছর অন্তর এবং তাঁরাও বিরাট ক্ষমতা ভোগ করেন। ফেডারেল মিনিস্টার এবং সুপ্রিম কোর্টের জাস্টিস নিয়োগের মতো জটিল ব্যাপারে তাঁরা ‘পরামর্শ ও সম্মতি’ দেওয়ার অধিকারী। সুতরাং মার্কিন তরির গতিপথ প্রতি দু’বছর এবং চার বছর অন্তর নাটকীয়ভাবে বদলে যেতে পারে। মার্কিন নির্বাচন নিয়ে বিশ্বব্যাপী মানুষের এত যে কৌতূহল ও আগ্রহ সেটা এইজন্যই।
অবশ্য কোনও গ্যারান্টি দেওয়া যাবে না যে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত বিডেন সাহেব তাঁর অ্যাজেন্ডা মাফিক সব কাজ করে ফেলবেন। শুধু সঙ্কটজনক ইস্যুগুলোর কথা ভাবুন: দুর্বার গতির মহামারী, হেলথ কেয়ার অ্যান্ড অ্যাফোর্ডেবল কেয়ার অ্যাক্ট, ইমিগ্রেশন, জাতি ও লিঙ্গ ভিত্তিক সমতা, গর্ভপাত, বেড়ে চলা অর্থনৈতিক বৈষম্য, সহযোগীদের সঙ্গে সন্ধি, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্করক্ষা, বাণিজ্য চুক্তি, বিদেশি শিল্প-বাণিজ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতার ব্যাপারে সংরক্ষণ নীতি বনাম বিশ্ব বাণিজ্য, চীনের আগ্রাসী সম্প্রসারণ নীতি প্রভৃতি। ‘পপুলার ভোট’(একজন প্রার্থীর পক্ষে সারা দেশে যত ভোট পড়ে)-এর ভিত্তিতে বলা যায় যে, মার্কিন নির্বাচকমণ্ডলী বা ভোটারদের প্রায় অর্ধেক একটা পক্ষ হয়ে বেড়ার একদিকে থাকেন এবং বাকিরা থাকেন তার উল্টো দিকে। যেহেতু সিনেটের নিয়ন্ত্রণ রিপাবলিকানদের হাতে এবং ডেমোক্র্যাটরা হাউসকে নিয়ন্ত্রণ করেন, তাই এবার দু’পক্ষের বিরোধটা তীব্রতর হবে।
দ্বৈত ব্যবস্থা আর নেই
রাজৈনতিক ব্যবস্থাটাই কারণ। ভয়ের ব্যাপার এই যে, একটা দেশ লিবারাল বা উদার থাকবে, নাকি দক্ষিণপন্থার দিকে ঝুঁকবে সেটা একটা প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনের উপর নির্ভর করে। ২০১৬ সাল থেকে অনেক বেশি দেশ দক্ষিণপন্থার দিকে ঢলে পড়েছে। আমাদের পড়শি দেশগুলোর মধ্যেই এর অনেক উদাহরণ রয়েছে—ভারত, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইন্স। একজন প্রধানমন্ত্রী (সংসদীয় ব্যবস্থায়) এবং একজন রাষ্ট্রপতির (রাষ্ট্রপতি-প্রধান ব্যবস্থায়) ক্ষমতার মধ্যে ফারাক বিস্তর। খানিকটা ‘চক’ আর ‘চিজ’-এর মধ্যে যে পার্থক্য। এই তফাতটা কিন্তু মুছে যাচ্ছে। অনেক ‘চক’ এখন ঐতিহ্যবাহী ‘চিজ’ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। সংবিধান সংশোধন করে তারা এটা করছে, যেমনটা হয়েছে শ্রীলঙ্কায় কিংবা ভারতের দিকে খেয়াল করুন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরকে বিরাট ক্ষমতাধর করে নেওয়া হচ্ছে। একজন প্রধানমন্ত্রী যখন মার্কিন প্রেসিডেন্টের মতো ক্ষমতা ভোগ করেন তখন তিনি বিপুল ক্ষমতাধর—তাঁর হাতে থাকে ঋণ করার ক্ষমতা, ব্যয় করার ক্ষমতা, আন্তর্জাতিক চুক্তি করার অথবা চুক্তি ভেঙে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা, বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা এবং যুদ্ধ ঘোষণার ক্ষমতাও। প্রকৃত সংসদীয় ব্যবস্থায় একজন প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রিসভার দ্বারা সুরক্ষিত থাকেন এবং ‘এগজিকিউটিভ পাওয়ার’ বলতে যা বোঝায় সেসব গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের সঙ্গে তিনি শেয়ার করেন। আইনানুসারে তিনি সংসদ অথবা সংসদীয় কমিটিগুলোর কাছে দায়বদ্ধ এবং প্রতিটা ব্যয়ের জন্য তাঁকে সংসদের অনুমোদন নিতে হয়।
গোপনে বদল
অবাক হওয়ার কিছু নেই, উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রধানমন্ত্রীরা ‘প্রকারান্তরে’ রাষ্ট্রপতি (ডি ফ্যাকটো প্রেসিডেন্ট) হতে চান। যদি কোনও প্রধানমন্ত্রী সংবিধান সংশোধন করে সেটা হতে না-পারেন তবে তিনি সেটা করেন গোপনে, পরিণামে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গোল্লায় চলে যায়। আর তিনি যদি ওইসঙ্গে তাঁর দলের অপ্রতিরোধ্য নেতা হয়ে থাকেন, তবে ‘ডি ফ্যাকটো প্রেসিডেন্ট’ হয়ে ওঠার পূর্ববর্তী সময়টা তিনি নির্ঝঞ্ঝাটেই পার করে দিতে পারেন। একমাত্র ভরসা হল প্রধানমন্ত্রীর গরিষ্ঠতার বহর এবং গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর মনোবৃত্তি। সংসদে বিপুল গরিষ্ঠতা এবং গণতন্ত্রের প্রতি কম আগ্রহ, একজন প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রপতির মতো শাসনকার্য পরিচালনায় প্ররোচিত করে।
দুর্ভাগ্য এই যে, জনসাধারণের ভিতর কিছু শ্রেণী, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ধনী এলিট এবং মতাদর্শের দ্বারা পরিচালিত লোকজন, মনে হয়, তারা একজন একনায়ককেই চায়, ক্ষমতার অপব্যবহার ঠেকাতে প্রকৃত গণতন্ত্রের যে জটিল ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালান্স’ ব্যবস্থা, সেটা তাদের পছন্দের নয়।
শ্রদ্ধা করার মতো কিছু ব্যতিক্রম আছেন। তাঁদের বাদ দিলে বিশ্বজুড়ে নির্বাচিত নেতাদের মধ্যে একনায়ক হওয়ার ঝোঁকটাই প্রকট হচ্ছে। প্রচলিত প্রতিষ্ঠানগুলো এবং গণতন্ত্রের কৌশলগুলোকে তাদের জায়গায় রেখে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ঘুরপথে সেগুলোর ভিতরটা ফাঁপা করে দেওয়া হচ্ছে—অফিসগুলোতে গোমস্তা শ্রেণীর লোকজন বসিয়ে দিয়ে, দুর্বল অথবা সীমিত ক্ষমতার আইন প্রণয়ন করে, টাকাকড়ি না দিয়ে, আমলাতান্ত্রিক বাধাদান করে অথবা ভয় দেখিয়ে। ভারতের ক্ষেত্রে শূন্যগর্ভ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নির্বাচন কমিশন, তথ্য কমিশন, অর্থ কমিশন এবং মানবাধিকার, নারী, শিশু, এসসি, এসটি, সংখ্যালঘু, সংবাদ মাধ্যম বা প্রেস প্রভৃতির জন্য যে জাতীয় কমিশনগুলো রয়েছে। বিরোধীদের সঙ্গে পরামর্শ করার যে আইনি বাধ্যবাধকতা সেটা শব্দজব্দে পরিণত করা হয়েছে।
রাজ্যগুলোর আর্থিক প্রাপ্য নস্যাৎ করে, অথবা জাতীয় সংসদে পুরনো আইন বাতিল করে, একটা ফেডারেল ব্যবস্থায় ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ বাড়িয়ে নেওয়া হয়—সংসদীয় ক্ষমতার বণ্টন ব্যবস্থাটা রসাতলে চলে যায়।
পৃথিবীর গুটি কয়েক দেশে প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকার রয়েছে। আমার হিসেবে এই দেশগুলো হল—যুক্তরাজ্য (ইউকে), কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড, জাপান, সুইজারল্যান্ড, কয়েকটি খারাপ ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলো, এবং হতে পারে অন্যত্র আরও দু’-চারটে দেশ আছে। তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশের যে বিশাল সংখ্যাটা, সেগুলো চরিত্রগতভাবে আদৌ গণতান্ত্রিক নয়—সবচেয়ে পুরনো গণতন্ত্র যেভাবে গঠিত হয়েছিল সেই বিচারে। ভাগ্যের এমনই পরিহাস প্রাচীনতম গণতন্ত্র নিজেও তাই! যাই হোক, অন্যসব দেশের দিকে আঙুল তোলার আগে বৃহত্তম গণতন্ত্রের নিজের যোগ্যতা পুনরায় যাচাই করে দেখার সময় হয়েছে।