উচ্চতর বিদ্যায় সফলতা আসবে। সরকারি ক্ষেত্রে কর্মলাভের সম্ভাবনা। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে মানসিক অস্থিরতা ... বিশদ
ভোট সর্বস্ব রাজনীতিতে শিবির বদল বা ডিগবাজি নতুন নয়। রাজনীতির কারবারিরা শিবির বদল করেন বলেই পাল্টে যায় জোট রাজনীতির সমীকরণ। বদলায় ক্ষমতা। তবে গুরুংয়ের শিবির বদল তা থেকে কিছুটা ভিন্ন। আপাতদৃষ্টিতে গুরুং শিবির বদল করেছেন বলে মনে হলেও বাস্তবটা হল, তিনি আত্মসমর্পণ করেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসনিক কৌশলের কাছে তিনি মাথা ঝোঁকাতে বাধ্য হয়েছেন। তাই তিনি বিজেপির বিরুদ্ধে বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ তুলে তৃণমূল নেত্রীর বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা করছেন।
বিজেপির ছত্রচ্ছায়ায় থেকে টানা তিন বছর গুরুং রাজ্য সরকার এবং তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছেন। ভেবেছিলেন, লোকসভা ভোটে বিজেপি প্রার্থীকে জেতালে এবং কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদি সরকার গড়লে পূরণ হবে গোর্খাল্যান্ডের দাবি। কিন্তু সরকার গঠনের পর বছর ঘুরলেও গোর্খাল্যান্ড নিয়ে তিনি একচুলও এগতে পারেননি। উল্টে তাঁকে লুকিয়ে থাকতে হয়েছে। সেই সুযোগে একদা তাঁরই ঘনিষ্ঠ বিনয় তামাংকে সামনে রেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাহাড়ে গণতন্ত্রের ভিত মজবুত করছেন। রাস্তাঘাট, পানীয় জল, বিদ্যুৎ সমস্যা মিটিয়ে বিনয় তামাং ও অনীত থাপা হয়ে উঠছেন দক্ষ প্রশাসক। পাশাপাশি তাঁর ঘনিষ্ঠদেরও এক এক করে কাছে টেনে নিচ্ছেন। এই অবস্থা চলতে থাকলে তাঁর আমও যাবে, ছালাও যাবে। গোর্খাল্যান্ড তো হবেই না, পাহাড়ের দরজাও বন্ধ হয়ে যাবে। তাই একদা পাহাড়ের এই বেতাজ বাদশার সামনে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ছাড়া অন্য রাস্তা ছিল না। সম্ভবত দিল্লিতে বসেও তিনি টের পাচ্ছিলেন, বদলাচ্ছে বঙ্গের পরিস্থিতি।
তবে কেউ কেউ গুরুংয়ের এই আত্মসমর্পণের পিছনে বিজেপির সূক্ষ্ম প্যাঁচ আছে বলে মনে করছেন। তাঁদের বক্তব্য, বিমল গুরুংয়ের মাথায় ঝুলছে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা। তাই বিধানসভা নির্বাচনে তাঁর পক্ষে পাহাড়ে দাঁড়িয়ে ভোট করানো সম্ভব হতো না। তার উপর বিজেপির হয়ে ভোট চাইতে গেলে গোর্খাল্যান্ড ইস্যুতে নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হতো। কিন্তু সন্তোষজনক উত্তর নেই। উল্টোদিকে বিনয় তামাং ক্ষমতার সুবাদে প্রভাব বিস্তার করেছেন। এই পরিস্থিতিতে গুরুং তৃণমূলের ঝান্ডা নিয়ে পাহাড়ে উঠলে বিনয়-বিমল সংঘাত অনিবার্য। সেই সুযোগে জিএনএলএফকে সামনে রেখে ফায়দা তুলবে বিজেপি। কারণ জিএনএলএফের সঙ্গে গেরুয়া শিবিরের এখনও সুসম্পর্ক আছে। তবে গুরুংকে তৃণমূল কীভাবে কাজে লাগাবে, তার উপরেই নির্ভর করবে বিজেপি আদৌ বেনিফিট পাবে কি না!
বিমল গুরুংয়ের বিজেপি সঙ্গ ছাড়ার সিদ্ধান্তকে তৃণমূল সমর্থন করেছে। বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের পাশে থাকার ঘোষণাকেও স্বাগত জানিয়েছে শাসক দল। কিন্তু প্রতিক্রিয়ায় সংযমের ছাপ স্পষ্ট। বিমল বিজেপির হাত ছাড়ায় উত্তরবঙ্গের ১০/১২টি আসনে শাসক দলের সুবিধা হতে পারে। তা সত্ত্বেও তৃণমূল নেতৃত্ব উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেনি। সবচেয়ে বড় কথা, তৃণমূল সুপ্রিমো একেবারে ‘স্পিকটি নট’। অনেকেই মনে করছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্ভবত ‘ধীরে চলো’ নীতি নিয়ে জল মাপতে চাইছেন। তবে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলাই যে তাঁর লক্ষ্য, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
রাজনীতিতে উপরে ওঠার সিঁড়িটির নাম হল কৌশল। আর তা নির্ধারিত হয় অনুমান এবং অঙ্কের ভিত্তিতে। কৌশল ঠিকঠাক কাজ করলে সেটাই হয়ে যায় রাজনীতির মাস্টার স্ট্রোক। আর ভুল হলেই ব্যুমেরাং। তখন সেই অস্ত্রে সে নিজেই ঘায়েল হয়।
লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদি শিলিগুড়ির জনসভায় গোর্খাদের দাবি বিবেচনার আশ্বাস দিয়ে বিমল গুরুং সহ নেপালি ভোটের বৃহৎ অংশ কব্জা করেছিলেন। তখন সেটা ছিল বিজেপির মাস্টার স্ট্রোক। এখন সেই বিমল গুরুংই গেরুয়া শিবিরের কাছে ব্যুমেরাং। কারণ গুরুং শুধু মমতায় আস্থা রাখেননি। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘বিজেপির সঙ্গে তাঁর আর কোনও সম্পর্ক নেই। পাহাড়ের উন্নতির জন্য নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহরা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা পালন করেননি। একমাত্র মমতাই কথা রেখেছেন।’ এখানে বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ শব্দটি হল, ‘পাহাড়ের উন্নতির জন্য’। পাহাড়ের খবর যাঁরা রাখেন তাঁরা জানেন, গোর্খাদের জাত্যভিমান প্রবল। তাকে কাজে লাগিয়েই সুবাস ঘিসিং আশির দশকের গোড়ায় দার্জিলিং পাহাড়ে হিংসাত্মক আন্দোলন শুরু করেছিলেন। প্রথমে তাঁর দাবি ছিল পৃথক দেশের। তারপর পৃথক রাজ্য। তিনি পাহাড়বাসীকে বুঝিয়েছিলেন, তাঁরা বঞ্চিত ও উপেক্ষিত। একমাত্র পৃথক রাজ্যই পাহাড়ের মানুষের দুঃখ, দুর্দশা দূর করতে পারে। পবরর্তীকালে সেই দাবি থেকে সরে তিনি গোর্খা পার্বত্য পরিষদ নিয়েই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। পাহাড়ের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভোগের সেটাই শুরু। তারপর যখনই রাজ্য সরকার হিসেব চেয়েছে তখনই ঘিসিং পৃথক রাজ্যের দাবিতে হুঙ্কার ছেড়েছেন। আর বাম সরকার কঠোর পদক্ষেপের বদলে তাঁর দেওয়া শর্ত মেনে সমঝোতা করেছে। সেটা ছিল বামেদের কৌশল। পাহাড় তোমার, সমতল আমার। সেই কৌশলেই ঘিসিং দু’দশকেরও বেশি সময় পাহাড় কব্জায় রেখেছিলেন।
পৃথক রাজ্যের দাবি থেকে সরে গিয়েছিলেন ঘিসিং। উল্টে দার্জিলিংকে তিনি ষষ্ঠ তফসিলির অন্তর্ভুক্ত করে আরও বেশি ক্ষমতা ও আর্থিক সুযোগ সুবিধা লাভের চেষ্টা করেছিলেন। পাহাড়বাসী বুঝেছিল, গোর্খাল্যান্ডের ‘গাজর’ ঝুলিয়ে ক্ষমতা ভোগই ঘিসিংয়ের উদ্দেশ্য। তা নিয়ে পাহাড়ের মানুষের দিন দিন ক্ষোভ বাড়ছিল। আর তারই সুযোগ নিয়েছিলেন বিমল গুরুং।
ইন্ডিয়ান আইডল গানের প্রতিযোগিতায় প্রশান্ত তামাংয়ের হয়ে ভোট করিয়ে তাঁকে চ্যাম্পিয়ন বানানোর নেপথ্য কারিগর ছিলেন এই বিমলই। প্রশান্ত চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। কিন্তু গোর্খাদের কাছে হিরোর মর্যাদা পেয়েছিলেন বিমল। তাকে হাতিয়ার করেই ধুরন্ধর বিমল ‘পাহাড়ো কা রাজা’ সুবাস ঘিসিংকে পাহাড় ছাড়া করেছিলেন। দিল্লি থেকে ফেরার পথেই তাঁকে আটকে দিয়েছিলেন গুরুং।
২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাহাড়ের অধীশ্বর ছিলেন বিমল গুরুং। জিটিএ-র প্রধানের কুর্সি দখল করে তিনিও ভুলেছিলেন পাহাড়বাসীকে দেওয়া পৃথক রাজ্য আদায়ের প্রতিশ্রুতি। ক্ষমতা ভোগই হয়ে উঠেছিল তাঁর লক্ষ্য। তাঁর বিরুদ্ধেও উন্নয়নের টাকা নয়ছয়, স্বজনপোষণের গুচ্ছ গুচ্ছ অভিযোগ নবান্নে জমা পড়তে থাকে। তা নিয়ে সরকার নাড়াচাড়া করতেই বিমল প্রমাদ গোনেন। তিনিও ঘিসিংয়ের জুতোয় পা গলিয়ে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দাগতে শুরু করেন। কিন্তু পাহাড়বাসীকে খেপানোর মতো জুতসই ইস্যু পাচ্ছিলেন না। সমস্ত স্কুলে বাংলা ভাষা শিক্ষার নির্দেশিকাকে হাতিয়ার করেই গুরুং ‘বঙ্গাল সরকারে’র বিরুদ্ধে ঘোষণা করেছিলেন জেহাদ।
দিনটা ছিল ২০১৭ সালের ৮ জুন। দার্জিলিংয়ের গোর্খা রঙ্গমঞ্চ ভবনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে বসেছিল ক্যাবিনেট মিটিং। গুরুং মিছিল নিয়ে সেদিকে এগতেই পুলিসের সঙ্গে সংঘর্ষ। অগ্নিগর্ভ হয়েছিল পাহাড়। প্রতিবাদে ৭২ ঘণ্টা পাহাড় বন্ধের ডাক। একেবারে ঘিসিংয়ের স্ট্র্যাটেজি। কিন্তু কৌশল কাজ করেনি। কারণ প্রতিপক্ষের নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা ও ইস্পাত কঠিন মানসিকতার সামনে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলেন বিমল গুরুং।
‘বঙ্গাল হামরো চিয়ান হো’। এর অর্থ, বাংলা আমাদের বদ্ধভূমি। এটাই ছিল বিমল গুরুংয়ের প্রিয়তম স্লোগান। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সেই প্রাক্তন সুপ্রিমোর আস্থা এখন মোদিতে নয়, মমতায়। এর ফায়দা ভোটে তৃণমূল কতটা পাবে, তা বলবে সময়। তবে একথা নিশ্চিত, ডাকাবুকো গুরুংয়ের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে পাহাড়ের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হল। ইতিহাস বলছে, চার দশক ধরে পাহাড় হুঙ্কার ছেড়েছে, আর সমতল সমঝোতার রাস্তার খুঁজেছে। কিন্তু, মমতার স্ট্র্যাটেজি ও প্রশাসনিক দৃঢ়তার ঘটল ঠিক উল্টোটা। সমতলের সামনে মাথা ঝোঁকাল পাহাড়ের ‘ব্ল্যাকমেলিং পলিটিক্স’। আর সেটা এই প্রথমবার।