উচ্চতর বিদ্যায় সফলতা আসবে। সরকারি ক্ষেত্রে কর্মলাভের সম্ভাবনা। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে মানসিক অস্থিরতা ... বিশদ
এও এক অক্টোবর। ঠিক তিন বছর পর। কলকাতায় পা রাখলেন বিমল গুরুং। রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা কাঁধে নিয়ে। দাবি করলেন, নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ কথা রাখেননি। কাজেই উন্নয়নের স্বার্থে সমর্থন করতেই হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ছবিটা জলের মতো পরিষ্কার... অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। আর যাই হোক, সুবাস ঘিসিং হতে চান না তিনি।
বাঙালির সেন্টিমেন্টের আর এক নাম দার্জিলিং... চিরকাল। ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি শুরু হয়েছিল এখান থেকে। কচি সংসদের অতি নাটুকে কেষ্টর পরিণয় এই দার্জিলিংয়েই পরিণতি পেয়েছিল। কিংবা মংপুর রবীন্দ্রনাথ...। বাঙালির চরিত্রগুলো এই দার্জিলিংয়ের সঙ্গেই বারবার মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছে। একটু ছুটি, আর একটু সুযোগ মিললেই গন্তব্য দার্জিলিং। তাই পর্যটনই পাহাড়ের বেঁচে থাকার চিরন্তন রসদ। আর চা বাগান...। চার দশক আগে ফিরে গেলেও তো দার্জিলিংয়ের হাওয়ায় এমন আগুনের আঁচ ছিল না। যা শুরু হল সিপিএমের আমরা-ওরা রাজনীতি এবং সুবাস ঘিসিংয়ের ‘একনায়কত্ব’ থেকে। আটের দশক থেকে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন এবং পাহাড়ের নেতৃত্ব দখলের লড়াই বারবার উত্তপ্ত করেছে বাংলার মুকুটকে। যার অন্যতম অস্ত্র হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক হত্যা। পাহাড়ে ৩০০’র বেশি রাজনৈতিক খুন হয়েছে গত কয়েক দশকে। ঘিসিংয়ের ঘনিষ্ঠ ছিলেন সি কে প্রধান। কিন্তু তিনিই একটা সময় ঘিসিংয়ের সঙ্গে মত মেলাতে পারলেন না। দল ছেড়ে বেরিয়ে গড়লেন জিএনএলএফ(সি)। খুব বেশিদিন নয়। কালিম্পংয়ে খুন হতে হল তাঁকে। এমন একের পর এক নাম ভেসে আসে পাহাড়ে... রুদ্র প্রধান, মদন তামাং, কিরণ ঠাকুরি। এক একটা রক্তঝরা সকাল পরবর্তী বেশ কয়েক মাসের জন্য দার্জিলিংকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে পর্যটন দুনিয়া থেকে। আর পেটে টান পড়েছে সেই মানুষগুলোর... যাদের রাজনীতির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। পর্যটক পাহাড়ে এলে যারা একটু সুখের মুখ দেখে। পাহাড়ের রাজনীতির কারবারিরা তাদের এই ‘পাওয়া না পাওয়া’র সুযোগ নিয়েছে ক্ষমতার স্বার্থে। তারপর ভুলে গিয়েছে... রাজনীতির চেনা ছকেই। এর মধ্যে বিলক্ষণ রয়েছে বামফ্রন্টও। জ্যোতি বসু এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য... হাতে গুনে বলে দেওয়া যায়, এই দুই মুখ্যমন্ত্রী ঠিক কতবার পাহাড়ে পা রেখেছিলেন। বামফ্রন্টের যা হাঁকডাক ছিল, তার সবটাই সমতল থেকে। পাহাড়ের মানুষকে সমতলের সঙ্গে একাত্ম করে নেওয়ার চেষ্টাটাই কখনও করেননি তাঁরা। সব সময় দূরে ঠেলে রেখেছেন দুয়োরানির মতো। এমনকী ২০০৭ সালের ঘিসিং বনাম গুরুংয়ের মধ্যবর্তী টেনশনের আবহে পাহাড়ের রাজনৈতিক কর্মসূচি পর্যন্ত বাতিল করেছিল সিপিএম। জেলা সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল দার্জিলিংয়ের জিমখানা ক্লাবে। প্রধান বক্তা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সেই কর্মসূচি সরিয়ে আনা হয়েছিল শিলিগুড়ির বাঘাযতীন পার্কে। অজুহাত কী ছিল? গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা এবং অখিল ভারতীয় গোর্খা লিগের যৌথভাবে ডাকা ৯৬ ঘণ্টার বন্ধ। কর্মসূচি পিছনো যেত! আলোচনায় বসে সমাধানসূত্র বের করার চেষ্টা করলেও চলত। কিন্তু না... পরিবর্তিত গন্তব্য শিলিগুড়ি। সেখান থেকেই গুরুংয়ের মাথা গুঁড়িয়ে দেওয়ার হুঙ্কার ছেড়েছিলেন বুদ্ধদেববাবু। কিন্তু উত্তেজনা প্রশমনের জন্য সামনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দেওয়া? পাহাড়ের জন্য ওসব ধাতে সয়নি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর। শুধু তিনি নন, তাঁর পূর্বসূরি কেউই সেই পথে হাঁটেননি। কংগ্রেস সরকারও না। তাই স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরও পানীয় জল আর নিকাশির পাকাপাকি ব্যবস্থা নেই পাহাড়ে। বিমল গুরুংও কিন্তু বেশ কয়েক বছর সুযোগ পেয়েছিলেন। কাজে লাগিয়েছেন কি?
গুরুংয়ের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা, আর মদন তামাংয়ের অখিল ভারতীয় গোর্খা লিগ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল ২০০৬ সাল থেকে। তখনই ঘিসিং যুগের পতন শুরু। ২০০৭ সালের ২১ মে পাহাড় ছেড়েছিলেন জিএনএলএফের একদা দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রধান। আর ফিরে যেতে পারেননি...। সেই সুবাস ঘিসিংয়ের জুতোয় পা গলিয়ে দার্জিলিংয়ের শাহেনশা হয়ে বসেছিলেন গুরুং। এই আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতা কারা করেছে? দার্জিলিং সংক্রান্ত একটি বিশেষ ফেসবুক পেজ ঘুরে দেখলে বেশ কয়েকটা নাম সেখানে পাওয়া যায়। বাংলার স্বপক্ষে বা গোর্খাল্যান্ড বিরোধী একটা শব্দ উচ্চারণ করলেই যাঁরা হাঁ হাঁ করে ওঠেন। শুরু করেন তীব্র আক্রমণ। প্রোফাইলে ক্লিক করলে দেখা যায়, তাঁদের কেউ দুবাই নিবাসী, কেউ কুয়েত। অর্থাৎ পাহাড় তো নয়ই, দেশেও তাঁদের বসবাস নেই। অর্থ এবং রাজ্য ভাগের ভাবধারার জোগানের বেশিরভাগটাই দেশের বাইরে থেকে আসে বলে অভিযোগ। পৃষ্ঠপোষক অবশ্য আরও আছে... তাঁরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিমল গুরুংয়ের মতো নেতারা তাই পৃথক রাজ্যের পক্ষে। মানুষের নয়... পর্যটন ব্যবসারও নয়।
হাওয়া বদলেছে... ধীরে ধীরে। ক্ষমতার শিখরে ওঠা, আর সেখান থেকে ফেরার এক ‘অপরাধী’র তকমা নিয়ে গা ঢাকা দিয়ে বেড়ানো। তিনটে বছর কম সময় নয়! আজও কি পাহাড়ে তাঁর সেই দাপট বজায় আছে? প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ বা না-তে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, তিনি পাহাড়ে নেই। রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্রে থাকা, আর না থাকার মধ্যে যে বিস্তর ফারাক! তাই এই মুহূর্তে তাঁর জনপ্রিয়তা আদৌ কতটা রাজনৈতিক প্রভাব ফেলবে, তার জন্য প্রয়োজন আরও একটা লিটমাস টেস্ট। গুরুং জননেতা। কিছু মানুষের সমর্থন তিনি পাবেন। কিন্তু আপাতত যা আভাস মিলছে, পাহাড়ের বুদ্ধিজীবী মহল গুরুংয়ের পাশে আর নেই। তাঁরা এই মুহূর্তে অনেকটাই বিনয়-অনীতের পক্ষে। কারণ আর কিছুই নয়... পাহাড়ের শান্তি। যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আনতে পেরেছেন। বেঁচে থাকতে গেলে শান্তি দরকার সবার আগে... এই কঠিন সত্যটা হাড়ে হাড়ে জানে পাহাড়বাসী। তাই আর যাই হোক, বিমল গুরুংকে দার্জিলিংয়ের একটা বড় অংশই পাহাড়ের মাটিতে চাইছে না। সেই দাবিতে চলছে মিছিল... বিক্ষোভ। হয়তো রয়েছে কোনও উস্কানি...। হয়তো নয়। উত্তর এখনও অজানা। কিন্তু একটা বিষয় স্পষ্ট, এ এক কঠিন সন্ধিক্ষণ—পাহাড়ের... গুরুংয়েরও। এই টানাপোড়েনের মধ্যে বিমল গুরুং যদি সত্যিই পাহাড়ে আর পা দিতে না পারেন?
বিধানসভা ভোট আসন্ন। এমন অবস্থায় পাহাড়ের দরজা তাঁর জন্য বন্ধ থেকে গেলে আচমকাই এক চেনা পরিণতির দিকে এগিয়ে যাবেন গুরুং... যা হয়েছিল সুবাস ঘিসিংয়ের। কাজেই ওষুধ একটাই—‘আত্মসমর্পণ’। পাহাড়ের উন্নয়নের স্বার্থে সমর্থন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। অথচ ২০১৭ সালের জুন মাসে এই মমতার বিরুদ্ধেই রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন বিমল। লক্ষ্য সেই গোর্খাল্যান্ড ইস্যু। বাংলা থেকে ছিন্ন করে দেওয়া বঙ্গের মুকুটকে...।
পর্যটন ব্যবসায়ী তথা হিমালয়ান হসপিটালিটি অ্যান্ড ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক সম্রাট সান্যাল বলছিলেন, ’১৭ সালের ওই গোলমালের আগে পর্যটন থেকে পাহাড়ের প্রতিদিনের টার্ন ওভার ছিল ১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে অবশ্য দার্জিলিংয়ের সঙ্গে ধরা হয় সিকিমকেও। মদন তামাং হত্যার পর টানা ৩৫ দিন বন্ধ ছিল পাহাড়ে। পুরোটাই স্বতঃস্ফূর্ত। ওই সময়টায় চূড়ান্ত ধাক্কা খেয়েছিল পাহাড়ের পর্যটন ব্যবসা। তারপর ২০১৭। পর্যটকশূন্য হয়ে গিয়েছিল বাঙালির সাধের দার্জিলিং। সময় লেগেছে... কিন্তু তারপরও ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ব্যবসা। করোনা পর্বের আগের হিসেব বলছে, পর্যটন ব্যবসার দৈনিক টার্ন ওভার দাঁড়িয়েছিল ২১ কোটি টাকায়। লকডাউন অর্থনীতির সেই উড়ান মাটিতে নামিয়ে এনেছে। আনলক পর্বে একটু একটু করে আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে পাহাড় অর্থনীতি। নানা বিধিনিষেধ এখন... সেই সব মেনেই খুলেছে হোটেল, পর্যটন কেন্দ্র। যে গাড়িতে চারজন ট্যুরিস্ট যেতে পারতেন, সেখানে এখন দু’জনের আয়োজন। মানতেই হবে। বেঁচে থাকার স্বার্থে। সদ্য পেরিয়ে আসা পুজোতেও পর্যটকরা ভিড় করেছিলেন পাহাড়ে। পুজোর চারদিন দার্জিলিংয়ে ভালোই ট্যুরিস্ট জমায়েত হয়েছিল। যদিও তার আগে পিছে ভিড়টা দেখা গিয়েছে একটু বিচ্ছিন্ন স্পটে... সিটং, লামাহাটা বা মংপু। তখন থেকেই আবার সামান্য আশার আলো দেখা যাচ্ছে। দীপাবলি এবং বিশেষ করে বড়দিনের ছুটির জন্য প্রচুর বুকিং হচ্ছে। এর মধ্যেও আরও একবার প্রশ্নচিহ্ন ঝুলিয়ে দিয়েছে সেই বিমল গুরুং ফ্যাক্টর। গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার একদা শাহেনশা পাহাড়ে ফিরলে আবার কি বিগড়ে যাবে পরিস্থিতি? ফের অশান্তি... সঙ্কটের মেঘ ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। তাতে যদি পাহাড়ের হাসি ম্লান হয়, তার দায় কিন্তু নিতে হবে রাজনীতিকেই।