উচ্চতর বিদ্যায় সফলতা আসবে। সরকারি ক্ষেত্রে কর্মলাভের সম্ভাবনা। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে মানসিক অস্থিরতা ... বিশদ
মে মাসেই এই অ্যাপ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। তিনি বলেছিলেন, এই অ্যাপের মাধ্যমে মানুষের উপর অত্যন্ত আধুনিক পদ্ধতিতে নজরদারি চালানো হচ্ছে। তিনি বলেছিলেন, এই অ্যাপ ব্যবহার করলে মানুষের তথ্যের গোপনীয়তা সুরক্ষিত থাকবে না। এই অ্যাপও সুরক্ষিত নয়। এখান থেকে মানুষের গোপন তথ্য চুরি যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। প্রাইভেট কোম্পানির মাধ্যমে এই অ্যাপের কাজ করানো হয়েছে বলেও সেদিন তিনি দাবি করেছিলেন। রাহুল গান্ধীর কণ্ঠস্বরের উপর গলা চড়িয়ে সেদিন কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রযুক্তিমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেছিলেন, রাহুলজি মিথ্যা অভিযোগ আনছেন, এটা সম্পূর্ণভাবেই সরকারের তৈরি অ্যাপ। মন্ত্রী নিজে যখন বলছেন, তখন বিরোধীদের অভিযোগ তো উড়ে যাবেই। শুধু রাহুলজিই নন, অ্যাপটি চালু হওয়ার কিছুদিন পরই ফ্রান্সের একজন নামকরা এথিক্যাল হ্যাকার রবার্ট ব্যাপটিস্ট দাবি করেছিলেন, এই অ্যাপটি সুরক্ষিত নয়। এই অ্যাপটির তথ্য নিরাপত্তা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন। বলেছিলেন, রাহুল গান্ধীর অভিযোগ সত্য। তিনি এটাও বলেছিলেন যে, কোন কোন ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত বা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের কোন কোন ব্যক্তি অসুস্থ, আমি তাঁদের নাম, ধাম সব বলে দিতে পারি। সরকার ইচ্ছে করলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। রবার্ট ব্যাপটিস্টের সেই অভিযোগও উড়িয়ে দিয়েছিল কেন্দ্র।
সৌরভ দাস একজন আরটিআই অ্যাক্টিভিস্ট। তিনি সরকারের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, এই আরোগ্য সেতু অ্যাপটি কে বানিয়েছে? সরকারের পক্ষ থেকে তাঁকে জানানো হয়, এই অ্যাপটি কে বানিয়েছে, আমরা তা জানি না। অত্যন্ত হাস্যকর এই উত্তর। সরকারের নিজস্ব অ্যাপ। সরকার যেখানে জোর করে মানুষকে এই অ্যাপ ডাউনলোড করতে বাধ্য করেছে, সব ব্যক্তিগত তথ্য জানাতে বাধ্য করেছে, তখন সরকার কিছুই জানে না? যে অ্যাপের মাধ্যমে সরকারের নজরদারিতে থাকছে দেশের মানুষের প্রতিটি গতিবিধি, অর্থাৎ তিনি কখন কোথায় যাচ্ছেন, কার সঙ্গে ঘুরছেন, তাঁর সম্পর্কিত সব তথ্য, তখনও সরকার কিছুই জানে না? তাঁর শারীরিক অবস্থার তথ্য যখন সরকারের ঘরে নথিভুক্ত, তখন সেই অ্যাপ নিয়ে সরকার কিছুই জানে না? সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই অ্যাপ! এখন সত্যিই কি আমাদের ভয় হচ্ছে না? এই অ্যাপের তথ্য কোথাও লিক হয়েছে কি না, আমরা জানি না! একে করোনার ভাইরাস থেকে কেউই সুরক্ষিত নন, তার উপর আর্থিকভাবে মানুষ যখন সম্পূর্ণ অসুরক্ষিত, তাঁর চাকরি সংক্রান্ত সুরক্ষা একটুও নেই, তাঁর খাদ্য সুরক্ষা নেই এবং একটা অসুরক্ষিত জীবনের প্যাঁচে ক্রমশই তিনি জড়িয়ে পড়ছেন, তখন কী আর তাঁর তথ্য সুরক্ষার অধিকার নিয়ে মাথা ঘামানোর সুযোগ থাকে?
সৌরভ দাসের প্রশ্ন এবং সরকারের উত্তরের পর এটা নিয়ে নানাদিক থেকে প্রশ্ন উঠতে শুরু করল। এতে বিপাকে পড়ে তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক তড়িঘড়ি জানিয়ে দিল, এটা কেন্দ্রীয় সরকার বানিয়েছে। এটা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ সরকারের নিজস্ব অ্যাপ, তৈরি করা হয়েছে বেসরকারি এক্সপার্টদের দিয়ে। এই প্রসঙ্গে রবিশঙ্কর প্রসাদ কী বলেছিলেন, একবার স্মরণ করা যেতে পারে। গত ২ মে তিনি বলেছিলেন, এই অ্যাপ কোনও বেসরকারি কোম্পানিকে আউসোর্সিং করে তৈরি হয়নি। রাহুলজি বাজে কথা বলছেন। একটি অ্যাপ ও একটি সরকার। কিন্তু আমরা পেলাম তিন রকমের বক্তব্য। সুতরাং স্বচ্ছতা নিয়ে যদি মানুষ প্রশ্ন তোলেন, সেটা কি খুব ভুল হবে?
প্রশান্ত সুগতন নামে এক আইনজীবীও দীর্ঘদিন আগে তথ্য চুরির আশঙ্কা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যেভাবে সরকার আধারকে বারবার বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা করেছে। তেমনই জোর করে আরোগ্য সেতু অ্যাপ নিয়ে করেছে। আধারের তথ্য তৃতীয় পক্ষের কাছে ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা আছে। আরোগ্য সেতু অ্যাপের ক্ষেত্রেও সেই ঘটনা ঘটতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি বি এন শ্রীকৃষ্ণও বলেছিলেন, সরকার এভাবে কোনও অ্যাপকে বাধ্যতামূলকভাবে মানুষের উপর চাপিয়ে দিতে পারে না। যদি সরকার জোর করে কোনও অ্যাপ দেশের মানুষকে ডাউনলোড করতে বাধ্য করে, তবে সেটা বেআইনি।
কিন্তু কে শোনে কার কথা! কোথাও কোথাও পুলিস তো এটাকে আইন হিসাবে ব্যবহার করেছে। কারও মোবাইলে আরোগ্য সেতু অ্যাপ না থাকলে, তাঁকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানাও করেছে। নয়ডা পুলিসের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছিল।
এই বছরের গোড়ার দিকে বাজারে এসেছিল ‘মিত্রোঁ’ নামে একটি অ্যাপ। মিত্রোঁ কথাটি শুনলেই তাঁর মুখটি ভালোমন্দ মিশিয়ে ভেসে ওঠে তামাম ভারতবাসীর চোখে। সেই সময় ভালো সাড়া ফেলেছিল অ্যাপটি। সেই অ্যাপটির নির্মাতারা এবার বাজারে নিয়ে এল ‘আত্মনির্ভর ভারত’ অ্যাপ। আত্মনির্ভর ভারত গড়ার ডাক দিয়েছিলেন মোদি। ভারত কতদিনে আত্মনির্ভর হতে পারবে, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু এই অ্যাপের জন্ম বুঝিয়ে দিল, চীনা অ্যাপকে সরিয়ে আমরা অ্যাপে ক্রমেই আত্মনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করছি। তবে জানি না, এগুলি কতটা সুরক্ষিত! এই অ্যাপগুলির অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে কি না!
ভাবুন একবার, দেশের মানুষ যখন অন্ধভাবে বিশ্বাস করলেন সরকারকে, তাঁদের সমস্ত তথ্য আপলোড করে তুলে দিলেন সরকারের হাতে, তখন তার সুরক্ষা নিয়ে সরকারের তেমন দায় সত্যিই কি নজরে পড়ল? পড়ল না। বারবার বিশ্বাসভঙ্গ হচ্ছে। দেশের মানুষ যখন কোনও সরকারকে জিতিয়ে ক্ষমতায় নিয়ে আসেন, তখন তাঁর মনে অনেক প্রত্যাশা থাকে। সরকারকে তিনি মনে করেন, অভিভাবকের মতো। সবসময়ে সুরক্ষা এবং সুশাসনের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষকে সরকার সুনিশ্চিত রাখবে। কিন্তু নানাভাবে সুরক্ষা সুনিশ্চিত থাকছে না। সুশাসনের তো প্রশ্নই নেই। এই সরকার প্রথম থেকেই নিজস্ব কিছু অ্যাজেন্ডা নিয়ে চলছে। যার মধ্যে অধিকাংশ দেশের মানুষের স্বার্থের পক্ষে হানিকর বলে একে একে প্রমাণিত হচ্ছে। সরকারের স্বচ্ছতাবোধ ও সুশাসন ছদ্ম-স্বৈরতন্ত্রের হাততালিতে হারিয়ে গিয়েছে।
সবথেকে বড় কথা হল, মোদি সরকার যতই আরোগ্য সেতু অ্যাপ আনুক না কেন, এই সরকার নিজেই আজ মানুষের কাছে এক দুরারোগ্য অ্যাপ। একদিন ভুল করে মানুষ এই অ্যাপ সরকারকে ডাউনলোড করে ফেলেছিল। এখন বুঝতে পারছে, এই অ্যাপ আদতে কোনও কাজের নয়। এই
অ্যাপ ব্যবহার করলে মানুষের জীবনে ভাইরাসের আক্রমণ দিনে দিনে বাড়তেই থাকবে। তাই
মানুষ সুযোগের অপেক্ষায় আছেন। যেদিন সুযোগ আসবে, সেদিনই মানুষ এই দুরারোগ্য অ্যাপকে আনইনস্টল করে দেবেন।