শরীর নিয়ে চিন্তায় থাকতে হবে। মাথা ও কোমরে সমস্যা হতে পারে। উপার্জন ভাগ্য শুভ নয়। ... বিশদ
খবরে প্রকাশ যে ইনফোসিসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তি বলেছেন, ‘আমরা ভগবানে বিশ্বাস করি। কিন্তু অন্য যে-কোনও জিনিসের জন্য আমি শুধু তথ্যের উপরেই ভরসা রাখি।’
অকাট্য তথ্য তথ্য কী বলে? তথ্য বলছে:
১. কৃষকদের ৮৬ শতাংশ ক্ষুদ্র এবং তাঁদের একেক জনের জোত আয়তনে ২ হেক্টরের চেয়ে ছোট।
২. কৃষি শুমারি থেকে জানা যায় যে কৃষি জোতগুলি (ফার্ম হোল্ডিং) আবার টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। ফার্ম হোল্ডিংয়ের সংখ্যা ২০১০-১১ সালে ছিল ১৩ কোটি ৮ ০ লক্ষ। ২০১৫-১৬ সেটা বেড়ে হয়েছে ১৪ কোটি ৬০ লক্ষ। অর্থাৎ কৃষি জোতগুলি টুকরো টুকরো হয়ে আকারে ক্রমশ ছোট থেকে আরও ছোট হয়ে যাচ্ছে।
৩. এইসব ক্ষুদ্র কৃষকের বিক্রি করার মতো উদ্বৃত্ত ফসল সামান্যই থাকে। তবু তাঁদেরকে কয়েক বস্তা ধান বা গম বেচতেই হয়। কারণ তাঁদের কিছু দেনা থাকে। বাড়ির কোনও জরুরি প্রয়োজনে ওই ঋণ তাঁরা নিয়েছেন।
৪. এপিএমসি মার্কেটে ফসল বেচতে যান মাত্র ৬ শতাংশ কৃষক। বাদবাকি ৯৪ শতাংশ কৃষক তো এপিএমসির বাইরেই বিক্রি করে থাকেন। তাঁরা মূলত বিক্রি করেন স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে, অথবা কোনও সমবায়কে, অথবা কোনও উৎপাদকের কাছে।
৫. কোনও এপিএমসি নেই—কেরলে, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির মধ্যে চণ্ডীগড় ছাড়া অন্য কোথাও, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি রাজ্যে। বিহার রাজ্য সরকার কয়েক বছর আগেই তাদের এপিএমসি আইনটি বাতিল করে দিয়েছে। এসব রাজ্যে এপিএমসির বাইরেই ফসল বেচাকেনা হয়। এপিএমসির সংখ্যাটি হরিয়ানার ১০৬ থেকে পাঞ্জাবের ১৪৫ এবং তামিলনাড়ুর ২৮৩-র মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। পাঞ্জাবে আবার এপিএমসির ভিতরে অনেক সাব-ইয়ার্ড রয়েছে। পাঞ্জাব এবং হরিয়ানায় উৎপন্ন ধান ও গমের ৭০ শতাংশই সরকারি এজেন্সিগুলি (মূলত এফসিআই) কিনে নেয়। অথচ, ২০১৯-২০ সালে তামিলনাড়ুর এপিএমসিগুলিতে সমস্ত কৃষিপণ্যের ব্যবসার মোট পরিমাণ ছিল মাত্র ১২৯ কোটি ৭৬ লক্ষ টাকা।
৬. এবং, অন্যদিকে মহারাষ্ট্রের একজন কৃষককে তাঁর খামারের নিকটবর্তী একটি এপিএমসিতে পৌঁছতে গড়ে ২৫ কিমি পাড়ি দিতে হয়।
স্থিতাবস্থা রেখে দেওয়া
একটি রাজ্যে এপিএমসি আছে না নেই, এপিএমসিগুলি খুব দূরে বা সেগুলির সুযোগ নেওয়া সম্ভব কি না, সেসব বড় কথা নয়। বাস্তবটা হল—অনিয়ন্ত্রিত পরিবেশ-পরিস্থিতিতে এপিএমসির বাইরেই ফসল বিক্রি করা ছাড়া ৯৪ শতাংশ কৃষকের উপায় নেই। প্রধানমন্ত্রী থেকে মুখপাত্র কেউই ব্যাখ্যা করবেন না—কেন এপিএমসি এবং ফড়েদের কাছে কৃষকের হাত-পা বাঁধা ছবিটি তাঁরা আঁকছেন—বিশেষ করে যখন ৯৪ কৃষকের বাস্তব অবস্থা তেমন নয়। সুতরাং নয়া কৃষি আইনে কৃষকরা দারুণ এবং অভূতপূর্ব কিছু সুযোগ পেতে চলেছেন বলে যে বাজে যুক্তি খাড়া করা হচ্ছে, তথ্যের সামনে পড়ে শেষমেশ তা খারিজ হয়ে যাচ্ছে। আসলে নয়া আইনে বর্তমান অবস্থাটিকেই তার সমস্ত দোষ-ত্রুটি সমেত পুনরায় রেখে দেওয়া হচ্ছে (রিইনফোর্স দ্য স্টেটাসকো উইথ অল ইটস ইমপারফেকশনস)।
কৃষকদের সামনে কিছু চয়েস বা পছন্দ থাকবে—এটা আমি সমর্থন করি (গত ২৮ সেপ্টেম্বর এই স্থানে প্রকাশিত বিশেষ নিবন্ধেই আমি জানিয়েছিলাম)। আমি আরও মনে করি যে, শেষমেশ এপিএমসিগুলিকে ধাপে ধাপে তুলে দিতে হবে, কারণ তারা বাণিজ্যের প্রতিবন্ধক। এপিএমসিগুলি কৃষকদের একটি অংশের জন্য সুরক্ষা বলয়ের সুবিধা দিয়েছে মাথায় রেখেই কথাটি বলতে হচ্ছে। এপিএমসিগুলি সাচ্চা বাজার নয়। এগুলি সব কৃষকের স্বার্থ পূরণ করে না। কৃষকদের কাছে চড়া ভাড়া/খাজনা আদায় করে। এবং, কিছু ক্ষেত্রে এপিএমসিগুলি ব্যবসায়ী ও ফড়েদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।
কিন্তু এপিএমসিগুলি তুলে দেওয়ার আগে কৃষকদের সামনে যথাযথ পছন্দটা রাখতে হবে। আর সেই একমাত্র পছন্দটি হল—‘মাল্টিপল অলটারনেটিভ মার্কেটস’। অর্থাৎ অনেকগুলি বিকল্প বাজার। হাজার হাজার বড় গ্রাম এবং ছোট শহরে এগুলি থাকা জরুরি। ফসল নিয়ে কৃষকরা সহজেই যেন তাঁর পছন্দের বাজারে পৌঁছতে পারেন। পণ্যের ওজন বা পরিমাপ এবং দামের উপর রাজ্য সরকারের সামান্য নিয়ন্ত্রণ থাকা আবশ্যক। কৃষকরা এই বিকল্প বাজারগুলিতে গিয়ে ফসল বিক্রি করবেন। সেসব কিনতে পারবেন সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলি ও ব্যবসায়ীরা। কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের (এমএসপি) কম দাম দেওয়া চলবে না। তাহলে কৃষকদের একটি বড় অংশ এমএসপি অথবা তার চেয়েও বেশি দাম পাবেন, যা তাঁরা এখন পাচ্ছেন না। এমএসপির সরকারি গ্যারান্টি সম্পর্কে একটি বাজে রটনা করা হচ্ছে যে, এটি হলে কারা তা লঙ্ঘন করছেন খুঁজে দেখার ব্যবস্থা হবে এবং তার ফলে এমএসপি লঙ্ঘনকারী হাজার হাজার ব্যবসায়ীকে শাস্তিভোগ বা জেলের ঘানি টানার ব্যবস্থা হবে। এ একেবারে ফালতু কথা! এই আইনি নিশ্চয়তা শুধুমাত্র ফার্মার্স মার্কেটে ফসল বেচাকেনার চৌহদ্দিতেই প্রযোজ্য থাকবে।
মোদি সরকারের নতুন আইন নিশ্চয় এই ধরনের হাজার হাজার বিকল্প ফার্মার্স মার্কেট তৈরি করবে না। উল্টে, বেসরকারিভাবে চুক্তি সম্পাদনের জন্য কর্পোরেট-সহ ব্যবসায়ীদের অনুমতি দিয়েছে। ওইসঙ্গে বিবাদ মীমাংসার জন্য জটিল এবং আমলাতান্ত্রিক মেকানিজম (সিভিল কোর্টের এক্তিয়ারের বাইরে রাখার লক্ষ্যে) আমদানি করা হয়েছে। এইভাবে ভারসাম্য নষ্ট করে সরকার কৃষকদের আরও বিরুদ্ধে চলে গিয়েছে। পাশাপাশি, এপিএমসির বাইরে নিয়ন্ত্রণহীন বেসরকারি বাণিজ্য একবার আইনসিদ্ধ হয়ে গেলে, এপিএমসি থেকে ব্যবসায়ীদের বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে সেটাই হয়ে উঠবে জবরদস্ত মদত।
রাজ্যগুলিকে আইন তৈরি করতে দেওয়া হোক
ফসল উৎপাদন, বিক্রির মতো উদ্বৃত্ত এবং ব্যবসায়ীদের আচরণ—এইসব দিক থেকে প্রতিটি রাজ্যের একটি পৃথক ধারা রয়েছে। কৃষিপণ্য বিপণনের জন্য রাজ্যগুলিকে তাদের মতো আইন তৈরি করতে দেওয়া হোক। সেখানে একটি পাঞ্জাব মডেল যেমন হতে পারে, তেমনি হতে পারে একটি বিহার মডেল। তাদের রাজ্যের জন্য কোনটা সবচেয়ে ভালো হবে সেটা সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার, কৃষক এবং মানুষজনকে ঠিক করতে দেওয়া হোক। সেটাই হবে সত্যিকার যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। কোনও একটি বিষয়ে সংসদে প্রণীত আইন, যুক্তি দিয়ে দেখানো যায় যে, সেটি সংবিধানের রাজ্য তালিকাভুক্ত। কিন্তু একটাই সাইজ সব রাজ্যকে ফিট করানোর ব্যর্থ চেষ্টার মধ্যে অবধারিতভাবে সংশয় রয়েই যায়।
যে অস্বাভাবিক দ্রুততায় অর্ডিন্যান্সগুলি জারি করে তার জায়গায় নতুন আইন আনা হয়েছে—তা নিয়ে গভীর অনুসন্ধানের অবকাশ রয়েছে। আমরা জানি যে, এই বিষয়ে উপযুক্ত আলোচনা ও বিতর্ক এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে ভোটাভুটির দাবি। আর এইভাবেই অর্ডিন্যান্সগুলিকে আইনে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এই বিতর্কিত আইনগুলি আনার পিছনে সরকারের আসল মতলবটা রহস্যেই ঢাকা রইল।