শরীর নিয়ে চিন্তায় থাকতে হবে। মাথা ও কোমরে সমস্যা হতে পারে। উপার্জন ভাগ্য শুভ নয়। ... বিশদ
মুখে জনস্বার্থের স্লোগান, আর মনে মনে গাইছে ঠাকুরের গান, ‘তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই।’ ‘সোনার হরিণ’ পাওয়ার
বাসনা অনেক সময়ই ডেকে আনে ভয়ঙ্কর বিপদ। সীতার সোনার হরিণের চাহিদাতেই বেঁধেছিল লঙ্কাকাণ্ড। আবার সেই সোনার হরিণেরই নাগাল পাওয়ার চেষ্টা। মহামারীর চোখ রাঙানিকে পরোয়া না করেই চলছে মিটিং, মিছিল। কর্মী সমর্থকদের জীবন সেখানে তুচ্ছ। তা দেখে জাগছে সংশয়, ফের কি এক লঙ্কাকাণ্ডের দোরগোড়ায়?
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। বড়জোর মাস খানেক হবে। হুগলির এক সভায় বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ ঘোষণা করেছিলেন, ‘করোনা চলে গিয়েছে। দিদিমণি (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) বিজেপিকে আটকাতে লকডাউন করছেন।’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি যখন এই দাবি করেছিলেন তখন রাজ্যে প্রতিদিন গড় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল তিন হাজার। বেপরোয়া মনোভাবের সৌজন্যে এখন
সাড়ে তিন হাজার। শুধু ভাষণে নয়, বিজেপি নেতৃত্বের আচরণেও করোনাকে উপেক্ষার বার্তা। তাতে
কর্মীরাও হয়েছেন উৎসাহিত। কারণ নেতানেত্রীদের অনুসরণ ও অনুকরণের ঝোঁক অনুগামীদের মধ্যে সর্বদাই প্রবল। গেরুয়া শিবিরে একটাই লক্ষ্য, বঙ্গজয়। তা দলের কর্মসূচিতেই স্পষ্ট। প্রতিদিন রাজ্যজুড়ে চলছে মিছিল। বলাই বাহুল্য, জমায়েতে মাস্ক পরিহিত কর্মী সমর্থকের সংখ্যা খুবই নগণ্য। তারই মধ্যে বিজেপির যুব মোর্চার ‘নবান্ন অভিযান’। ভোটারদের প্রভাবিত করতে শক্তি জাহিরের চেষ্টা। তাতে বিজেপির প্রভাব কতটা বাড়ল, সেটা সময় বলবে। কিন্তু, এই সুযোগে করোনা যে তার থাবা আরও প্রসারিত করে নিল, তা হলফ করে বলা যায়।
তবে সুখের কথা, দিলীপবাবু তাঁর মত বদলেছেন। তিনি বুঝেছেন, করোনা আছে এবং তার ভয়ও যথেষ্ট। সেই কারণেই তিনি দুর্গোৎসবে শামিল না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর আশা, করোনা মহামারী থেকে মা দুর্গা দ্রুত উদ্ধার করবেন। এ কথার অর্থ, বিজেপিকে আটকানোর জন্য লকডাউন করা হচ্ছে বলে তাঁর দাবির পিছনে যুক্তি ছিল না, ছিল রাজনীতি।
করোনা থাবা বসানোর পর রাজ্যের সমস্ত দলই মিটিং মিছিল এড়িয়েই চলছিল। কিন্তু অমিত শাহ ভার্চুয়াল সভায় বঙ্গ দখলের বার্তা দিতেই গেরুয়া শিবির ঝাঁপিয়ে পড়ে। জীবন ও জীবিকার স্বার্থে মুখ্যমন্ত্রীর দোকান খুলে দেওয়ার ঘোষণাকে যাঁরা তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ করেছিলেন, তাঁরাই মিটিং মিছিল শুরু করে দিলেন। তারপরেও করোনা সংক্রমণের কথা মাথায় রেখে বহুদিন তৃণমূল, সিপিএম এবং কংগ্রেস কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচি নেয়নি। রাজনীতিতে কেউই দীর্ঘদিন প্রতিপক্ষকে খেলার জন্য ফাঁকা ময়দান ছেড়ে দেয় না। তাই ফের জমি দখলের লড়াই। একে একে নেমে পড়ল সবাই।
কেন্দ্রীয় সরকার নয়া কৃষি আইন পাশ করামাত্র প্রতিবাদে সরব হল তৃণমূল। ‘কালা কানুন’ বাতিলের দাবিতে মিছিল, মিটিং শুরু করে দিল। হাতরাস ইস্যুতে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়িয়ে দিল অনেকটাই। আর সেই সব মিছিলে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। গায়ে গা লাগিয়ে হাঁটায় সংক্রমণের আশঙ্কা বেড়েই চলেছে। তাই করোনা ছড়ানোর দায় বিরোধীদের পাশাপাশি শাসক দলকেও নিতে হবে বইকি।
ইস্যু তৈরিতে বিজেপি এই মুহূর্তে এক নম্বর। সাফল্যের ভাণ্ডার ঠকঠকালেও বিরোধিতার অস্ত্র একেবারে শানিত তরোয়াল। তা থেকে রাজনৈতিক ফায়দা তোলায় কোনও কার্পণ্য থাকে না। টিটাগড়ে ‘দলবদলু’ মনীশ শুক্লা খুন হতেই ৩৬৫ ধারার ক্ষেত্র প্রস্তুতের মরিয়া চেষ্টা। মৃতদেহ নিয়ে রাজভবন অভিযানের নামে কলকাতা শহরকে কার্যত লণ্ডভণ্ড করল। কিন্তু, লাভ হল না। তাই ইস্যু জিইয়ে রাখতে সিবিআইয়ের দাবিতে বারাকপুরে মোমবাতি র্যালি। তৃণমূলও পাল্টা হিসেবে ‘শান্তি মিছিলে’র নামে বিশাল পদযাত্রা করে শক্তি জাহির করল। তাতে শিল্পাঞ্চলে তৃণমূলের কর্মী সমর্থকরা হয়তো কিছুটা চাঙ্গা হলেন, কিন্তু করোনোর বিপদ বাড়ল।
বাম নেতৃত্ব তাদের পার্টি ক্লাসে একটা কথা প্রায়ই দাবি করে, সিপিএম বিজ্ঞান নির্ভর দল। সেই দলের মাথায় রয়েছেন সূর্যকান্ত মিশ্র। তিনি একজন চিকিৎসক। তাই সেই দলের কাছে বিজ্ঞানমনস্ক পদক্ষেপই কাম্য। কিন্তু, তারাও একই পথের পথিক। আসলে রাজ্যের মূল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দল মিটিং মিছিল করবে, আর করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় বামেরা চুপচাপ বসে থাকবে! সেটা করলে যে ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই’ স্লোগানের জনকদের গরিমায় ঘা লাগবে। তাই তাঁরাও রাস্তায়।
বামেরা রাজ্যের ক্ষমতা থেকে গেলেও তাদের দ্বিচারিতার স্বভাব থেকেই গেল। একদিকে বিভিন্ন ইস্যুতে রাজ্যজুড়ে মিছিল মিটিং করছেন। মাস্ক ছাড়াই মিছিলে হাঁটছেন, সভায় ভাষণ দিচ্ছেন। আবার সেই দলের নেতা সূর্যকান্তবাবুই বলছেন, ‘উৎসবে শৃঙ্খলার দায়িত্ব নিতে হবে রাজ্য সরকারকে।’ এটাই চোরকে চুরি করতে বলে গৃহস্থকে সাবধান করার উদাহরণ, এর চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে না।
দ্বিতীয়বার প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হয়েছেন অধীর চৌধুরী। নেতৃত্বের বলিষ্ঠতার স্বীকৃতিস্বরূপ দল তাঁকে দিয়েছে লোকসভার বিরোধী নেতার মর্যাদা। তাই নিজের রাজ্যে কংগ্রেসকে ফের শক্তপোক্ত জায়গায় দাঁড় করানোর তাগিদ তাঁর থেকেই যায়। সম্ভবত সেই তাগিদ থেকেই তাঁর কলকাতায় মিছিলের ডাক। জবরদস্ত মিছিলে কংগ্রেসের মরা গাঙে জোয়ার না আসলেও সঞ্চারিত হয়েছে ফল্গুধারা। তার সঙ্গে প্রসারিত হয়েছে করোনার থাবাও।
তবে, ইদানীং বিজেপির মিছিল একটু বেশিই হচ্ছে। অবশ্য কারণও আছে। এতদিন দিলীপবাবুই ছিলেন দলের শেষ কথা। এখন আরও একজন ভাগীদার হয়েছেন। মুকুল রায়। ফলে দলীয় মেরুকরণের লড়াইয়ে কোন গোষ্ঠী কর্তৃত্ব করবে, তা নিয়েও শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা। এক গোষ্ঠী মিছিল করে যেতে না যেতেই অন্য গোষ্ঠী সেখানে পৌঁছে যাচ্ছে। যাচাই হচ্ছে, কার পাল্লা ভারী! তাই নিয়ে রাজ্যে রীতিমতো মিছিলের প্রতিযোগিতা চলছে। একে অপরকে টক্কর দেওয়ার লড়াইয়ে মত্ত। আর তার জন্য দিন দিন কঠিন হচ্ছে করোনা মোকাবিলা।
বাংলায় উৎসবের মরশুম শুরু। দুর্গাপুজো দিয়ে শুরু, শেষ হবে দীপাবলিতে। উৎসব মানেই ভিড়, আড্ডা, আনন্দ। কিন্তু সেই আনন্দ যেন নিরানন্দের কারণ হয়। তাই এবারের উৎসব শুধু আনন্দের নয়, পরীক্ষারও। বাংলার এবং বাঙালির পরীক্ষা।
সংযমের অগ্নিপরীক্ষা। হাততালি দিয়ে, কাঁসর ঘণ্টা বাজিয়ে, প্রদীপ জ্বেলে যে করোনা মোকাবিলা সম্ভব নয়, তা প্রমাণিত। করোনাকে ঠেকাতে গেলে নিয়ম মানতে হবে। উৎসবে, ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও যে বাংলা সংযত থাকতে পারে তার প্রমাণ দিয়েছে
ঈদ ও মহরম। ঘরে থেকেই পালিত হয়েছে ধর্মীয় আচার। দুর্গোৎসবেও ফের একবার প্রমাণ দিতে
হবে। ইতিমধ্যেই মহামিলনের তীর্থক্ষেত্র বেলুড় মঠ কর্তৃপক্ষ পুজোয় মঠে সাধারণের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। করা হচ্ছে ঘরে বসেই মাতৃদর্শনের ব্যবস্থা। কলকাতার দু’একটি নামী পুজো কমিটিও সেই পথেই হাঁটছে। উৎসবে করোনাকে বুড়ো আঙুল দেখানোর এটাও একটা রাস্তা।
এই উৎসবই আমাদের সামনে এনে দিয়েছে একটা সুযোগও। শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের। করোনা নিয়ন্ত্রণ করে গোটা দেশ সহ বিশ্বের প্রশংসা কুড়িয়েছিল কেরল। সেই কেরলও ওনাম উৎসবে সংযম দেখাতে পারেনি। তাই এক ধাক্কায় কেরলের দৈনিক সংক্রমণের হার এক হাজার থেকে বেড়ে ১২ হাজারের কাছাকাছি। শিক্ষার নিরিখে দেশের এক নম্বর রাজ্য কেরল। সেই কেরলও পারেনি। এবার বাংলার পরীক্ষা।
করোনা কেড়ে নিয়েছে বহু অমূল্য প্রাণ। মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে করোনা যোদ্ধারা ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। প্রাণ হারাচ্ছেন তাঁরাও। ইতিমধ্যেই হাসপাতালে হাসপাতালে বেডের হাহাকার। এই অবস্থায় উৎসবের দিনে সংযম হারালেই সুনামির বিধ্বংসী শক্তি নিয়ে আছড়ে পড়বে মারণ ভাইরাস। তখন সমস্ত প্রতিরোধই খড়কুটো। তাই এখন থেকেই হতে হবে সতর্ক। বিপদ থেকে পরিত্রাণের একটাই মন্ত্র, ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা।’