প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। তবে তা বাস্তবায়িত হওয়াতে সমস্যা আছে। ... বিশদ
নতুন ভাইরাসের মাধ্যমে যে রোগ সংক্রমণটি ঘটছে, ‘হু’ সেটির নাম দিয়েছে ‘কোভিড-১৯’। রোগীর দেহে এই ‘নতুন’ ভাইরাস সংক্রমণের ব্যাপারটি প্রথম লক্ষ করেছিলেন চীনের এক ডাক্তার। নাম লি ওয়েং লিয়ান। সেটা ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের ঘটনা। এরপর চীন সরকার তাঁর উপর রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং তাঁকে দিয়ে তাঁর ভুল স্বীকরোক্তিতে সই করে নিয়েছিল। কিন্তু সেই চিকিৎসকই এই সংক্রমণের শিকার হন এবং ২০২০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মারা যান। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৩ বছর (তাঁর মৃত্যুর পর চীনা কর্তৃপক্ষ অবশ্য দুঃখপ্রকাশ করেছিল)। তিনি যে ভাইরাসটিকে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, সেটি পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়তে ১০০ দিনও সময় নেয়নি।
কোভিড-১৯ এমন একটি রোগ যাকে একটি দেশের মধ্যে বিনাশ করে ফেলা সম্ভব নয়। কারণ সে কোনও দেশের সীমারেখা পরোয়া করে না। আক্রমণের সময় সে মানুষের ধর্ম-জাতি-বর্ণ-লিঙ্গ এবং জন্মস্থান বিষয়েও কোনও বৈষম্য করে না। ব্যঙ্গার্থে বলা যায় যে, এই ভাইরাস ভারতের সংবিধানের ১৪ ও ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
ক্ষমতাহীন নেতারা
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, মানে এই গ্রহের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষটি (যেমন ওঁরা বলে থাকেন) অসহায়ভাবে দেখলেন যে, তাঁর দেশে সংক্রামিতের সংখ্যা ২ লক্ষ ১৩ হাজার ৬০০ ছাড়িয়ে গেল (বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক)। মৃতের সংখ্যাটি হবে ১ লক্ষ থেকে ২ লক্ষ ৪০ হাজার (যেমন ভবিষ্যৎবাণী রয়েছে আর কী!)। ‘বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী’ কিছু করতে অক্ষম। পৃথিবীর ধনী দেশগুলির ধনসম্পদের এখানে করণীয় কিছু আছে বলে মনে হয় না। কারণ, ‘দামি ও শক্তিশালী’ ডলারই এখন ‘দুর্বল’ ইউরো বা ইউয়ান-এর মতোই শক্তিহীন।
তবু, নির্বাচিত অথবা স্বঘোষিত শীর্ষকর্তারা দেশবাসীর সম্মতিতে দেশ পরিচালনা করার বদলে তাঁদের দেশকে ‘শাসন’ করতে চান। যেমন ব্রুস স্প্রিংসটিন তাঁর ‘ব্যাডল্যান্ডস’-এ বলেছেন, ‘যতক্ষণ না একজন রাজার সবকিছুর উপর আধিপত্য কায়েম হয় ততক্ষণ তিনি তুষ্ট হন না।’ আজ তাঁদের হম্বিতম্বি এবং প্রশাসনযন্ত্র কতটা ‘শূন্যগর্ভ’ বলে আপনার মনে হয়? ডিকটাটস (পরাজিত পক্ষের উপর চাপিয়ে দেওয়া কঠোর শর্তাবলি), আমৃত্যু ক্ষমতা, নাম কে ওয়াস্তে সংসদ, জিগরি আদালত, প্লায়ান্ট বা সহজে প্রভাবিত এজেন্সিগুলি, গুপ্তচর, এবং সবচেয়ে ব্যাপকভাবে অপব্যবহৃত হাতিয়ার, বিনা অপরাধে রাজনৈতিক বিরোধীদের কয়েক মাস বা কয়েক বছরের জন্য জেলে ভরে দেওয়া—এই সবই আজ শূন্যগর্ভ হয়ে গিয়েছে।
অত্যাচারী এবং অত্যাচারিত
অত্যাচারীদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া উচিত, এটা কি ভাগ্যের পরিহাস নয় যে গোটা বিশ্বটাই একটি কারাগারে পরিণত হয়েছে এবং অত্যাচারী ও অত্যাচারিত দু’জনেই নিজেদেরকে এক কারাগারে খুঁজে পাচ্ছেন?
যেহেতু আপনি লকডাউন হয়ে আছেন, তখন আপনি একটি গেম খেলতে পারেন। আপনার ল্যাপটপে বা ফোনে পৃথিবীর মানচিত্রটা ডাউনলোড করুন। পরিবারের একজন কাউকে বলুন একটি একটি করে সব দেশকে চিহ্নিত করতে। এরপর একটি প্রশ্ন করুন: ওই দেশটি কি বিনা অপরাধে মানুষকে জেলে ভরে দেয়? এখানে আপনি যা সব দেখবেন কিছু উদাহরণমাত্র। দক্ষিণ আমেরিকা দিয়ে শুরু করুন।
ভেনিজুয়েলা: তিরিশ জন বিরোধী নেতার সংসদীয় রক্ষাকবচ কেড়ে নিয়েছিল প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর পুতুল বিচারব্যবস্থা এবং তাঁরা এখন হয় নির্বাসনে নয়তো কারাগারে কাটাচ্ছেন।
আফ্রিকায় যান, আরও খারাপ ছবি দেখতে পাবেন।
ইথিওপিয়া: অ্যাবি আহমেদ প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ২০১৮ সালে। প্রতিবেশী দেশ ইরিত্রিয়ার সঙ্গে শান্তিস্থাপনের কৃতিত্বস্বরূপ নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৯ সাল জুড়ে ইন্টারনেট বন্ধ করে রেখেছিলেন। ৬৪টা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও অন্তত ১৪০০টা বিনা বিচারে আটকের রিপোর্ট করেছিল একটি এনজিও।
তানজানিয়া: প্রেসিডেন্ট জন মাগুফুলি বিরোধী এমপি এবং সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করেছেন, সংবাদমাধ্যমের ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়েছেন। এমনকী, বিক্ষুব্ধদের কণ্ঠরোধ করার মতো আইনও পাশ করেছেন।
ইউরোপের ছবিটা মিশ্র। সেখানে গণতন্ত্র শক্তিশালী এবং প্রশংসনীয়, তবু সেখানেও রয়েছে:
হাঙ্গেরি: সে দেশের প্রশাসন, সংসদ এবং বিচারব্যবস্থাকে নিজের পক্ষে টেনে এনেছেন প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ওরবান। তাঁর সরকার সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য করেছে এবং প্রথম ইন্টারনেট ট্যাক্স চাপিয়ে দিয়েছে। ৩০ মার্চ ওরবান ইমার্জেন্সি আইন পাশ করিয়ে নিয়েছেন। আর তিনি যতদিন সুস্থ থাকবেন ততদিন হাঙ্গেরিকে শাসন করার অধিকার তাঁরই করায়ত্ত থাকবে ওই ডিক্রির বলে।
রাশিয়া: প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সংবিধানের একটি সংশোধনীর মাধ্যমে তাঁর শাসনকাল ফের ‘শূন্য’ থেকে শুরু করলেন। মস্কোয় যখন হাজার হাজার প্রতিবাদী মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, তখন তাঁদের ডান্ডা দেখানো হয়েছিল। দু’হাজারের বেশি নাগরিককে আটক করা হয়েছিল, ডজন ডজন নাগরিককে পিটিয়ে ঠান্ডা করা হয়েছিল এবং কিছু প্রতিবাদীকে ক্রিমিনাল কেসে ফাঁসানো হয়েছিল। রাজনৈতিক বিরোধীদের গ্রেপ্তার, পুলিশকর্তাদের হিংস্রতা, শিশুদের আটক, বাচ্চাকাচ্চাদের মা-বাবাদের হুমকি প্রভৃতি একেবারে জলভাত হয়ে গিয়েছে। দেশে দু’শোর বেশি রাজনৈতিক বন্দি।
এশিয়া: স্বাধীনতার মাত্রা দেশ বিশেষে নানারকম। এসবের কিছুটা অবশ্য গণতন্ত্র বলা যাবে না।
থাইল্যান্ড: প্রধানমন্ত্রী প্রযুত চান-ও-চা’র নতুন সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে ২০১৯ সালে। সেখানে রাজনৈতিক কর্মীদের শারীরিকভাবে নিগ্রহ করা হচ্ছে, মানবাধিকার কর্মীদের গুম করে দেওয়া হচ্ছে। আর মুক্তকণ্ঠ রোধের পরোক্ষ দাওয়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে ফৌজদারি কার্যবিধির রক্তচক্ষু প্রদর্শন।
কম্বোডিয়া: ২০১৮-র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ভয়ঙ্কর এক দমনপীড়নমূলক পরিবেশে—ভোটদাতাদের স্বাধীন মতামতের কোনও মূল্য ছিল না। প্রধান বিরোধী দলটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। বিরোধী নেতাদের হয় নির্বাসনে নয়তো জেলে পাঠানো হয়েছিল। স্বাধীন সংবাদমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজ সংগঠনগুলিকে (সিভিল সোসাইটি) ছেঁটে দেওয়া হয়েছে। সংসদের উভয় কক্ষের সবক’টি আসন এখন শাসক দলের দখলে।
মানবতার জয় হবে
আপনার হতাশার পূর্বে নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন, কেন প্রতিটি শক্তিশালী নেতা করোনা ভাইরাসের বিস্তারকে ‘অ্যারেস্ট’ করতে অক্ষম? মানবতা কি শেষেমশ মহামারীকে পরাস্ত করতে পারবে? সুবিখ্যাত তামিল কবি শ্রীভাইরামুথু তো তেমনই মনে করেন। করোনা ভাইরাসের উপর সুন্দর একটি কবিতাও তিনি লিখেছেন। তার একাংশের মুক্ত অনুবাদ দিলাম, পড়ে দেখুন:
অণুর চেয়ে ক্ষুদ্রতর/ ভয়ঙ্কর তবে আণবিক বোমার থেকে/ প্রবেশ করে নিঃশব্দে
কোনও যুদ্ধ ছাড়াই ধ্বংস করে
মানুষ সম্পূর্ণ ধ্বংস করবে/ করোনাকেও/ সে জয় করবে মহামারীকেও
করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা মানবজাতি যখন জিতবে, আমি আশা রাখি, মানবজাতি তখন একনায়ক ও অত্যাচারীদের হাত থেকে স্বাধীনতাও ছিনিয়ে আনবে এবং এমনটা হওয়ার খোয়াব যারা দেখে, তাদেরকেও পরাস্ত করবে।
লেখক সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী