কোনও কিছুতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভাববেন। শত্রুতার অবসান হবে। গুরুজনদের কথা মানা দরকার। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সুফল ... বিশদ
সরকারি তথ্যই বলছে রাজকোষে এত মাত্রায় টানাটানি পড়েছে যে ১০০ দিনের প্রকল্প থেকে শুরু করে পিএম কিষাণ প্রকল্প, কেন্দ্রীয় আবাস যোজনা, গ্রাম সড়ক যোজনার মতো ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোর প্রয়োজনীয় অর্থও অনেকাংশে জোগাতে অক্ষম মোদি সরকার। দেশের অর্থনীতির ঝিমুনি এমন মাত্রায় বিপদসংকুল যে অর্থমন্ত্রকের কর্তাদের আশঙ্কা ঘাটতি লাগাম রাখতে হলে শুধু মূলধনী ব্যয় নয় গ্রামোন্নয়নের খরচেও কাটছাঁট করতেই হবে। কারণ অর্থনীতির ঝিমুনির ফলে গত ৯ মাসে প্রত্যক্ষ কর ও জিএসটি থেকে আদায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে যথেষ্ট কমেছে। অর্থমন্ত্রকের ধারণা বাকি ৩ মাসে বাৎসরিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়া অসম্ভব।
এটা ঘটনা যে প্রত্যক্ষ কর ও জিএসটি থেকে আদায় হয় কেন্দ্রীয় সরকারের ঋণবিহীন মোট আয়ের অন্তত ৮০ শতাংশ। ঋণবিহীন আয়ের বাকি অর্থ আসে কর বহির্ভূত আয় ও বিলগ্নীকরণ থেকে। প্রথমে প্রত্যক্ষ কর আদায়ের প্রসঙ্গে আসা যাক। বর্তমান অর্থবর্ষে প্রত্যক্ষ কর (আয়কর, কর্পোরেট কর) থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ১৩.৩৫ লক্ষ কোটি টাকা। প্রথম ৭ মাসে আদায় লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৪৫ শতাংশ। বাকি ৫ মাসে প্রত্যক্ষ কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা অসম্ভব। কারণ বর্তমান অর্থবছরেই কর্পোরেট কর সাত লক্ষ ছেষট্টি হাজার কোটি টাকার মধ্যে ১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকা ছাড় দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রত্যক্ষ কর থেকে আদায় কমতে বাধ্য।
পরোক্ষ কর থেকে কেন্দ্রের আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ১১.১৯ লক্ষ কোটি টাকা। প্রথম ৮ মাসে আদায় হয়েছে ৬.১২ লক্ষ কোটি টাকা। বাকি ৪ মাসে ৫.০৭ লক্ষ কোটি টাকা আদায় হওয়া অসম্ভব। বিশেষ করে জিএসটি থেকে কেন্দ্রের আদায় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম হবে। প্রথম ৮ মাসে জিএসটি থেকে কেন্দ্রের আদায় হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার (৬.৬৩ লক্ষ কোটি টাকা) ৬০ শতাংশ। বাকি ৪ মাসে জিএসটি’র লক্ষ্যমাত্রা পূরণ অসম্ভব। কেন্দ্রের ধারণা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর মিলিয়ে কেন্দ্রের আদায় অন্তত ২ লক্ষ কোটি টাকা কম হবে।
এবার বিলগ্নীকরণ প্রসঙ্গে আসা যাক। কেন্দ্রের লক্ষ্য, বিলগ্নীকরণ থেকে বর্তমান বছরে ১.০৫ লক্ষ কোটি টাকা আয় করা। গত ৯ মাসে এসেছে মাত্র ১৭,০০০ কোটি টাকা। ৩ মাসের কম সময়ের মধ্যে বাকি ৮৮,০০০ কোটি টাকা আয় কার্যত দুরূহ। লাভজনক সংস্থা ভারত পেট্রোলিয়াম থেকে এ বছরের লক্ষ্যমাত্রা ৬০,০০০ কোটি টাকা। কন্টেনার সংস্থা থেকে ১৩,০০০ কোটি টাকা। কিন্তু ইতিমধ্যেই এই বিলগ্নীকরণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। কর্তৃপক্ষের ধারণা বিলগ্নীকরণ থেকে আদায় প্রায় ৫০,০০০ কোটি টাকা কম হবে।
একদিকে কেন্দ্রের রাজকোষ থেকে মোট আদায় যেখানে বর্তমান বছরে লক্ষ্যমাত্রার প্রায় আড়াই লক্ষ কোটি টাকা কম হতে চলেছে, অন্যদিকে রাজকোষ ঘাটতি প্রথম ৭ মাসেই বাৎসরিক লক্ষ্যমাত্রাকেও অতিক্রম করে গেছে। বর্তমান অর্থবছরে ১২ মাসে রাজকোষ ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয়েছিল দেশের জিডিপি’র ৩.৩ শতাংশ। টাকার অঙ্কে ৭.০৩ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু মাত্র ৮ মাসেই রাজকোষ ঘাটতি বাবদ ব্যয় ৮.০৮ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র ৮ মাসেই রাজকোষ ঘাটতি বাবদ খরচ বাৎসরিক লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ১.০৫ লক্ষ কোটি টাকা অতিক্রম করে গেছে। এমন ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে তার ব্যয় সংকুলানের জন্য শুধুমাত্র তার মূলধনী ব্যয়কে কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছে না, এমনকী আমজনতার প্রত্যক্ষ রুটিরুজির সঙ্গে যুক্ত গ্রামোন্নয়নের অর্থও কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছে।
গত অর্থবছরে ১০০ দিনের প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৬১,০৮৪ কোটি টাকা। এবারের বরাদ্দ কমিয়ে করা হয়েছে ৬০,০০০ কোটি টাকা। ইতিমধ্যেই সে অর্থ ব্যয় হয়ে গেছে। কিন্তু গ্রামে গ্রামে কাজের চাহিদা বাড়ছে। তাই গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক অর্থ দপ্তরের কাছে আরও ২০ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে। কিন্তু সাড়া নেই। এছাড়াও পিএম-কিষাণ প্রকল্পে এ বছর ৭৫,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও অনেক চাষি পুরো কিস্তির টাকা পাবেন না। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের তথ্যই বলছে এ বছর প্রায় ৩০,০০০ কোটি টাকা চাষিদের মধ্যে বিলি করবে না মোদি সরকার। এমনকী প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় গত বছরের থেকে এ বছরে বরাদ্দ কম হলেও, এ বছর গত ৯ মাসে বাড়ি তৈরি হয়েছে মাত্র ৭.২ লক্ষ। বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় অর্ধেক। ফলে এ বছর এই প্রকল্পে ২৫,৮৫৩ কোটি টাকার একটা বড় অংশ খরচ না হবার সম্ভাবনা। অন্যান্য গ্রামীণ পরিকল্পনার অর্থেও ইতিমধ্যে যথেষ্ট কোপ পড়েছে।
বর্তমান অর্থবর্ষে একদিকে যেখানে রাজকোষের আয় প্রায় ২.৫০ লক্ষ কোটি টাকা কম হতে চলেছে, অন্যদিকে রাজকোষ ঘাটতি প্রথম ৮ মাসেই বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে ১১৫ শতাংশ ছুঁয়েছে। যার ফলে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট কোপ পড়েছে গ্রামের উন্নয়নের খরচে। ফলে বছরের শেষে রাজকোষ ঘাটতি কোথায় দাঁড়াবে তা নিয়ে অর্থনীতিবিদেরা যথেষ্ট সন্দিহান। এমনকী রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজনও ভারতে রাজকোষ ঘাটতির প্রকৃত তথ্য প্রকাশ না করা নিয়ে কিছুদিন আগেই সমালোচনা করেছেন। বস্তুত, বর্তমান অর্থবর্ষে ভারতের অর্থনীতির চিত্র যথেষ্ট বিবর্ণ। সমৃদ্ধির হার ক্রমশ কমে ৫ শতাংশে নামার ইঙ্গিত, যা ১১ বছরে সর্বনিম্ন। মুদ্রাস্ফীতি গত ৩ বছরে সর্বাধিক। শিল্পে সমৃদ্ধির হার ৮ বছরে সর্বনিম্ন। পরিকাঠামো শিল্পে বৃদ্ধির হার ১৪ বছরে সর্বনিম্ন। বিদ্যুতের চাহিদা ১২ বছরে সর্বনিম্ন। বেসরকারি লগ্নি ১৬ বছরে সর্বনিম্ন। চাহিদা কমায় বাজারে ব্যাঙ্ক লগ্নি কমেছে, যা গত ৫৮ বছরে সর্বনিম্ন। রপ্তানিও যথেষ্ট ধাক্কা খাওয়ার ইঙ্গিত বর্তমান বছরে। এর উপর ভারতে বেকারত্বের হার গত ৪৫ বছরে সর্বনিম্ন। এমতাবস্থায় আগামী অর্থবছরে দেশের সার্বিক সমৃদ্ধির চাকায় গতি আনতে হলে পরিকাঠামো সহ উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে সরকারি ব্যয় আশানুরূপ বৃদ্ধি ব্যতিরেকে সম্ভব নয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে রাজকোষের আয় কীভাবে আরও বাড়ানো সম্ভব তার উপায়ও সরকারকে খুঁজতেই হবে।