জ্ঞান বল, ভক্তি বল, দর্শন বল, কিছুই ঈশ্বরের কৃপা ভিন্ন হবার নয়। কি জান? কামকাঞ্চনকে ঠিক ঠিক মিথ্যা বলে বোধ হওয়া, জগৎটা তিন কালেই অসৎ বলে ঠিক ঠিক মনে জ্ঞানে ধারণা হওয়া কি কম কথা? তাঁর দয়া না হলে কি হয়? তিনি কৃপা করে ঐরূপ ধারণা যদি করিয়ে দেন তো হয়। ‘ঈশ্বরই কর্ত্তা আর সব অকর্ত্তা’—এর নাম জ্ঞান। আমি অকর্ত্তা তাঁর হাতের যন্ত্র। তাই বলি, মা, আমি গাড়ী, তুমি ইঞ্জিনিয়র আমি যন্ত্র, তুমি যন্ত্রী; আমি ঘর, তুমি ঘরণী; যেমন করাও তেমনি করি, যেমন বলাও তেমনি বলি; যেমন চালাও তেমনি চলি; নাহং নাহং তুহুঁ তুহুঁ। আমি কেহ নয়, তুমি কর্ত্তা। ঈশ্বর সৎ আর সব অসৎ, এইটী জানার নাম জ্ঞান। যিনি সৎ তাঁর একটী নাম ব্রহ্ম, আর একটী নাম কাল (মহাকাল) তাই বলে ‘কালে কত গেল, কত হলরে ভাই। তত্ত্বজ্ঞান মানে আত্মজ্ঞান। তৎ মানে পরমাত্মা, ত্বং মানে জীবাত্মা। জীবাত্মা আর পরমাত্মা এক জ্ঞান হলে তত্ত্বজ্ঞান হয়। ঈশ্বর লাভ হলে পাঁচ বছরের বালকের স্বভাব হয়। ঈশ্বর নিজে বালক স্বভাব, তাই যে তাঁকে দর্শন করে তারও বালক স্বভাব হয়ে যায়। বালক কোন গুণের বশ নয়, ত্রিগুণাতীত। ছেলে তমো গুণের বশ নয়। এই একজনের সঙ্গে মারামারি করলে, আবার কিছু পরেই তার গলা ধরে কত ভাব। জগৎ দেখলে বোঝা যায় যে তিনি আছেন। কিন্তু তাঁর বিষয়ে শোনা একরকম, তাঁকে দেখা একরকম, তাঁর সঙ্গে আলাপ করা আর একরকম। দুধের কথা কেউ শুনেছে, কেউ দেখেছে, কেউ খেয়েছে।
আমার জ্ঞানীর স্বভাব নয়। জ্ঞানী আপনাকে বড় দেখে। আমার স্বভাব মা সব জানে। তিনি আমায় ভক্তের অবস্থায় বিজ্ঞানীর অবস্থায় রেখেছেন। তাই রাখাল প্রভৃতির সঙ্গে ফচ্কিমি করি। জ্ঞানীর অবস্থায় উটি হয় না। যে নিত্যে পৌঁছে লীলা নিয়ে থাকে, আবার লীলা থেকে নিত্যে যেতে পারে, তারই পাকা জ্ঞান, পাকা ভক্তি। নারদাদি ব্রহ্মজ্ঞানের পর ভক্তি নিয়ে ছিলেন। এরই নাম বিজ্ঞান। শুধু শুষ্ক জ্ঞান—ও যেন ভস্ করে ওঠা তুবড়ি—খানিকটা ফুল কেটে ভস্ করে ভেঙ্গে যায়। জ্ঞানী সাধু আর বিজ্ঞানী সাধুর প্রভেদ আছে। জ্ঞানী সাধুর বসবার ভঙ্গি আলাদা। গোঁপে চাড়া দিয়ে বসে। কেউ দেখা করতে এলে বলে, ‘তুমি কেমন আছে; বাড়ীর সব কেমন আছে? তোমার কিছু জিজ্ঞাসা আছে?’ আর বিজ্ঞানী সাধু, যে ঈশ্বরকে সর্ব্বদা দর্শন করছে, তাঁর সঙ্গে কথা কচ্চে, তার স্বভাব কখনও বালকবৎ, কখনও জড়বৎ, কখনও উন্মাদবৎ, কখনও পিশাচবৎ। পাঁচ বছর বালকের মত স্বভাব হয়। লজ্জা, ঘৃণা, সঙ্কোচ প্রভৃতি কোন পাশ নাই—ত্রিগুণাতীত—কোন গুণের আঁট নেই। জড়বৎ—সমাধিস্থ হয়ে বাহ্য শূন্য হয়—জড়ের ন্যায় চুপ করে বসে থাকে।
কুমারকৃষ্ণ নন্দী সংকলিত ‘শ্রীরামকৃষ্ণ বাণী ও শাস্ত্রপ্রমাণ’ থেকে