উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
এহেন প্রবল পিতৃতান্ত্রিক আফগান সমাজে কোনও পরিবারে পুত্রসন্তান না থাকা যেন অভিশাপ! আসিয়ার গল্পটাই তাই। তিন কন্যার পর জন্ম নিয়েছিল চতুর্থ কন্যা আসিয়া। তাই আসিয়াকে হতে হয়েছিল আসির। পরিবার তাকে গড়ে তুলেছিল ছেলের মতো করেই। আসিয়ার পরনে সবসময় ছেলেদের পোশাক। যদিও মেয়েদের স্কুলেই পড়ে সে। ক্লাসে ঢোকার সময় হিজাব মাথায় থাকলেও ক্লাসের বাইরে সে পুরোদস্তুর ছেলে। অনেকে তো রীতিমতো বখাটে ছেলেই ভাবে। ফুটবল পায়ে আসিয়া তুখোড়, দৌড়ায়ও যেন ঠিক ছেলেদেরই মতো করে। পরিবার পাড়াপড়শিদের কাছে লুকিয়ে রেখেছে যে আসিয়া প্রকৃতপক্ষে এক মেয়ে। পুত্রসন্তান না থাকবার ‘দায়’ মেটাতে কন্যাকে শৈশবকালে এভাবে ছেলে হিসেবে পালন করার এই আফগান প্রথার নাম ‘বাচা পোশ’। আসিয়া সেই বাচা পোশদের দলে। ফার্সির আফগান সংস্করণ বা দারি ভাষায় ‘বাচা পোশ’ অর্থ মেয়ে, যারা ছেলেদের পোশাক পরে। বাচা পোশ প্রথার ব্যাপারে কোথাও কোথাও এমন লোককথাও প্রচলিত যে, কোনও সন্তানকে বাচা পোশ বানালে গর্ভের পরবর্তী সন্তানের ছেলে হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়! পরবর্তীতে পুত্রসন্তান জন্ম নিলে বাচা পোশ আবার মেয়ে হিসেবে ফিরে আসে। অবদমন বিকৃত রুচির জন্ম দেয়। অর্থাৎ যখন আপনি স্বাভাবিকভাবে কিছু ঘটতে দেবেন না, সেটা আপনাতেই বিকৃতপন্থা বেছে নেবে। একটা গাছকে সোজা বাড়তে না দিলে সে তীর্যক বা আনুভূমিকভাবেই বাড়তে থাকবে। ঠিক এটিই ঘটেছে আফগানিস্তানে। প্রবল পুরুষতান্ত্রিক আফগান সমাজে বেশ বড় একটা সময় ধরে টিকে আছে এই প্রথা। একটু লুকোছাপা থাকলেও ঠিক ‘ট্যাবু’ নয় সেটি, বরং চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। তালিবান-সোভিয়েত যুদ্ধের পটভূমিতে ২০০৩ সালে নির্মিত হয়েছিল ‘ওসামা’ নামে একটি আফগান চলচ্চিত্র। এখানেও গল্পটি এক মেয়ের। যে কি না ভগ্নপ্রায় পরিবারের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিল বাচা পোশ। সেই বাচা পোশদের খোঁজ নিয়েছেন সুইডিশ সাংবাদিক জেনি নর্ডবার্গ।
ছোটবেলা থেকে ছেলে হিসেবে লালিত ও পরিচিত হতে হতে আসিয়ার মনেও একটা সময়ে বদ্ধমূল ধারণা হতে শুরু করেছে, সে একটা ছেলে। তাছাড়া যে সমাজে মেয়ে হওয়াটা অভিশাপের ন্যায়, সেখানে ছেলে হবার আশীর্বাদ হতে কেনই বা বঞ্চিত হতে চাইবে আসিয়া? কিন্তু বিপত্তি বাধে বয়ঃসন্ধিকালে। বয়ঃসন্ধি হলেই বাচা পোশ থাকার মেয়াদকাল ফুরোয়। পরিবারই চায়, মেয়ে ফিরে আসুক মেয়ের জীবনে। হয়ত আসিয়াও ক’দিন বাদে মেয়ের জীবনে ফিরে যাবে। কিন্তু সবাই ফিরতে চায় না। মানসিকভাবে ছেলে বনাম মেয়ে—দ্বিমুখী সত্তার দ্বন্দ্বে এরা বাচা পোশই থেকে যেতে চায় আজীবন।
কে না জানে, দীর্ঘ তালিবানি শাসনের ছায়া আফগান সমাজ এখনও কাটিয়ে উঠিতে পারেনি। তালিবানি বন্দুকে ঝাঁঝরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বা ব্যক্তির অধিকারের ন্যায় শব্দগুচ্ছ আজও সেখানে আবর্জনা-সম বর্জনীয়। সামাজিক পরিচিতির ক্ষেত্রে এখনও মেয়েরা পুরুষসঙ্গীটির উপর নির্ভরশীল। ধরুন আজিতা রাফাতের কথাই। আফগান জাতীয় সংসদে ২৪৯ সাংসদের মধ্যে ৬৮ জন মহিলা সাংসদের অন্যতম তিনি। আফগানিস্তানের বাদগিস প্রদেশ থেকে নির্বাচিত আজিতাও পুত্রসন্তানের অভাবে নিজের কনিষ্ঠ কন্যাকে বানিয়েছেন বাচা পোশ! সুইডেনের সংবাদপত্র Svenska Dagbladet-এর আন্তর্জাতিক সাংবাদিক জেনি নর্ডবার্গকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি জানি আপনি অবাক হচ্ছেন এটা ভেবে যে, কী করে একজন মা তার ছোট মেয়ের সঙ্গ এমন করতে পারে। কিন্তু দেখুন, এটা আফগানিস্তান। এখানে অনেক কিছুই হয় যা আপনাদের মতো পশ্চিমীদের ধারণার বাইরে!’ ছোটবেলায় আজিতা ছিলেন তুখোড় ছাত্রী, হতে চেয়েছিলেন ডাক্তার। ধরে-বেঁধে বাবা তাঁর বিয়ে দিয়েছিলেন এক অশিক্ষিত কৃষক পরিবারে। সতীন আর অত্যাচারী শ্বাশুড়ির সঙ্গে অকর্মণ্য স্বামী। জীবন দুর্বিষহ হতে আর কী লাগে! এমন অবস্থায় বেনাফশা ও বেহেশতা নামে দুই মেয়ের জন্ম দিয়ে আরও চাপে আজিতা। তৃতীয় সন্তানও কন্যা হবার পর কান্নার রোল পড়ল পরিবারে। নিরুপায় হয়ে তাকে বানানো হল বাচা পোশ। যারা তার আসল পরিচয় জানে, তাদের কাছে মানুশ নামে এবং যাদের কাছে ছেলে, তাদের কাছে মেহরান নামে পরিচিত সে। এসব কেন মেনে নিলেন আজিতা? চাইলেই কি পারতেন না স্বামীর এই সংসার ছেড়েছুঁড়ে আসতে? না, আজিতা বিবাহ বিচ্ছেদের কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। কারণ, তালাক হয়ে গেলে মেয়েদের জিম্মাও হারাতে হবে তাকে এবং মেয়েরাও তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
রাষ্ট্রসঙ্ঘ, সেভ দ্য চিলড্রেন ও থম্পসন-রয়টার্স ফাউন্ডেশনের মতে, মহিলাদের জন্য আফগানিস্তানই সবচেয়ে খারাপ দেশ। এখানকার রক্ষণশীল এলাকাগুলিতে মহিলাদের বাড়ির বাইরে যেতে শুধু পুরুষের অনুমতিই লাগে না, বরং পুরুষ একজন সঙ্গীও লাগে। একদম নিরুপায় না হলে মেয়েরা বাড়ির বাইরে কাজও করতে পারে না। ছেলেরাই আফগান সমাজে বংশের বাতি, বার্ধক্যের লাঠি আর বিত্তের খুঁটি। মেয়ের কাজ কেবল সন্তান জন্ম দেওয়া আর স্বামীর সেবা করা। এমন সমাজে কোন বাবা-মা কন্যাসন্তান নিতে উৎসাহিত হবেন? একটা অন্তত ছেলে সন্তান তাদের থাকা চাই-ই চাই। এই চাহিদা মেটাতেই আসিয়াদের হতে হয় আসির। তাতে পুত্রসন্তান না থাকার আক্ষেপ ও সামাজিক অপমান থেকে আসিয়াদের পরিবারও খানিকটা রেহাই পায়। আড়ালে আবডালে যা-ই বলা হোক, বাচা পোশকে সমাজে ছেলের মতো করেই দেখা হয়। মেয়েদের প্রতিকূলতাগুলো এদের ভোগ করতে হয় না। একটা সাধারণ আফগান মেয়ে জিন্স পরতে না পারলেও আসিয়া তা পারে। বুকে ওড়না জড়াবার দায় নেই আসিয়াদের। চাইলে তারা ছেলেদের স্কুলেও পড়তে পারে, চাইলে একটা হিজাব জড়িয়ে মেয়েদের স্কুলেও পড়তে পারে। তারা কারো মুখাপেক্ষী নয়। একাই বাইরে যেতে পারে। খেলতে পারে। চাকরিও করতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই আফগান সমাজে বাচা পোশরা টিকে থাকবেই। অন্তত যতদিন নারী-পুরুষ পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে সকলকে মানুষ হিসেবে দেখা না হবে এবং যতদিন স্বাধীনতার একচ্ছত্র অধিপতি কেবল পুরুষই থাকবে। কোনও রক্ষণশীল অনুশাসন দিয়ে এই অমানবিক প্রথা বা সামাজিক অবক্ষয় ঠেকানো যাবে না।
আসলে, আফগানিস্তান আছে তালিবানেই। বিশেষত, মহিলাদের অধিকারের প্রশ্নে।