সম্প্রতি কলকাতার মধুসূদন মঞ্চে ব্যাঙ্গধর্মীতায় পরিপুষ্ট এক সামাজিক নাটক মঞ্চস্থ করল আসানসোল চর্যাপদ। নাটকের নাম ‘ঘোড়ার ডিম’। যে নাটকে নিন্দিত রাজনীতির আঘাতে রক্তে ভেসে যায় সভ্যতা। যেখানে শাসকের সীমাহীন ঔদ্ধত্য ও আস্ফালনে সৃষ্টি হয় চরম নৈরাজ্য। এমনই এক রাজ্যের কর্তব্যবিমুখ, দুর্বুদ্ধি সম্পন্ন, দুরাচারী রাজা গোপাল রুদ্র। যিনি সমাজ ও সভ্যতাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে ঘোড়ার ডিমে তা দিতেই বেশি পছন্দ করেন। যে রাজ্যে স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং আহারের ব্যবস্থা নেই। নেই স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার। যেখানে শুধু রাজা আছে, রাজ্য আছে আর আছে স্তাবকের ভিড়। সেরকমই এক কীটভূমির অধীশ্বর হয়ে সর্বদাই অন্ধকারের আলপনা আঁকছেন রাজা। আসলে রাজা গোপাল রুদ্র অসার অরাজকতায় ভাসমান একটি কাল্পনিক চরিত্র হলেও আদতে নাট্যকারের কৌতুক কল্পনায় এই চরিত্রটির মধ্যেই বারেবারে যেন শাসকের নির্মম হতবুদ্ধির ছবিই ধরা পড়েছে। যে নির্দয় খামখেয়ালিপনায় সব দিক থেকেই বিপন্ন হয়েছেন রাজ্যের মানুষ। যদিও এই নাট্য উপস্থাপনার মাধ্যমে রঙ্গরসিকতায় পরিপূর্ণ এক সরল কাহিনী বিবৃত হয়েছে। যা রচনা করেছেন সুপ্রিয় কাঞ্জিলাল। তাঁর রচিত এই নাটকের বিষয়বস্তু ও নামকরণের সার্থকতা নিশ্চিত ভাবেই প্রশংসনীয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে অতিকথন যুক্ত সংলাপ আরও পরিমার্জন হওয়া প্রয়োজন। কারণ সংলাপের আতিশয্যে প্রহসনের রঙ্গরস অনেক সময় যেন ধোঁয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে। এতদ্ সত্ত্বেও বলতেই হয় এ নাটকের অভিনয় শিল্পীরা যেন দর্শকের মনে পরিতৃপ্তির এক ভিন্ন স্বাদ এনে দিয়েছেন। অভিনয় শিল্পীদের শরীরী ভাষা ও অভিব্যাক্তি প্রকাশের ভঙ্গিমা ছিল যথাযথ ভাবেই মাধুর্যময়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই দর্শক চিত্তে সাচ্ছন্দ সুখ অনুভূত হয়েছে। সায়ন্তী চট্টোপাধ্যায়, পারমিতা দে, ঐন্দ্রিলা তালুকদার, শুভদীপ চৌধুরি, অর্ঘ চক্রবর্তী, শুভদীপ কর্মকার, সমীর দত্ত সহ প্রত্যেকের অভিনয় প্রশংসা যোগ্য। রাজা চরিত্রে রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তীর অভিনয় ছিল দৃশ্যতই অনিন্দ্যসুন্দর। তবে তাঁর মুখনিঃসৃত সংলাপগুলি যথাযোগ্যভাবে দর্শকের কর্ণগোচর হয়নি। অস্ফুট উচ্চারণ এবং স্বরক্ষেপণের কৌশল আরও উন্নত হলে এ নাটক অনেক উচ্চতায় নিজের স্থান করে নেবে বলেই মনে হয়। সায়ন্তী চট্টোপাধ্যায়ের পোশাক পরিকল্পনা ও রূপসজ্জা চরিত্রগুলিকে যেমন আকর্ষণীয় করে তুলেছে তেমনই সমিত বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সন্তু ভট্টাচার্যের আলোক প্রক্ষেপণ নাট্যকাহিনীর দৃশ্যগুলিকে প্রয়োজন অনুসারে বর্ণময় করে তুলেছে।
এছাড়া সুমন্ত দত্ত, রাজা সেনগুপ্ত ও পল্লব গোস্বামীর সঙ্গীত যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করেছে। অন্যদিকে একই সঙ্গে মঞ্চ পরিকল্পনা, আবহ এবং নির্দেশনার দায়িত্ব সামলেছেন রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তী। তাঁদের এই নাট্য প্রযোজনা দেখার পর নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে সামান্য কিছু অসামঞ্জস্যতা ব্যাতিরেকে আসানসোল চর্যাপদের ‘ঘোড়ার ডিম’ নাট্যাভিনয়ের মান ছিল যথেষ্ট উন্নত এবং উপভোগ্য।
সঞ্জীব বসু