কোঝিকোড়: মর্মান্তিক দুর্ঘটনার জের কাটিয়ে উঠতে পারেনি ওরা। এক মুহূর্তে কেমন করে যেন বদলে গিয়েছে গোটা দুনিয়া। এখন তো তাদের বাড়িতে থাকার কথা ছিল! ভরসন্ধ্যায় চলত দিদির সঙ্গে খুনসুঁটি। বাবার বকুনি। মায়ের আদর। অথচ একটা দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছে সবকিছু। কেউ খুইয়েছে দিদিকে। কেউ বাবাকে। আবার বাবা-মা দু’জনকেই হারিয়ে নিথর, নিশ্চুপ হয়ে বসে রয়েছে কেউ কেউ। বুঝে উঠতে পারছে না, চারপাশে ঠিক কী ঘটে চলেছে। হাসপাতালের বেড, নার্সের ব্যস্ততা, ডাক্তারবাবুদের হন্তদন্ত তদারকি দেখে নির্বিকার সকলে। যদিও এত অসঙ্গতির মধ্যেও নজর কেড়েছিল একদল অচেনা, অজানা মানুষের নীরব আদরযত্ন। তাঁদের কেউ বাবার ‘মতো’। কেউ মায়ের ‘বয়সি’। চারবেলা খাওয়ানো। মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া। গল্প শোনানো। সাহস জোগানো। হাতে হাত ধরে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সকলে। অবশেষে, বাড়ির পরিজনরা হাসপাতালে আসতেই তাঁরা হাসিমুখে বিদায় নিয়েছেন। অটুট কর্তব্যবোধ। নিখাদ মানবিকতা। যে বিশেষণই দেওয়া হোক না কেন, কোঝিকোড়ের স্থানীয় বাসিন্দা ও উদ্ধারকর্মীদের কুর্নিশ জানাতে সেগুলির কোনওটাই যেন যথেষ্ট নয়! একবাক্যে একথা মেনে নিয়েছেন বেবি মেমোরিয়াল হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। দু’খণ্ড বিমানের ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে তাঁরা ছ’জন শিশুকে বুকে আগলে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন। এমনকী তড়িঘড়ি প্রত্যেকের পরিবারের কাছে খবর পাঠিয়েছেন। এই মানবিকতা, সহানুভূতি এককথায় অবিশ্বাস্য বলে মত চিকিৎসকদের। প্রশংসায় এতটুকু অতিশয়োক্তি নেই, সেটা রাজ্য প্রশাসনও মেনে নিয়েছে। হাসপাতালের এক চিকিৎসকের কথায়, ছ’জন শিশুর প্রত্যেকের বয়স এগারোর মধ্যে। আহত অবস্থায় যখন তাদের আনা হয়, তখন কেউই কথা বলার মতো অবস্থায় ছিল না। পরে জ্ঞান ফিরলেও পুরোপুরি ধাতস্থ হতে পারেনি কেউই। ট্রমার ধাক্কায় তারা নিজেদের বাবা-মায়ের নামটুকুও বলতে পারছিল না। সঙ্গে পাসপোর্ট না থাকায় পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। সেই সময় উদ্ধারকারী স্থানীয়েরা এগিয়ে আসেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন, আহত শিশুদের ছবি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলোতে ছড়িয়ে দিলে জলদি সমাধান মিলতে পারে। ভাবামাত্র কাজ শুরু করেন তাঁরা। একে একে জবাবও আসতে থাকে। অবশেষে পরিবারের তালিকা চিকিৎসকদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
কিন্তু এরপরও যে কাজ ফুরোয়নি। যতক্ষণ না পরিবারের সদস্যদের কেউ এসে পৌঁছচ্ছে, ততক্ষণ শিশুদের দেখভালের দায়িত্বে মোতায়েন থাকেন স্থানীয়দের অনেকে। তাঁরা কেউই চেনা মুখ ছিলেন না ঠিকই। কিন্তু স্বজন হারানো শিশুদের কাছে সেই মুহূর্তে জরুরি ছিল স্নেহ আর সহানুভূতির স্পর্শ। কোঝিকোড়ের স্থানীয়রা আর সবকিছু ভুলে সেই দায়িত্ব পালনে অবিচল ছিলেন।