কর্মরতদের উপার্জন বৃদ্ধি পাবে। শরীর-স্বাস্থ্য ভালোই যাবে। পেশাগত পরিবর্তন ঘটতে পারে। শিল্পী কলাকুশলীদের ক্ষেত্রে শুভ। ... বিশদ
গত রবিবার। ইএম বাইপাস লাগোয়া একটা শপিংমলে প্রবেশের মুখ। সেখানে এক তরুণের মুখ অনেকের নজর কেড়ে থাকবে। মুখে মাস্ক। ফেসশিল্ড। দু’হাতে গ্লাভস। বয়স একুশ-বাইশ। বেশ ঝকঝকে। মন বলছে, মাস কয়েক আগে হলে তাঁকে নির্ঘাত কোনও নামী কলেজ ক্যাম্পাসে আবিষ্কার করা যেত। কিংবা উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বহুতল শপিংমলে। কিংবা মাল্টিপ্লেক্সের ফুটকোর্টে বান্ধবীর সামনে বসে ন্যাচারাল’স আইসক্রিমে কামড় বসাচ্ছেন। কিংবা রবীন্দ্রসদনের কোনও এক ফাঁকা জায়গায় বন্ধুদের সঙ্গে হুল্লোড় করছেন পোস্ট মডার্ন কবিতার কিছু ছত্র আর গিটার নিয়ে। কল্পনার জগৎ থেকে বেরিয়ে নজর করলাম যে, তাঁর গায়ের কাছে একটি রেসিং বাইসাইকেল স্ট্যান্ড করা। হ্যান্ডেলের দু’দিকে দু’টো বড় ব্যাগ ঝোলানো। হ্যান্ডেলের সামনে একটা প্লাকার্ড। তুলিতে ইংরেজিতে লেখা ‘হোম মেড স্যান্ডুইচ। চিকেন। ভেজ’। মিনিট কয়েক তাঁকে ফলো করলাম। কিনতে আগ্রহী কাউকেই দেখলাম না। বেশিরভাগকেই মনে হচ্ছে—‘খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না’। নজর দ্রুত সরে যাচ্ছে মলের ভিতরে ‘নো মাস্ক, নো এট্রি’ নোটিসে। কাছে গিয়ে কিছু প্রশ্ন রাখলাম। জানা গেল—কাছাকাছি একটি নামী হাউজিংয়ের বাসিন্দা। তাঁর বাবা আমেদাবাদে চাকরি করেন। কিন্তু লকডাউনের দিন কয়েক আগে বাড়ি এসে দীর্ঘদিন আটকে পড়েন। কর্তৃপক্ষের বার বার তাগাদা সত্ত্বেও যথাসময়ে কর্মস্থলে ফিরতে পারেননি। ফ্লাইট চালু হতেই অফিসে গিয়ে শোনেন, কর্তৃপক্ষ কিছুদিন আগেই তাঁর রিপ্লেসমেন্ট পেয়ে গিয়েছেন। অতএব আপাতত তাঁকে প্রয়োজন নেই। বস বেশ ভদ্র ভাষায় তাঁকে বলেছেন, ‘প্রয়োজন হলে খবর দেব। আপনি আপাতত আসতে পারেন’! ছেলেটি কলকাতার একটি নামী কলেজে কম্পিউটার সায়েন্সে অনার্সসহ বি-এসসি পড়েন। ফাইনাল ইয়ার। একটি নামী সংস্থার সঙ্গে পাকা কথা হয়ে আছে। ডিগ্রি কম্পিলিট হলেই চাকরিতে জয়েন করবেন। জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চার লাখ টাকার প্যাকেজ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পরীক্ষাটাই হল না। কবে হবে, কিংবা আদৌ হবে কি না জানা নেই। চাকরিটাই ঝুলে রয়েছে। সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা, চাকরিটা তাঁর জন্যে আদৌ অপেক্ষা করবে কি? বাবার করুণ মুখের সঙ্গে তাঁর মুখটাও মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে না তো! খুব ভয় পাচ্ছেন অনেক স্বপ্ন দেখা সদ্য যুবাটি।
নাম না-জানা এই তরুণের প্রতীক্ষা কিন্তু যন্ত্রণায় পর্যবসিত হয়ে উঠেছে। অথচ, এজন্য তাঁর দায় কিছু নেই। এই তরুণ একা নন। সারা দেশের বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার পরীক্ষার্থী এমনই উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে স্নাতক/স্নাতকোত্তর চূড়ান্ত পর্বের রেজাল্ট বের করে দেওয়ার ‘অ্যাডভাইসরি’ দিয়েছিল। নির্দিষ্ট ফর্মুলা মেনে একাধিক ইউনিভার্সিটি রেজাল্ট বেরও করে দিয়েছে। তবে, কলকাতাসহ বেশিরভাগ ইউনিভার্সিটি দোটানায়। আবার যেসব প্রতিষ্ঠান রেজাল্ট বের করল, তারাও খুব স্বস্তিতে নেই। ভয় পাচ্ছে, শেষমেশ ইউজিসি এসব ডিগ্রির স্বীকৃতি অগ্রাহ্য করলে কী হবে! সবচেয়ে করুণ অবস্থা পরীক্ষার্থীদের। রেজাল্ট পেয়েও তাঁরা কী করবেন? প্রশ্নবোধক চিহ্ন ঝোলানো ডিগ্রি নিয়ে কোন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাবেন তাঁরা? কোন প্রতিষ্ঠানই-বা চাকরি দেবে এইসব ডিগ্রিধারীদের। ব্যাপারটার সঙ্গে বাহাত্তরের গোলমেলে যুগের মিল খুঁজে পাচ্ছেন অনেক প্রবীণ বাঙালি।
এই প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ করতে হয় দিল্লি ইউনিভার্সিটির (ডিইউ) কথা: ইউজি এবং পিজি ফাইনাল ইয়ারের জন্য সোমবার দেশের মধ্যে প্রথমবার অনলাইন ওপেন বুক এগজাম নিতে গিয়ে লেজেগোবরে হয়েছে। সেদিনই নগ্ন হয়ে গিয়েছে খোদ রাজধানীর ছাত্রছাত্রীদের কাছেও উন্নত ইন্টারনেট পরিষেবা এখনও কতটা মহার্ঘ! অনেকে জানেন, হাইকোর্ট ঘুরে এসে তবে এই পরীক্ষা নিচ্ছে ডিইউ। কিন্তু, ব্যাপারটা আলটিমেটলি কী দাঁড়াবে শ্রীরামচন্দ্র ছাড়া কেউ জানেন বলে মনে হচ্ছে না। মহামারী পরিস্থিতিতে প্রচলিত পদ্ধিততে পরীক্ষা নেওয়া যে অসম্ভব সেটা সকলে বোঝেন। তাই পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিকল্প পথের সন্ধানে জুনের প্রথমার্ধেই রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করে দিয়েছিল। একদল পরীক্ষার্থীর তরফে দায়ের হওয়া মামলার সুপ্রিম কোর্টে বিচার পর্ব থেকে জানা যাচ্ছে, দিল্লি এবং মহারাষ্ট্র সরকারও এই পরিস্থিতিতে পরীক্ষা নেওয়ার বিরুদ্ধে। দিল্লি ১১ জুলাই এই মর্মে একটি নির্দেশও জারি করেছিল। কিন্তু ইউজিসি অন্তত ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর চাপ অব্যাহত রেখেছে। বলেছে, সমস্ত পরীক্ষা ৩০ সেপ্টম্বরের মধ্যে শেষ করতে হবে। অনলাইন/অফলাইন কিংবা ব্লেন্ডেড মোডে—যেভাবে সম্ভব পরীক্ষা নিতেই হবে।
যেসব রাজ্য এই পরিস্থিতে পরীক্ষা নিতে অপারগ তারা সর্বোচ্চ আদালতকে বলেছে, বিপর্যয় মোকাবিলা আইনবলেই পরীক্ষা না-নেওয়ার সিদ্ধান্ত তারা নিয়েছে। ১০ আগস্ট শুনানির সময় সুপ্রিম কোর্ট ইউজিসির কাছে এর ব্যাখ্যা চেয়েছে। তাদের জবাব দিতে হবে আগামীকাল, শুক্রবার। অন্যদিকে, মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির মিটিং ছিল ১০ আগস্ট। কমিটি সূত্রের খবর, তারাও ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা গ্রহণের পক্ষে। তবে তাদের সুপারিশ, পরীক্ষা হোক বছরের শেষদিকে।
পরীক্ষা নিয়ে অনড় মনোভাব প্রসঙ্গে ইউজিসি দেশ-বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে ইচ্ছুকদের স্বার্থরক্ষার কথা বলেছে। তাদের বক্তব্য—আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, সিঙ্গাপুর-সহ অনেক দেশই যেভাবে সম্ভব পরীক্ষা নিয়েছে অথবা নিচ্ছেই। গ্লোবাল কেরিয়ারের কথা মাথায় রেখে ভারতও অন্যথা করতে পারে না। ২৯ এপ্রিল তারা গাইডলাইন ইস্যু করে ১৫ জুলাইয়ের ভিতরে এই পরীক্ষাগুলো নিতে বলেছিল। তবু, অনেক রাজ্য বা বিশ্ববিদ্যালয় যে পরিস্থিতির শিকার, ইউজিসি তা অস্বীকার করেনি। তাই ইউজিসি ৬ জুলাই রিভাইজড গাইডলাইন ইস্যু করে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ওই পরীক্ষাগুলো নিতে বলে। তারপরেও যাঁদের পক্ষে এই পর্বে পরীক্ষায় বসা মোটেই সম্ভব হবে না, পরে সুযোগমতো তাদের জন্য ‘স্পেশাল এগজা’' নিতে হবে। ১৮ জুলাই প্রকাশিত এক প্রেস রিলিজে ইউজিসি বলেছে, দেশের ৯৪৫টি ইউনিভার্সিটির মধ্যে ৭৫৫টির এই সংক্রান্ত স্টেটাস তারা পেয়েছে। ওই ৭৫৫টির মধ্যে ১৯৪টি ইতিমধ্যেই পরীক্ষা নিয়েছে এবং ৩৬৬টি নেওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে।
তত্ত্ব ও তথ্যের বাইরে গিয়ে ভাবতে হবে, হাজার হাজার ছেলেমেয়ে কিন্তু এই ‘হাঁ’ এবং ‘না’-এর জাঁতাকলে যাকে বলে একেবারে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছেন। এক পরীক্ষার জন্য কতবার প্রস্তুতি নিতে পারেন তাঁরা? একে লকডাউেনর ডিপ্রেশন, তার উপর এই নিত্য দ্বন্দ্ব। শিক্ষা বিভাগের কর্ণধাররা নিজেদের বুকে হাত রেখে বলতে পারবেন, আজকের পরিস্থিতিতে পড়লে তাঁদের কী দশাটা হতো? শিক্ষা তো যৌথ তালিকার বিষয়। তাহলে এমন গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর এক্ষেত্রে কেন্দ্র-রাজ্য সমন্বয়ের এতটা অভাব ঘটল কী কারণে? কেন্দ্র-রাজ্য শাশুড়ি-বউমার সম্পর্কটা নতুন কিছু নয়। সঙ্কীর্ণতার রাজনীতি যতদিন না দূর হয় ততদিন এসব বহাল থাকবে। তবু, একবার তো ভাবা দরকার, এ কোনও বন্যাত্রাণের টাকা মঞ্জুর কিংবা রেল প্রকল্পের কৃতিত্বে ভাগ বসানোর মতো বারোমাস্যা নয়। বহু ছেলেমেয়ের স্বপ্নপূরণের ব্যাপার। জীবনে প্রতিষ্ঠালাভের সবচেয়ে সেরা কিংবা শেষ সুযোগটাই লুকিয়ে রয়েছে এর ভিতরে। এই ছেলেমেয়েরা আমার আপনার সবার বাড়িতে রয়েছেন। বিজেপি, তৃণমূল, শিবসেনা, ডিএমকে, জেডিইউ, কংগ্রেস, সিপিএম, এসইউসি সবার বাড়িতে। তাহলে এমন একটি বিষয়ে কেন সহমতের ভিত্তিতে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছনো গেল না? ফয়সালার জন্য আদালতে গিয়ে হত্যে দেওয়াটাই তো বড় দুর্ভাগ্য। করোনা পরিস্থিতিটা তো হঠাৎ এই জুলাই-আগস্টে উদয় হওয়া সমস্যা নয়। এমনও নয় যে সদ্য জানা গেল—ব্যাপারটা মিটতে কয়েক মাস লেগে যেতে পারে। মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক এবং ইউজিসি এক তরফা গাইডলাইন/নির্দেশিকা জারি না করে রাজ্য সরকারগুলোর সঙ্গে আন্তরিকভাবে আলোচনা করতে পারত না কি? প্রয়োজনে বার বার করাই উচিত ছিল। আশঙ্কা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বিরোধ বাধিয়ে দেওয়া হল না তো? শিখণ্ডী ইউজিসি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রাজনৈতিক আনুগত্য পরীক্ষার নয়া কৌশল হয়ে উঠল না তো এই অবাঞ্ছিত দ্বন্দ্ব? এসব প্রশ্ন এড়ানো যাবে না।
বিবাদ করা কিংবা দোষ-গুণ বিচারের সময় এখন নয়। অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করার সময় যে ঘরের নির্দোষ ছেলেমেয়েদের সুদীর্ঘ প্রতীক্ষা তীব্র যন্ত্রণায় রূপান্তরিত হয়েছে। আগামীকাল সুপ্রিম কোর্ট কি তাঁদের
প্রতীক্ষা এবং যন্ত্রণার যুগপৎ অবসান ঘটাতে পারবে? সারা দেশের শিক্ষানুরাগী মহলের আগ্রহ রইল।