কর্মরতদের উপার্জন বৃদ্ধি পাবে। শরীর-স্বাস্থ্য ভালোই যাবে। পেশাগত পরিবর্তন ঘটতে পারে। শিল্পী কলাকুশলীদের ক্ষেত্রে শুভ। ... বিশদ
ভারতবর্ষীয় ধর্মচিন্তার পটভূমিতে বৃন্দাবনবিহারী পার্থসারথি শ্রীকৃষ্ণের পরম শুভ জন্মজয়ন্তী তাই বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ও সমন্বয় ধর্মিতায় অনুস্যূত। সামাজিক জীবনে প্রতিপালিত। স্মরণাতীতকাল থেকে আজও শ্রীকৃষ্ণজন্মাষ্টমী উৎসব আমরা মহাসমারোহে সম্পাদন করে চলেছি।
অখিলরসামৃতসিন্ধু ও গোপীজনবল্লভ শ্যামসুন্দরের পুণ্য আবির্ভাব তিথিতে যে রূপটি আমাদের নয়নপথে উদিত হয়, তা হল তাঁর দিব্য জন্ম ও কর্মের মাধুর্যমণ্ডিত ও মহিমাময় রূপ। শ্রীহরি যখন নবরূপে অবতীর্ণ হন তখন তিনি কখনও অংশ, কখনও আবার অংশের অংশ রূপে লীলা করে থাকেন। কিন্তু কৃষ্ণ মূর্তি তাঁর স্বাধীন ও পূর্ণতমরূপ। অন্যান্য অবতার শ্রীকৃষ্ণের অংশ বা কলা—‘এতে চাংশকলাঃ পুংসঃ কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ম্।’ তাঁর ঐশ্বর্য অনন্ত। আর মাধুর্য বর্ণনাতীত। তিনি সকলের চিত্ত আকর্ষণ করেন তাই তিনি ‘কৃষ্ণ’। তিনি সবার হৃদয় হরণ করেন ও সমস্ত কিছু অমঙ্গল নাশ করেন সেইজন্য ‘শ্রীহরি’। তিনি নরের অয়ন বলেই ‘নারায়ণ’ সর্বব্যাপক সেজন্য কৃষ্ণই ‘বিষ্ণু’। কৃষ্ণ সর্বভূতে বিরাজমান তাই তাঁর নাম ‘বাসুদেব’। তিনি এক এবং অদ্বিতীয় ব্রহ্ম। তিনি নিজেকে জগৎরূপে পরিবৃত করে আছেন। শ্রীকৃষ্ণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পরমতত্ত্ব অন্য কিছু নেই। শ্রীকৃষ্ণের দেহে চরাচর সমগ্র জগতের অধিষ্ঠান। সকলের ধ্যেয় বস্তু হয়ে যুগে যুগে তাঁর মহিমা বন্দিত হয়েছে। ‘না জানি কতেক মধু শ্যাম নামে আছে গো, বদন ছাড়িতে নাহি চায়।’ আমাদের সাধনা, শাস্ত্র, সংস্কৃতি, সভ্যতা, সমাজ, সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্প সবকিছুই কৃষ্ণমহিমায় পরিপুষ্ট ও বিকশিত। কৃষ্ণের স্বরূপের উপাসনা বিচিত্র ও বিবিধ রূপে প্রচারিত ও সমাদৃত হয় বিভিন্ন প্রান্তে, বিভিন্ন যুগে। কৃষ্ণচরিত্র আলোচনা প্রসঙ্গে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, ‘গ্রামে গ্রামে কৃষ্ণের মন্দির, গৃহে গৃহে কৃষ্ণের পূজা, প্রায় মাসে মাসে কৃষ্ণোৎসব। উৎসবে উৎসবে কৃষ্ণযাত্রা। কণ্ঠে কণ্ঠে কৃষ্ণগীত, কাহারও গায়ে দিবার বস্ত্রে কৃষ্ণনামাবলি। কাহারও গায়ে কৃষ্ণনাম ছাপ, কেহ কৃষ্ণনাম না লিখিয়া কোন পত্র বা কোন লেখাপড়া করেন না। ভিখারি ‘রাধে কৃষ্ণ’ না বলিয়া ভিক্ষা চায় না। কোনো ঘৃণার কথা শুনিলে ‘রাধে কৃষ্ণ’। কৃষ্ণ এদেশে সর্বব্যাপক।’
মহাভারতে নরদেহধারী এই পুরুষোত্তম বহুলভাবে আলোচিত ও বিচিত্র উপস্থাপনায় বিবৃত। এখানে শ্রীকৃষ্ণ মহান রাষ্ট্রনায়ক, বিনম্রজনের সংরক্ষক, শান্তির পূজারি, কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধের মূল নিয়ামক এবং গীতাকার পার্থসারথি রূপে বিঘোষিত। আর শ্রীমদ্ভাগবতের দৃষ্টিকোণে তিনি অপ্রাকৃত নবীন মদন, প্রেম ও ভক্তিরসের অখণ্ডমূর্তি, শ্রীরাধার প্রাণনাথ ও সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ শ্রীকৃষ্ণ। সনাতনধর্মের সমস্ত সম্প্রদায়ের কাছে এই গোপীজন মনোহারী পরব্রহ্ম ও সর্বলোক মহেশ্বর। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘শ্রীকৃষ্ণই সকল সম্প্রদায়ের কাছে ধর্মের প্রবেশের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। মনঃশক্তি এবং প্রচণ্ড কর্মপ্রবণতার কী অপূর্ব বিকাশ। ... শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে উপদেশ দিচ্ছেন। তিনিই শ্রেষ্ঠ যোগী ও জ্ঞানী।’
যিনি অরূপ হয়েও বহুরূপী, সেই আশ্চর্যকর্মা ভারতের প্রাণপুরুষ তিনি কিন্তু এলেন ছোট হয়ে। আঁধারে, অনাড়ম্বরে। কোনও আশ্রম-মঠ-মন্দির বা তীর্থক্ষেত্রে নয়, এলেন এক নিপীড়ক ভোগাশক্ত নৃপতির কারাগারে। তাঁর জন্ম ও কর্ম প্রাকৃত নয়, দিব্য একথা শ্রীভগবান ব্রজেন্দ্রনন্দন স্পষ্টই বলেছেন, ‘জন্ম কর্ম চ মে দিব্যম্।’ উল্লেখ্য, শ্রীকৃষ্ণের জন্মকালের কথা সুনিপুণভাবে বর্ণিত পুরাণ চক্রবর্তী শ্রীমদ্ভাগবতের ভাবালোকেই সমগ্র ভারতের শ্রীকৃষ্ণজন্মাষ্টমী উৎসব উৎসারিত।
দানবরাজ কংসের অত্যাচারে জগৎ প্রপীড়িত। মাতা দেবকী ও পিতা বসুদেব নির্দয় কংসের কারাগারে বন্দি। সকাতরে প্রার্থনা করছেন তাঁরা। ‘হে পতিতপাবন, শ্রীমধুসূদন! তুমি ধরাধামে অবতীর্ণ হও। আসুরিক অত্যাচার ও অনাচারে আজ লক্ষ কোটি নরনারী নির্যাতিত। নিপীড়িত ও সন্তপ্ত। তুমি আজ কোথায়? তুমি এই ত্রিতাপ-জ্বালা হতে জীবকুলকে উদ্ধারের জন্য পুনরায় নরদেহে অবতরণ কর।’ তাঁদের সেই মর্মভেদী কাতর প্রার্থনায় ভাদ্রমাসের কৃষ্ণাষ্টমীর সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন মহারাত্রিতে দুর্যোগের ঘনঘটায় অন্তর্যামী বৈকুণ্ঠপতি ভগবান শ্রীবিষ্ণু কৃষ্ণরূপে দেবকীর কোল আলো করে আবির্ভূত হলেন এই মর্তধামে।
দেবকী-বসুদেব দেখলেন, সেই শিশু অত্যন্ত অদ্ভুত। ‘তমদ্ভুতং বালকম্।’ চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্মশোভিত। কমল নয়ন এই বালকের সুন্দর বক্ষস্থলে শ্রীবৎস চিহ্ন। গলদেশে কৌস্তুভমণি, পরনে পীতবাস। নবীন মেঘের মতো অঙ্গকান্তি। মাথায় মণিখচিত মুকুট। কর্ণে কুণ্ডল। অতি উজ্জ্বল চন্দ্রহার, কেয়ূর ও কঙ্কণাদি অলঙ্কারের দীপ্তিতে সেই শিশুর সর্বাঙ্গ সুশোভিত ও সমুজ্জ্বল।
চতুর্ভুজ নারায়ণকে পুত্ররূপে দেখে বসুদেব ও দেবকী হলেন সচকিত। কারাগৃহ তখন আলোয় আলোকিত। সেই মুহূর্তে ভুলে গেলেন তাঁদের অপত্য স্নেহ। শ্রীহরির দিব্যদর্শনে ভগবৎভাবে বিভোর হয়ে তাঁরা শ্রীভগবানের দিব্যস্তুতি করতে লাগলেন। দেবকীর প্রার্থনায় ভগবান তাঁর ঐশ্বরিকতা সংবরণ করে প্রকৃত শিশুর রূপ ধারণ করলেন এবং বসুদেবকে নির্দেশ দিলেন তাঁকে নিয়ে নন্দগোপের ঘরে রেখে আসতে। এরূপ আদেশ পেয়ে বসুদেব শিশুসন্তানকে স্কন্ধে নিতেই আপনা আপনিই লৌহশৃঙ্খলে আবদ্ধ কপাটের দরজা খুলে গেল। মায়ার প্রভাবে প্রহরীরা তখন নিদ্রাবিষ্ট। অজস্র বর্ষণের মধ্যে বসুদেব নিঃশব্দে চললেন গোকুলের দিকে। উপনীত হলেন যমুনা তীরে। সামনে উত্তাল তরঙ্গ। অন্ধকার রজনীর আকাশে মুহুর্মুহু গুরুগুরু গর্জন। আতঙ্কিত বসুদেবের চিন্তা, সদ্যোজাত শিশুপুত্রকে নিয়ে তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ ভয়াবহ যমুনা অতিক্রম করবেন কী প্রকারে? মহানাগ অনন্তদেব তাঁর সহস্র ফণা বিস্তার করে ছাতার মতো আচ্ছাদন করে দিল বসুদেবের মাথায়। বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেয়ে তিনি দেখলেন এক শৃগালী যমুনায় হেঁটে পার হয়ে যাচ্ছে। ভাবলেন, তবে যমুনায় চর পড়েছে। তাই তৎক্ষণাৎ শৃগালরূপধারিণী মায়ার নির্দিষ্ট পথে তাঁকে অনুসরণ করে বসুদেব অতি সহজভাবে দুরতিক্রম যমুনা পার হয়ে পৌঁছলেন গোকুলের নন্দালয়ে। সেখানে নন্দ-প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করে তিনি দেখলেন দ্বারে প্রহরী, নন্দরাজা, মা যশোমতী সবাই গভীর নিদ্রায় মগ্ন। সেই সুযোগে তিনি স্বীয় পুত্রকে একান্তে যশোদা মায়ের পাশে শুইয়ে দিয়ে মহামায়াস্বরূপিনী যশোদাগর্ভসম্ভূতা শিশুকন্যাটিকে বক্ষে উঠিয়ে নিলেন এবং পূর্বের মতো যমুনা পার হয়ে কংসের অন্ধকার কারাগৃহে উপনীত হলেন। এরপর সেই দেবীরূপিণী কন্যাকে দেবকীর কোলে অর্পণ করলেন। অতঃপর যোগমায়ার সহায়তায় কোনও বিঘ্ন না ঘটে আপনা থেকেই কারাগারের দ্বার রুদ্ধ হয়ে বসুদেব দেবকী আবার শৃঙ্খলে বদ্ধ হলেন।
এদিকে পরের দিন প্রভাতে মা যশোদা দেখলেন অনন্য সাধারণ পরম রমণীয় এক সুন্দরতম পুত্র। শিশুর রূপমাধুর্যে সবাই বিমুগ্ধ। আনন্দে মুখর নন্দালয়ে শুরু হল মহোৎসব। যা আজও চিরাচরিত্র ‘নন্দোৎসব’ নামে।
—‘কৃষ্ণের যতেকলীলা সর্বোত্তম নরলীলা নরবপু তাহারি স্বরূপ।’ —শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত