অতিরিক্ত পরিশ্রমে শারীরিক ক্লান্তি। প্রিয়জনের বিপদগামিতায় অশান্তি ও মানহানির আশঙ্কা। সাংসারিক ক্ষেত্রে মতানৈক্য এড়িয়ে চলা ... বিশদ
কেমন আছেন?
ভালো, ভালোই আছি। কাজের মধ্যেই আছি।
আপনাকে বলা হচ্ছে এই মুহূর্তে বাংলা থিয়েটারে ব্যস্ততম অভিনেতা। কেমন লাগছে?
না... না... সেরকম কোনও ব্যাপার নয়। লোকে বলছে ব্যস্ত, তবে আমার ঠিক সেরকম মনে হয় না। আমার থেকেও ব্যস্ত শিল্পী বাংলা থিয়েটারে অনেকে আছেন। এই যেমন ধরুন যাঁরা নাটকে মিউজিকের কাজ করেন বা যাঁরা মঞ্চ নিয়ে কাজ করছেন তাঁরাও শিল্পী। আমি তাঁদের শিডিউল দেখেছি। তাঁরা আমাদের থেকেও অনেক বেশি ব্যস্ত।
এই মুহূর্তে ক’টা নাটকে কাজ করছেন?
হা... হা... হা... সেরকমভাবে গুণে দেখিনি। তবে হ্যাঁ, নিয়মিত শো করে এরকম প্রায় সতেরোটা নাটকে অভিনয় করছি। আর অনিয়মিত মানে চার-পাঁচ মাস পরে পরে শো করে এরকম দলের সংখ্যা প্রায় এগারো-বারো। আর অভিনয়ের পাশাপাশি নির্দেশনার কাজ এবং কোরিওগ্রাফির কাজকে যদি ধরি তাহলে সংখ্যাটা নিঃসন্দেহে চল্লিশের ওপরে।
আগামী ছয় মাসের মধ্যে কী কী নাটক আসছে?
(একটু ভেবে) খুব উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে ধরুন ধানসিড়ি নাটকের দলের হয়ে ‘সারমেয় সংবাদ’ করছি কণিকা মজুমদারের নির্দেশনায়। হাতিবাগান সংঘারামের হয়ে ‘পঞ্চু লাহা’ করছি অনির্বাণ ভট্টাচার্যের নির্দেশনায়, আমার আর সুজিতকুমার রায়ের যৌথ নির্দেশনায় একটি নাটক আসছে ‘দ্য কাইট রানার’। অন্য থিয়েটারের ব্যানারে ‘টোপি’ বলে একটি নাটক করছি অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায়। এছাড়া আরও বেশ কয়েকটি নাটক আস্তে আস্তে তৈরি হচ্ছে। যেগুলো আগামী বছরের গোড়ার দিকে আসবে।
আজকের প্রসেনজিৎ হয়ে ওঠার পিছনে কি ‘মুম্বাই নাইটস’ নাটকটির অবদান অনেকখানি?
না আমার ঠিক তা মনে হয় না। দেখুন আমি একটা নাটক করতাম ‘জাল’ বলে, যেটি প্রথমে কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্রের ব্যানারে হতো। যেটা পরবর্তীকালে গৌতম হালদারের নির্দেশনা ন’য়ে নাটুয়ার ব্যানারে হতো। ওই নাটকটি আমাকে একটা অন্যরকম পরিচিতি দিয়েছিল। তারপর মিনার্ভা রেপাটারির ‘দেবী সর্পমস্তা’ নাটকটি বেশ প্রশংসিত হয় এবং অবশ্য করেই আমার চরিত্রটি। তারপর ‘মুম্বাই নাইটস’। এই নাটকটি বাণিজ্যিকভাবে সফল একটি নাটক। তাই প্রচুর মানুষ দেখে ফেললেন।
আপনার অভিনয়ের জগতে প্রবেশ কীভাবে?
সে এক লম্বা কাহিনী। অবশ্যই খুব পরিকল্পিতভাবে এ জগতে আসিনি। আমি ছোটবেলায় বেহালার একটা কোচিং সেন্টারে পড়তাম। পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিলাম। খেলাধুলো, অভিনয়ও ভালো লাগত। তো একবার কোচিং সেন্টার থেকে নাটক করা হচ্ছে। সেই নাটকে শেষ মুহূর্তে একটি চরিত্রের অভিনেতা অনুপস্থিত হয়ে পড়ে। তখন স্যার আমাকে বললেন সেই চরিত্রটা করে দিতে। কারণ আমি তাড়াতাড়ি মুখস্থ করতে পারব। তো করলাম সেই নাটক। যিনি আমাদের পরিচালনার কাজ দেখছিলেন সেই দাদা আমার অভিনয় দেখে প্রস্তাব দিলেন তাঁদের সঙ্গে স্ট্রিট ড্রামা করার। সেগুলো ছিল আসলে অ্যাওয়ারনেস ক্যাম্পেন জাতীয়। বললেন, করলে টাকা পাওয়া যাবে। সেই সময়ে আমাদের পরিবারের অর্থনৈতিক হাল যা ছিল তাতে ‘টাকা পাওয়া যাবে’ এই প্রস্তাবটা আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ব্যস! যুক্ত হয়ে গেলাম স্ট্রিট থিয়েটারে। টানা পাঁচবছর সেই দলে কাজ করেছি। টাকাও পেয়েছি। ফলে অন্য কোনও ভাবনা মাথায় আসেনি। তখন এক শুভানুধ্যায়ী আমাকে বললেন, দেখ তুই যদি অভিনয়টাকেই পেশা হিসেবে নিতে চাস তবে তোকে কিন্তু আরও শিখতে হবে। আসলে তখনও কিন্তু আমি মঞ্চে কোনও নাটক দেখিনি, করা তো দূরস্থান। তো সেই শুভানুধ্যায়ীর কথায় আমি বেহালার শরৎ সদনে টিকিট কেটে একটি নাটক দেখলাম। নাটকটির নাম ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’। নাটকটা দেখে আমার মনে হল, আরে, নাটক এরকম হয়! আমি তো এর কিছুই জানি না। তারপর ভর্তি হলাম নান্দীকারের ওয়ার্কশপে। সেই আমার প্রথম থিয়েটারের অভিনয় শেখা। তারপর নান্দীকারের ‘সোজনবাদিয়ার ঘাট’ নাটকে কোরাসে অভিনয় করার সুযোগ পেলাম। প্রায় পনেরোটা শো করেছি। তারপর গৌতম হালদারের হাত ধরে ন’য়ে নাটুয়ায় প্রবেশ। সেখান থেকে দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মিনার্ভা রেপার্টরিতে। সেখানে প্রথমে ‘দেবী সর্পমস্তা’ তারপর ব্রাত্য বসুর নির্দেশনায় ‘মুম্বাই নাইটস’। এই হল আমার পথচলার শুরু।
ব্রাত্য বসুর কথা যখন উঠলই তখন কোম্পানি থিয়েটারের কথায় আসি। কী মনে হয় কোম্পানি থিয়েটার থাকবে নাকি থিয়েটার আবার আগের ফর্মে ফিরে যাবে?
দেখুন, আমি ঠিক ব্যাপারটাকে এরকমভাবে দেখি না। থিয়েটার করে প্রফিট করা সম্ভব নয়, মানুষ যদি টিকিট কেটে হলে আসে তবে অন্তত প্রোডাকশন কস্টটা উঠে আসতে পারে। আর তার জন্য চাই ভালো মানের প্রযোজনা। সে যে কোনও ফর্মেই হোক।
এখন বাংলা থিয়েটারে আদর্শহীন নিকৃষ্ট এক রাজনীতির রমরমা দেখা যাচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
(হাসি)... দেখুন যে যার রাজনীতি বা দর্শনের কথা বলতেই পারে। কিন্তু সেটা খুব গোদাভাবে না বলে একটু শিল্পের মধ্যে দিয়ে নাটকের মাধ্যমে বললে ভালো হয়।
আমার প্রশ্নটা কিন্তু ঠিক এরকম ছিল না।
দেখুন আমি অভিনেতা, রাজনীতি নিয়ে আমার ধ্যান-ধারণা খুবই কম। তাই এর থেকে আর বিশদভাবে কিছু বলতে পারব না।
আজকাল সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে থিয়েটারকর্মীরা ঝগড়া বিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন...
হ্যাঁ, এটা আমিও লক্ষ্য করি। খুবই দুঃখজনক। ধরুন আজকের দিনে ফেসবুক একটা বিরাট প্ল্যাটফর্ম। সেটা নাটকের মানুষদের বেশি বেশি করে ব্যবহার করা উচিত। আসলে খুব তাড়াতাড়ি সাফল্য চাইছে কিছু মানুষ। আর সেটার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ইচ্ছে করেই খানিকটা বিতর্ক তৈরি করছে। দেখুন আপনার দায়িত্ব, পদমর্যাদা যত বাড়বে, আপনার তত বেশি সংযত হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। কিন্তু তাড়াতাড়ি নাম করার দৌড়ে আমরা সেসব ভুলে যাচ্ছি। আবারও বলছি খুবই দুঃখজনক।
সামগ্রিকভাবে বাংলা থিয়েটারের ভবিষ্যৎ কী?
এখন যে অবস্থায় আছে সেটা একটা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে কাগুজে বাঘের মতো অবস্থা। মানে আমরা বড় ভালো আছি। কিন্তু আদতেই ব্যাপারটা তা নয়। থিয়েটারকে স্বনির্ভর হতে হবে, মানুষকে হলমুখী করতে হবে। ভিন্ন মত থাকলেও কোনও একটা জায়গায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, না হলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
এরকম একটা সময়ে দাঁড়িয়ে থিয়েটারে অভিনয় করাটাকে জীবিকা বানালেন, অনিশ্চয়তায় ভোগেন না?
ভুগি তো। কিন্তু কী করব! ঝুঁকি তো সব পেশাতেই আছে। আমি না হয় একটু বেশিই ঝুঁকি নিলাম। ধরুন যে প্যারাগ্লাইডিং করছে সেও তো জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে। আবার ধরুন যিনি মাঝসমুদ্রে মাছ ধরতে যাচ্ছেন তিনিও তো ঝুঁকি নিচ্ছেন। সেটাও তো একটা পেশা।
ব্যস্ততার চরম শিখরে রয়েছেন, থিয়েটারের ব্যস্ততা আর পারিবারিক জীবন এ দুটো ব্যালেন্স করছেন কীভাবে?
ব্যালেন্স যে খুব একটা করতে পারছি তা একদমই নয়। ডিপ্রাইভড হচ্ছে আমার ব্যক্তিগত জীবন। আমি সবটা উপলব্ধি করতে পারলেও আমার আর কিছু করার নেই। তবুও আমার পরিবারের লোকেরা আমার পাশে আছে। খানিকটা অন্যায় করছি হয়তো, তবুও তারা আমাকে উৎসাহ দেয়।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? দল করবেন? বড় পর্দায় অভিনয় করার বাসনা আছে?
প্রশ্নই ওঠে না। কেউ লিডার হয়ে জন্মায়, আবার কেউ জীবনে ঘুর পথে লিডার হয়ে ওঠে। দুটোর কোনওটাই আমার মধ্যে নেই। তবে আমি বেশ কিছু দলে নির্দেশনার কাজ করে থাকি। সেটা আমি চালিয়ে যাব। কিন্তু দল খুলে অনেক মানুষকে সামলানো বড্ড কঠিন কাজ। আর একটা সিনেমায় ইতিমধ্যেই অভিনয় করে ফেলেছি। সেটা হল ‘হামি’। পরবর্তীকালে ডাক পেলে ফের করতে পারি। তবে প্রায়োরিটি কিন্তু থিয়েটার। আপাতত এই বেশ ভালো আছি।