বিদ্যার্থীদের ক্ষেত্রে ভাবনা-চিন্তা করে বিষয় নির্বাচন করলে ভালো হবে। প্রেম-প্রণয়ে বাধাবিঘ্ন থাকবে। কারও সঙ্গে মতবিরোধ ... বিশদ
মাথা ও মুখ ভরে গিয়েছে পাকা চুলে। বিষণ্ণ বৃদ্ধ সম্রাট শাজাহানের চোখে জলের ধারা। যমুনা নদীর তীরে আগ্রাদুর্গের দোতলায় একটি ছোট কুঠুরিতে বসে তার নিঃসঙ্গ বন্দী জীবন কাটছে। সেই ঘরের দক্ষিণ দিকের দেওয়ালে ছোট একটি ফুটো। তা দিয়ে দূরে তাজমহল দেখা যায়। সেদিকে তাকিয়ে কাঁদছেন শাজাহান। বলছেন, প্রিয়তমা মমতাজ দেখ কী অবস্থা করেছে তোমার ছোট ছেলে ঔরংজেব। যাকে যত্ন করে মানুষ করলাম, সেই পুত্র সিংহাসনের লোভে একে একে দাদাদের খুন করেছে। আমাকে রাজপ্রাসাদের মধ্যে আলাদা কুঠুরিতে বন্দি করে রেখেছে। একবারটি তোমার কাছে গিয়ে বসতে দিচ্ছে না। মমতাজ তুমি একবার দেখে যাও। আর গলা থেকে শব্দ বেরচ্ছে না। শুধু দু’ চোখের কোল বেয়ে নেমে আসছে অসহায় বৃদ্ধের নীরব হাহাকার।
পুত্রের হাতে বন্দি পিতার হৃদয়স্পর্শী এই কাতর আর্তনাদ সামনে বসা শ্রোতাদের মন তখন দুর্বল করে দিয়েছে। তাঁরা সকলেই বৃদ্ধ শাজাহানের অভিনয়ের সঙ্গে এতটাই একাত্ম হয়ে গিয়েছেন, চোখের জল সামলে রাখতে পারছেন না। বার বার নিজেদের অজান্তে ডান হাত জল মুছতে চলে যাচ্ছে চোখের কাছে। উংইসের আড়ালে বসা প্রম্পটার স্বপনবাবুও কাঁদছেন। পরের সংলাপ প্রম্পট করার কথা বেমালুম ভুলেই গিয়েছেন। একজন এসে ধাক্কা দিতে তাঁর সম্বিত ফিরল।
না, এটা চিৎপুরের বিখ্যাত কোনও যাত্রাসংস্থার যাত্রা নয়। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত জল, জঙ্গল, নদী অধ্যুষিত পাথরপ্রতিমার অখ্যাত রামকৃষ্ণ স্মৃতি সংঘ নাট্য সংস্থার ঐতিহাসিক যাত্রাপালা শাজাহান। মুখ্য চরিত্র শাজাহানের ভূমিকায় যিনি অভিনয় করছেন তিনিও কোনও নামী অভিনেতা নন, পাথরপ্রতিমার তৃণমূল বিধায়ক ও সুন্দরবন উন্নয়ন পর্ষদের ভাইস চেয়ারম্যান সমীর জানা। ইতিমধ্যে যাত্রাপালাটি পাথরপ্রতিমার বাইরে গোসাবা, মথুরাপুর, কুলতলি সব জায়গাতে কদর পেয়েছে। অসাধারণ অভিনয়ের জন্য বিধায়কের জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়ে গিয়েছে যে, সুন্দরবনের ব্লকগুলিতে কোথাও কোনও সাংস্কৃতিক কিংবা রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে গেলেও শাজাহানের সংলাপ বলার জন্য চাপ আসছে। জনগণের দাবিতে তাঁকে সেই আবদার মেটাতেও হচ্ছে। বাস্তবিকই দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সুন্দরবন ছাড়াও বিস্তীর্ণ গ্রামঞ্চলে এখন নামীদামী যাত্রা সংস্থার চেয়ে রাজনৈতিক দলের নেতা, বিধায়কদের অভিনীত যাত্রাপালার চাহিদা দিনকে দিন বাড়ছে। বিধায়ক সমীর জানার কথায়, রাজনীতির মধ্যে দিয়ে মানুষের মনের একেবারে গভীরে পৌঁছনো যায় না। যাত্রা ও নাটকের মধ্যে দিয়ে দ্রুত তা করা যায়। তাছাড়া এর ভিতর দিয়ে লোকশিক্ষা হয়। ভালো সমাজ তৈরি করতে হলে লোকশিক্ষার প্রয়োজন। তা না হলে রাজনীতিও সুস্থ থাকবে না।
এর বাইরে আরও একটা জরুরি বিষয় হল, গ্রামের মানুষের অনেক টাকা দিয়ে বড় যাত্রা সংস্থাকে আনার ক্ষমতা নেই। সেই কারণে আমাদের মতো অপেশাদার নেতা ও বিধায়কদের অভিনেতার ভূমিকায় নামতে হয়েছে। আমাদের সঙ্গে গ্রাম পঞ্চায়েত সমিতির একাধিক সদস্য অভিনয় করছে। আরও একটি বিষয় হল, কুশীলব হিসেব আমাদের অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে কম খরচে গাঁয়ের মানুষের মনোরঞ্জন ও যাত্রা দেখার আকাঙ্খা দুটোর সাধই একসঙ্গে মেটাতে পারছি। এই সময়ে বাবা-মায়ের আদুরে ছেলেরা চাকরি পাওয়ার পর সব ভুলে যাচ্ছে। বাবা ও মাকে বৃদ্ধাবাসে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিচ্ছে। শাজাহান এর মধ্যে দিয়ে লোকশিক্ষার সেই বার্তা দিতে চেয়েছি। যাতে সকলের চোখ খুলে যায়। বাবা-মায়ের প্রতি ছেলেরা এমন আচরণ যেন না করে। কারণ তাঁরা পরমগুরু। বিধায়ক বলেন, স্কুলে চাকরি পাওয়ার পর থেকে যাত্রা ও নাটক করছি। রাজনীতিতে আসার পরও অভিনয় ছাড়তে পারিনি। আসলে ‘নাচঘরের কান্না’ যাত্রা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। পণের টাকা দিতে না পেরে মেয়েকে খুন করেছিল বাবা। সেই বাবার ভূমিকায় অভিনয় করে জেলার বহু জায়গাতে প্রশংসা পেয়েছিল। পণ নিয়ে এমন যেন আর না হয়, সে কথাই বলতে চেয়েছিলাম। দশ থেকে পনেরো নাইট সেই পালা করতে হয়েছিল। এবার নতুন একটি যাত্রাপালা ‘সাত টাকার সন্তান’ করার জন্য এখন পরিকল্পনা চলছে।
ডায়মন্ডহারবার-২ নম্বর ব্লক তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি অরুময় গায়েন নেতা হিসেবে যত না পরিচিতি তার চেয়ে অভিনেতা হিসেবে জনপ্রিয় বেশি। গ্রাম বাংলায় ‘মা মাটি মানুষ’, ‘আজকের অভিমন্যু’, ‘স্বামী স্ত্রীর শেষ দেখা’র নায়ক ও অভিনেতা হিসেবে তাঁকে সকলে চেনে। প্রতিবছর প্রতিটি যাত্রা হিট। চলতি বছরে নুরপুরে যাত্রা প্রতিযোগিতায় অরুময় গায়েনের ১৮ বছরের যাত্রা সংস্থা অষ্টমী নাট্য সংস্থার যাত্রা প্রথম পুরষ্কার পেয়েছে। তারও নায়ক অরুময়। এখন জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ডাক পাচ্ছেন তাঁরা। রাজনীতিতে আসার আগে সেই ছেলেবেলায় ডায়মন্ডহারবারে আঁকড়াপুঞ্জ গ্রামে বাবা অতুল গায়েনের হাত ধরে ‘অমল ও দইওয়ালা’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেছিলেন। ফঁকিরচাঁদ কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পর রাজনীতিতে চলে আসেন। তারপর মিছিল, মিটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও অভিনয়কে কখনও সরিয়ে রাখেননি। বলেন, চিরাচরিত নৈতিকতা, সহনশীলতা, পিতা-মাতার উপর শ্রদ্ধা, অন্যকে সম্মান দেওয়া, সংযম, সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলার মানসিকতা অতি সহজে যাত্রাপালার মধ্যে দিয়ে মানুষের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, তা বাবা-মা দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই কাজটাই বিভিন্ন সামাজিক পালা অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে করে যাচ্ছি। ব্লক সভাপতির সঙ্গে দলের আরও অনেকে অভিনয় করছে। এরমধ্যে রয়েছেন ডায়মন্ডহারবার-১ এর পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষ মনমোহনী বিশ্বাস, পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ গৌতম অধিকারী, সরিষা পঞ্চায়েত প্রধান তাপস মণ্ডল প্রমুখ। মথুরাপুর, মন্দিরবাজার জুড়ে দু’টি যাত্রা সংস্থার পালাগুলি এখন সবার নজর কেড়েছে। একটি মন্দিরবাজার বিধায়ক জয়দেব হালদারের ধান্যঘাটা বলাকা সংঘ। এদের ‘দেবী সুলতানা’, ‘একটি পয়সা’, ‘মহারাজা হরিশচন্দ্র’, ‘নরনারায়ণ’ প্রভৃতি পালা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অন্যটি জেলা পরিষদের সদস্য ও প্রাক্তন মৎস্য কর্মাধ্যক্ষ মানবেন্দ্র হালদারের ‘পিতৃমাতৃ নাট্যসংস্থা’। এদেরও ‘স্বামী আছে সিঁদুর নাই’, ‘আজকে বাবার ফাঁসির দিন’ রমরম করে চলেছে। দু’টি দলে অভিনেতাদের মধ্যে অধিকাংশই দলের প্রধান, পঞ্চায়েত সদস্য, জেলা পরিষদের সদস্য প্রমুখ। জয়দেববাবু ২৫ বছর ধরে অভিনয় করছেন। মানবেন্দ্রবাবুর কথায়, গ্রামের মানুষের মধ্যে যাত্রার উপর আলাদা নেশা রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক প্রচার ও কোনও অনুষ্ঠানে গেলে সকলেই আবদার করছে, নতুন যাত্রা করতে হবে। তখন সত্যিই আনন্দ হয়।